বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর অবদান ও কৃতিত্ব | বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা সাহিত্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ-এর অবদান ও স্থান


ক্রুদ্ধ কুটিল জলোচ্ছ্বাসকে বশে এনে জলজ প্রাণী তুলে আনে যে মানব সম্প্রদায় তাদের নিয়ে দেশে বিদেশে সাহিত্যও রচিত হয়েছে অনেক। যেমন 'ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘গঙ্গা’ থেকে শুরু করে 'ইলিশমারির চর' ইত্যাদি। 'তিতাস একটি নদীর নাম' এই ধারারই একটি উজ্জ্বল এবং অভিনব রচনা।


পদ্মা নদীর মাঝির জীবনের সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে দুরত্ব ছিল, অদ্বৈত মল্লবর্মণের তা ছিল না। প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমশঃ মুছে আসা সেই জলজীবী মানুষদের মাঝখান থেকেই তিনি উঠে এসেছিলেন সাহিত্যের জগতে। সেই সরল স্বচ্ছ স্পর্শকাতর মানুষগুলির জীবনের বারমাস্যায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তাঁর জীবন। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দারিদ্র্য তিনি বহন করে নিয়ে এসেছিলেন সাহিত্য সাধনার জগতে। বাল্যে পিতৃমাতৃহীন, অকৃতদার, নিঃসঙ্গ এই মানুষটির ক্ষমতা যতটুকু ছিল, দায় ছিল তার অনেকগুণ বেশী। বহু কৃচ্ছসাধন এবং উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তিনি যা উপার্জন করতেন তার অধিকাংশই তিনি বিলিয়ে দিতেন দুঃস্থ পরিচিত জনের মধ্যে।


যতদূর জানা যায় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে অদ্বৈতবাবুর জন্ম। ওপার বাংলার মানুষ তিনি, দেশ বিভাগের অনেক আগেই জীবনের খরস্রোত সাঁতরে চলে এসেছিলেন এপারে, নতুন জীবিকার সন্ধানে। মেধাবী ছাত্র হয়েও উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হয়েছিল অদ্বৈতাবাবুকে ৷ কুমিল্লা কলেজ থেকে সরাসরি কলকাতায় এসে 'নবশক্তি’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহকারী হিসাবে। সাংবাদিক জীবনের হাতে খড়ি সেইখানেই। সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চারও সচেতন প্রয়াস শুরু হল। সেযুগের সাহিত্য তখনও লক্ষ্মীর কৃপা লাভ করেনি, আজকের দিনের মতো সচ্ছল দাক্ষিণ্য ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। যশই ছিল তখন একমাত্র পুরস্কার।


বিভিন্ন পত্রপত্রিকার অদ্বৈতবাবুর লেখা বেরোলেও, বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত এক পয়সার একটি গ্রন্থ সিরিজে তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। নবশক্তির পরে তিনি একে একে ‘আজাদ’, ‘মোহাম্মদী’, ‘যুগান্তর’ ঘুরে ‘দেশ’ পত্রিকায় এসে থিতু হয়েছেন, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশ্বভারতীর সঙ্গেও। শিক্ষকতার মতো বার্তাজীবিকাও সে যুগে ছিল সামান্য বেতনের দেশ-পত্রিকায় যোগদানের আগে পর্যন্ত তিনি আর্থিক দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারেননি‌ একেবারেই। স্বল্পভাষী স্বল্পহারী মানুষটির জীবন ছিল অত্যন্ত সাদাসিধে, জীবনযাপনের‌ উপকরণ এবং প্রয়োজন ছিল যৎসামান্য। কিন্তু অনাত্মীয় আশ্রিতের সংখ্যা সামান্য ছিল না। তাদের মুখ চেয়েই তাঁকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত। অবসর সময়টুকু ঝুঁদ হয়ে থাকতেন বইয়ের মধ্যে। তিনি ছিলেন অসামান্য পড়ুয়া। বিলাসিতাও ছিল এই একটিই, বই কেনা।


যে উপন্যাসটির জন্যে তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন, এবং অদ্যবধি স্মরণীয় হয়ে আছেন সেটি তাঁর প্রথম উপন্যাস নয়। সাময়িক পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যায় তাঁর একাধিক উপন্যাস ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। শোনা যায়, কিন্তু সেগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে এখন নিঁখোজ। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন 'তিতাস একটি নদীর নাম'।


মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে কয়েক কিস্তি বেরিয়েই তিতাস বন্ধ হয়ে যায় এক দুঃখজনক ঘটনায়। উপন্যাসের পান্ডুলিপিটি তাঁর হাত থেকে হারিয়ে যায়। এ সেই ধরনের লেখা, প্রায় কবিতার মতো স্বতঃস্ফূর্ত রচনা যা ফিরে লেখা সম্ভব নয়। তাই এই মর্মান্তিক আঘাতে মন একেবারে ভেঙে গেল তার। তার ওপরে এল দেশভাগের আঘাত তিতাসবাসী অনেক মালো পরিবার হাল-পাল খোয়ানো নৌকার মতো এপারে চলে এল। লেখকের বোঝা আরও বাড়ল। এদিকে কতিপয় বন্ধু ও গুণগ্রাহী পাঠক-পাঠিকার উপর্যুপরি তাগিদে ভগ্নদেহে এবং মনে অদ্বৈতবাবু খোয়া যাওয়া উপন্যাসটিকে আবার নতুন করে লেখার জন্যে কলম ধরলেন। সময় তখন ফুরিয়ে আসছে, দু-জায়গায় কাজ এবং অর্থকরী লেখার বাইরে অবকাশ তখন সামান্যই। শ্রান্ত দেহে গভীর রাতে যখন কলম ধরতেন, মনে হত চির চেনা তিতাসের সঙ্গে এ তাঁর সুরের আলাপ, সারাদিনের সমস্ত জ্বালা যেন জুড়িয়ে দিচ্ছে। শরীর ভেঙে পড়েছিল অনেকদিন থেকেই। এই অতি পরিশ্রমে রোগ ধরল, ক্ষয়রোগ। উপন্যাসের সমস্ত পান্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়ে তিনি হাসপাতালে চলে গেলেন। আর ফিরলেন না। ১৬ই এপ্রিল ১৯৫১ তাঁর মৃত্যু হল। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে এই প্রভূত প্রতিশ্রুতিবান লেখক বাংলা সাহিত্য থেকে বিদায় নিলেন।