ভাবসম্মিলনের পদে বিদ্যাপতি

ভাবসম্মিলনের পদে বিদ্যাপতি


বৈষ্ণব কবিতায় রাধার বিরহ বেদনার আর্তি যতই থাক, কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর চিরবিচ্ছেদ ভক্ত বেশ্ববের পক্ষে অভাবনীয়, কারণ তা বৈষ্ণবতত্ত্ব বিরুদ্ধ। তাই তাঁদের কল্পনা করতে হয়েছে ভাবোল্লাস বা ভাব সন্মিলনের। এ অবশ্য শুধু ভক্ত বৈষ্ণবের ভাবনা নয়, কারণ এই পর্যায়টির পরিকল্পনার মধ্যেও গভীর শিল্পকলা-নিপুণতা দেখা যায়। কৃষ্ণ নেই, অসহনীয় এই সত্য মেনে নেওয়া সম্ভব নয় রাধার পক্ষে। তাই তিনি আত্মবিস্মৃত, কখনো বা কল্পিত মিলনে মেতে ওঠেন কৃষ্ণের সঙ্গে। সেই ভাব মিলনকে কবিরা যেভাবে অনুভাবে এবং ব্যভিচারী ভাবে বাস্তব করে তুলেছেন তা যথার্থই উচ্চস্তরের কবিকল্পনার নিদর্শন। তবে এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি বিদ্যাপতি। এই পর্যায়ে তাঁর কৃতিত্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পদ মধ্যে অভিব্যক্ত। ভাষার মাধ্যমে ভাষাতীতকে স্পর্শ করবার দুঃসাহস বিদ্যাপতির ছিল। তাই আপন লেখনীর গুণে তিনি আপন কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।


ভাব-সম্মিলন ও ভাবোল্লাসের পদে কবি বিদ্যাপতি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিদ্যাপতি পরমসুখে মিলনের রসাবেশ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে যেটুকু উৎকর্ষ তা বুদ্ধি-দীপ্তি, অর্থগৌরব, শব্দানিপুণতার দান। তবে রাধাকৃষ্ণের মিলন বর্ণনায় তাঁর কবি-শক্তি নিঃশেষ হয়নি। সেই প্রকৃত মিলনের মাধ্যমে তিনি আপনার শ্রেষ্ঠ পূজার উপাচার সমর্পণ করেননি। মিলনের পর বিরহ এসেছে, তারপর ভাব সম্মিলন। বিদ্যাপতি ভাব সম্মিলনের কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে সুখের কবি রূপে আখ্যাত করেছেন মিলনে নয় বিরহে, তাঁর কবিভাব চরমে উঠলেও এটুকু বলা যেতে পারে, বিদ্যাপতি জীবন থেকে সুখকে বিসর্জন দেননি। কিন্তু পরম সত্য যে অনাদি দুঃখ, তা তাঁর কাব্যের ভূষণমাত্র। অথবা এমনও বলা যায়, তিনি সুখেরও কবি, দুঃখেরও কবি। একই সঙ্গে সুখ দুঃখাতীত আনন্দের কবি, সুখের পর দুঃখ তারপর আনন্দ, বিদ্যাপতির কাব্যে মিলনের পর মাথুর তারপর ভাবসম্মিলন ভাবোল্লাস। এই আনন্দবাদ আমাদের দেশে উপনিষদের মতই প্রাচীন।


রবীন্দ্রনাথ একদা বলেছিলেন— “জগতের অপূর্ণতা যেমন পূর্ণতার বিপরীত নহে, কিন্তু তাহা যেমন পূর্ণতারই একটি প্রকাশ, তেমনই এই অপূর্ণতার নিত্য সহচর দুঃখ ও আনন্দের বিপরীত নহে। তাহা আনন্দের অঙ্গ অর্থাৎ দুঃখের পরিপূর্ণতা ও সার্থকতা দুঃখই নহে, তাহা আনন্দ রূপমমৃতং।” রবীন্দ্রনাথের এ উক্তির আলোকে বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলনের পদ আলোচনার অপেক্ষা রাখে। বিদ্যাপতির বহু বিখ্যাত ভাবসম্মিলনের পদ হল—

“আজু রজনী হাম     ভাগে পোহায়লু 

পেখলু পিয়ামুখচন্দা

জীবন যৌবন     সফল করি মানলু

দশ দিশ ভেল নিরদ্বন্দ্বা।।”


কী উল্লাস! আনন্দের একি অপরূপ প্রকাশ। এ কাব্যের রস আস্বাদনে কখনো বিলম্ব হবার নয়। এর রস একেবারে হৃদয়ে অবস্থিত। ভাষা, সুর, ছন্দ ভাবের সঙ্গ অভিন্ন সত্তায় সম্মিলিত হয়ে যে কাব্য দেহের সৃষ্টি করেছে তা বড়োই অপূর্ব। রাধিকা যে সুরে কথা বলেছেন, তা যেন প্রাণের গভীরতম প্রান্ত হতে উচ্ছ্বসিত। এ ভাষা, এ আনন্দোল্লাস সেই কবির যিনি বলতে পারেন, রস স্বরূপ আমার চেতনায় ধরা দিয়েছে, যাকে পেলে অম্লান আনন্দে বলতে পারে—

“সোহি কোকিল অব     লাখ লাখ উঠক,

লাখ উদয় করু চন্দা।”


গভীর দুঃখ বা বিরহের দহনেও বিদ্যাপতির রাধার দেহচেতনা স্তিমিত হয় না, মিলনের প্রত্যাশায় তা আরও উদগ্রীব হয়ে ওঠে, তাই কৃষ্ণ আগমনের প্রত্যাশায় তাঁর মনে হয়—‘জীবন যৌবন সফল করি মানলু, কিংবা “আজু মঝু দেহ ভেল দেহা।” কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বা সমাজবদ্ধতার জন্যই বিদ্যাপতির রাধার প্রেম স্বপ্নে এমন রক্ত মাংসের স্বতঃস্ফূর্ত সজীবতা প্রত্যক্ষিত হয়, জীবনকে সর্বাঙ্গে আলিঙ্গন করবার এমন প্রাণবন্ত মহিমা চোখে পড়ে

“কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। 

চির দিন মাধব মন্দির মোর।।”


চন্দ্রকিরণ তাঁকে যত দুঃখ দিয়েছে, প্রিয়ের মুখ দর্শনে তিনি ততটাই সুখ পেলেন। যদি প্রিয়ের পরিবর্তে কেউ তাঁকে আঁচল ভরে রত্ন দেয় তবু তিনি প্রিয়তমকে কখনো দূর দেশে পাঠাবেন না। কারণ—

“শীতের ওড়নী পিয়া গীরিষির বা। 

বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।”

হয়তো এ পদের তেমন কোনও গভীরতা নেই। তবে মহারত্বের চেয়ে কৃষ্ণের প্রেম যে মহার্ঘ তা এর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে। কিংবা—

“পিয়া যব আত্তব এমঝু গেহে।

মঙ্গল যতনু করব নিজদেহে।।”

পদখানি উৎকৃষ্টতার দাবী রাখে। স্বপ্নের মধ্য দিয়ে পরম প্রিয়তমকে যে কাছে পাওয়া, এর চেয়ে বড়ো সান্ত্বনার বাণী আর কোথায় আছে?


সর্বোপরি বলতে হয়, কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধার যে মনোবেদনা সেই মনোবেদনার মধ্যে কৃষ্ণকে রাধা আরও নিবিড় করে অনুভব করেছেন। এখানে তাঁর প্রথম মিলনের সলজ্জ আত্মপ্রকাশ নয়, অভিসারের দুঃসাহস নয়, মান-অভিমানের লীলা নয়, বিরহের সান্ত্বনাহীন বেদনা নয়, ভাব সম্মিলনেই পরিপূর্ণতা অর্জন করেছেন। অর্থাৎ বিদ্যাপতির রাধাকে কৃষ্ণ বিরহের সমস্ত ব্যথা সয়ে প্রেমের মূল্য দিতে হয়েছে। বিরহের পটভূমিকাতে তাই রাধার ভাবসম্মিলনের পদগুলি এত বেদনা মাধুরী মিশ্রিত করুণ ও কোমল। রাধা চির বিরহের অগমপারে নির্বাসিত। তবু তিনি বাসনা লোকে মিলনের উল্লাসকে তিল তিল করে জমিয়ে রেখেছেন। শয়ন মন্দিরে কৃষ্ণের আবির্ভাব হলে তিনি নিজ দেহটিকে মাঙ্গলিক সাজিয়ে প্রিয়কে অর্ঘ্য দেবেন, যখন প্রিয় মিলন রস চাইবেন, তখন রাধা—

“মুখ মোড়ি বিহসি বোলব নহি তবহি।”

অর্থাৎ মুচকি হেসে মুখ ফিরিয়ে বলবেন— না-না। এই মিলন আশঙ্কা দেহকে অবলম্বন করলেও এর দেহাতীত ব্যঞ্জনার আভাস দেয়। এখানেই ভাব সম্মিলন পদের বিশেষত্ব নিহিত।