বাংলা কবিতায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা কাব্য সাহিত্যেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিকৃতি, স্থান ও ভূমিকা

বাংলা কাব্য সাহিত্যেয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবদান কবিকৃতি

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এক দারুণ চিত্রকর কবি। টুকরো টুকরো কথা দিয়ে মালা গেঁথে গেঁথে তিনি কবিতায় একটির পর একটি ছবি গড়ে তোলেন। সে ছবি আশা-নিরাশার, বিশ্বাস অবিশ্বাস, ভালোবাসা আর প্রবঞ্চনার। কখনো বা বাস্তব থেকে কল্পনার পথে যাত্রার, কখনো বা নিসর্গ সৌন্দর্যের, কখনোবা ঘরোয়া আটপৌরে সুখ-দুঃখ মিশ্রিত ক্ষণস্থায়ী আনন্দ-বেদনার। এ সবই তিনি করেন খুব নিচুস্বরে, কোমল নরম শব্দ প্রয়োগে। তাই তার কবিতার অভ্যন্তরে একটা চাদের অমল জ্যোৎস্নার মতোন মৃদু সঙ্গীত খেলা করে। এ কারণেই তার কবিতা পাঠে একটা আলাদা মজা আছে, আনন্দ আছে। বিশেষ করে সে আনন্দের গায়ে রঙ লেগে যায়। বলে। মনের ভেতরে একটা স্বপ্ন-লাগা ঘোর তৈরি করে দেয়। এ জন্য আমরা কবি নীরেন্দ্রনাথকে এক জীবন-বীক্ষণের আনন্দময় কবি-রূপে চিহ্নিত করতে পারি।


কবি নীরেন্দ্রনাথের কবিতার বিশেষত্ব হল–সহজ-সরল জলের মতোন পাঠকের অন্তরগহনে তির তির করে ঢেউ তোলে। তিনি গদ্যের কথ্য ভাষায়, স্পষ্ট ছবি গেঁছে গেঁথে আপনমনের একতারাতে সুর তুলে কবিতাকে তর তর করে নদীর স্রোতের মতোন এগিয়ে নিয়ে যান। কি শব্দ চয়নে, কি ছন্দ ও চিত্রকল্পে, এমনকি বিষয় নির্বাচনে তিনি কোনো চমক দেখান না। এ কারণে তাঁর কবিতা বড়বেশি হৃদয়স্পর্শী। আর এজন্য কবিতায় যেমন পাওয়া যায় তাঁর সংবেদনশীল মনের গভীর পরিচয়, তেমনি নিয়ত পরিবর্তনশীল কপাট খোলার প্রবণতা। এ কারণে প্রতিনিয়িত তিনি দ্বান্দ্বিকতায় ভোগেন। এ জন্যই তিনি অল্প দুঃখে যন্ত্রণা-পান অধিক, আবার ভালবাসার একটু স্পর্শ পেলেই হয়ে যান আনন্দ মাতাল। এখানেই তিনি এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, সবার মাঝেও এক অন্যসুরের, অন্য কণ্ঠস্বরের কবি।


ধ্বস্ত জটিল সময়ের রেখাচিত্রণে কবি-মন তার মনের চাপা ক্ষোভ যেখানে ব্যক্ত করেছেন, সেখানেও কবি-মনের এক সূক্ষ্ম জীবনবীক্ষণের নিচুস্বরে, আপাত শান্ত মিতভাষণের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়—

ফিরাবে বিমল চক্ষু, কোন্ দিকে ফিরাবে?

কার হাতে রক্ত নেই ?

তুমি খুব দুরের মৃত্তিকা থেকে অবেলায় 

স্বদেশে ফিরেছ, তুমি জেনে গেছ -

এমন সাবান কোনো কারখানায় প্রস্তুত হয় না,

যা সেই রক্তের দাগ মুছে দিতে পারে।


দুঃখ-বেদনা-যন্ত্রণায় কবির মন ছিন্নভিন্ন হলেও সময়সংকটকে তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন চিত্রণের ভঙ্গিতে। কখনো তাঁর মনের ক্ষোেভ শব্দের বারুদ নিয়ে ফেটে পড়েনি। বরং তিনি নিপুণ কায়দায় বারুদের গন্ধকে পৌঁছে দিয়েছেন মনস্তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণে পাঠকের অন্তরের গহনে।

প্রান্তরে জরায়ু-ভাঙা রক্তভ্রূণ,

শকুন! শকুন!


সমকাল চেতনা কবি নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় বেশ প্রখরভাবেই উপস্থিত হয়েছে। নিজ অভিজ্ঞতার দর্পণের আলোকে সে চেতনাবোধ কবিতায় এনেছে এক আশ্চর্য আন্তরিকতা। কবি নীরেন্দ্র এই আশ্চর্য আন্তরিকতার বশেই তাই রচনা করেন অনায়াসে ‘উলঙ্গ রাজার' মতোন একটি নিটোল কবিতা। কবিতাটি বেশ ব্যঞ্জনাবহুল। কবিতাটির শেষ স্তবের কটি পংক্তিতে ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে যুগসংকটের ছবি কবি স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি ‘রাজা’র প্রতীকী ব্যঞ্জনায় শক্তি মদমত্তায় স্ফীত অহংসর্বস্ব নেতাদের নগ্নতাকে তুলে ধরেছেন। 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়? এই শেষপংক্তিটির মাধ্যমে তিনি তথাকথিত প্রচলিত System-কে ধাক্কা দিয়ে চাটুকারীদের নির্লজ্জতার মুখোশটাকে একেবারে টেনে হিঁচড়ে দিয়েছেন। এই কবিতাটিতে ‘উলঙ্গ রাজা' অর্থাৎ নেতাদের তোষামোদকারীদের স্বরূপও তিনি নিপুণভাবে চিত্রিত করেছেন।


আবার কলকাতার যীশু' কবিতাটি কবি-মনের সমকালের বাস্তবচেতনাবোধ দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ধ্বস্ত, নষ্ট সময়ের হাত থেকে মুক্তিপাবার জন্য তাই খুঁজে চলেছেন সেই শিশুটিকে, যে সাহসী ও স্পষ্টবাদী। শিশুটি হল আসলে সচল ও নবীন মূল্যবোধের প্রতীক। মানুষের ক্রমাগত তোষামুদি, স্বার্থপরের স্থবির গতানুগতিকতার থেকে কবি-আত্মাকে একমাত্র মুক্তি দিতে পারে ওই শিশু। কবি যাকে খুঁজে চলেছেন।


“কবিতা : চিত্রিত ছায়া” গ্রন্থে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর শীর্ষক আলোচনায় বানিকবাবু কটি সুন্দর কথা বলেছেন, যা খুব অর্থবহ। তিনি বলেছেন—‘প্রচলিত ঈশ্বর সাধনায় নয়, ভিখিরি মায়ের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশুর মধ্যেই কবি কলকাতার যিশুকে দেখতে পেয়েছেন, যে শিশু টালমাটাল পায়ে জনতার আর্তনাদ, অসহিষ্ণু ড্রাইভারের দাঁতের ঘসটানির ভ্রূক্ষেপ অগ্রাহ্য করে মূর্ত মানবতার মতো বিশ্বকে দু'হাতে পাবার জন্যে মুহূর্তে চলমান জীবন থামিয়ে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এই শিশুর সরলতা ও মানবতাই কবির আকাঙ্ক্ষা।’ ‘কলঘরে চিলের কান্না’ কবিতায় তাই ধরা পড়ে সমকাল চেতনার ব্যথিত কবির গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস। দূর আকাশের এক উড়ন্ত চিল হঠাৎ ছাদে পড়ে যেতেই কবি তাকে কাকেদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কলঘরে তুলে এনে রাখেন। কলঘরে চিল বন্দী থাকার জন্য কাঁদে। কবি সে কান্না শুনে ভীষণ মনে আঘাত পান। কবি-কথাতেই যা ফুটে উঠেছে –

অমন ধারালো শুকনো বুকফাটা আর্তনাদ আমি

কখনো শুনিনি।

মনে হয়েছিল, যেন পাখি নয়, বিশ্ব চরাচর 

আজ রাত্রে ওই

কলঘরে অন্ধকারে বন্দী হয়ে চিৎকার করছে।


একটা কথা মনে রাখতে হবে, কল্পনা থেকে বাস্তব, বাস্তব থেকে কল্পনার জগতে নীরেন্দ্রনাথ যে বার বার দেখি যাত্রা করেছেন—তা কিন্তু মূলত মানুষকে কেন্দ্র করেই। সব মানুষের মধ্যে তিনি তো একজন মানুষই। তাঁর বাস্তবে যা কিছু ঘটছে তা তো মানুষকে কেন্দ্র করেই। জহর সেন মজুমদার তাঁর “বাংলা কবিতা : মেজাজ ও মনোবীজ' গ্রন্থে ‘নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : ধান খুটে খায় চারটে চড়ুই’ শীর্ষক আলোচনায় কটি সুন্দর কথা বলেছেন, ‘মানুষকে নিয়েই উদ্দীপ্ত তার কল্পনা। সময়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বা সময়ের মধ্যে ডুবে (প্যানফস্কির মতে যা ‘Organic Situation) তিনি মানুষময় ভাবনাকে ক্রমাগত প্রকাশ করেছেন। শিলার-লিখিত কাব্যদুতি গ্রহণ করে আমরা নীরেন্দ্রনাথের কাব্যচর্চার উদ্দেশ্যপথ নির্ধারণ করতে পারি ‘humanity is mans nature'; নিহিত মানবতার দিকে যাত্রা করতে গিয়ে নীরেন্দ্রনাথ দেখেছেন সীমাবদ্ধ মানুষের জখম চিহ্ন। সমাজের বিষাক্ত ঘা। মানবতার সংকট ও বিকৃতি।” এ কারণে নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় জীবনবীক্ষণের মধ্য দিয়ে অসহায়তা, বেদনাবোধ ও একাকীত্বের যন্ত্রণা উঠে এসেছে।


কবি নীরেন্দ্রনাথের ভয়ঙ্কর একাকীত্বের পরিচয় পাওয়া যায় 'আমি এবং একলা-বকুল’ কবিতাটিতে। একটি বকুলগাছের সঙ্গে নিজের একাকীত্বকে আবিষ্কার করেছেন তিনি। কবিতাটির শেষ কটি পংক্তিতে কবির একাকীত্ববোধের তীব্র ভাব লক্ষ্য করা যায়। আবার “উলঙ্গ রাজা” কাব্যগ্রন্থে কবি নীরেন্দ্রনাথ যখন বলেন আমাদের এ কথা—

এক-একটা লোকের মুখে পিস্তল উঁচিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে।

বলতে ইচ্ছে হয়

যা বলেছ, প্রত্যাহার করো। 

(‘বিগত জন্মের স্মৃতি')


তখন আমাদের বুঝতে বাকি থাকেনা, কবি নীরেন্দ্রনাথ বেদনায়, যন্ত্রণায়, অসহায়তা নিয়ে একাকীত্বের মধ্যে বেঁচে থাকতে চান না। আর চান না বলেই ‘লোকের মুখে পিস্তল উঁচিয়ে’ তিনি সব অন্ধকারের অবসান চান। চান মনের শাস্তি ও সুস্থতা। আনন্দপ্রেমিক কবি বলেই তিনি আশাবাদী।


তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “অন্ধকার বারান্দা”র ‘দেয়াল’ কবিতাটিতে করি অন্ধকারের দেয়াল ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসার ইচ্ছের কথা আমাদের ব্যক্ত করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, প্রথম থেকেই কবি নীরেন্দ্রর কবি-মন মুক্তিপিপাসু।

...অন্ধকারে আলো দিতে হলে

আরও কিছু দিতে হয়

প্রেম দিতে হয়।


এ কারণে এই কবিতাটিতে তিনি পরোক্ষণে আজকের জটিল সময়ের বৃত্তচ্যুত মানুষদের দিকে অভিযোগের তীর তুলতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। কবি-ভাষায় যা ব্যক্ত হয়েছে কোনো আড়াল না রেখে—

মানুষ। তোমার প্রেম ছিল।

তবুও, মানুষ তুমি কিছুই দিলে না

নিখিল সংসারে।


প্রকৃতির নিসর্গের ছবি তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায় হামেশাই উঠে এসেছে। প্রকৃতির নিসর্গরূপ কবি নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় রঙ-বর্ণ-রস নিয়ে কেমন উজ্জ্বল ভাবে উপস্থিত, কবি মনের চেতনায় যা কেবলই আনন্দ দান করে। একেবারে ফুরফুরে নির্মল আনন্দ।


প্রকৃতি নিসর্গকে কবি নীরেন্দ্র তাঁর কবিতায় বার বার এনেছেন কবি-অন্তরের সঙ্গে এক আনন্দ মিতালীর সম্পর্ক গড়তে। – কবি নীরেন্দ্রনাথ সংবেদনশীল এবং আশাবাদে বিশ্বাসী বলেই সুস্থতা ও যা কিছু সুন্দর তাই তাঁর কাম্য। এ কারণেই তিনি কবিতার কাছে যেমন দায়বদ্ধতা থাকে তেমনি তিনি আকাঙ্ক্ষা করেন কবিতায় হুবহু নিজেকে তুলে ধরার সত্য ভাষণ।


এই মমত্ববোধই হল শেষ কথা কবিতার কাছে, কবির কাছে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় এই ভালোবাসা ও মমত্ববোধ ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতার পংক্তিতে-পংক্তিতে। প্রকৃত অর্থেই তিনি আনন্দময়সত্তার অধিকারী এক মগ্নচৈতন্যের কবি ছিলেন বলেই তিনি ঝঞ্ছা সময়ের ঘূর্ণাবর্ত থেকে কখনো পালিয়ে যাননি। নানানভাবে দেশকাল সময়ের সঙ্গে সব মানুষ মানুষীর কাছে ছায়ার মতোন তার দৃষ্টি রেখে কাব্যমানসে আত্মসমীক্ষা ও আত্মজিজ্ঞাসার রসসিঞ্চনে গড়ে তুলেছেন তাঁর কবিতার ভুবন। যে ভুবন একাতই তাঁর নিজস্ব।