চৈতন্য জীবনী কাব্য অবলম্বনে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ লেখো।

চৈতন্য জীবনী কাব্য


ভূমিকা : বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে অপূর্ব জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈতন্যের জীবন অবলম্বন করেই আত্মপ্রকাশ করে। মানবিক মূল্য অর্থাৎ মানবজীবন সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে এই জাতীয় জীবনী-কাব্য রচনা সম্ভব নয়। শ্রীচৈতন্যদেব এই মূল্য বোধ জাগিয়েছিলেন বলেই তাঁর জীবনী দিয়েই বাংলা কাব্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করে এই জাতীয় বাস্তব জীবন নির্ভর কাহিনি কাব্য গড়ে ওঠে। শ্রীচৈতন্য জীবনী-কাব্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে দেবতার একচেটিয়া আধিপত্যের স্থানে শুরু হল মানব-মহিমা কীৰ্ত্তন।


মঙ্গলকাব্যের আদর্শ :

চৈতন্য চরিতকারগণ যে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনীকাব্য রচনা করেছেন তা পৌরাণিক মহিমা যুক্ত। অলৌকিক ঘটনা বর্ণন অনেকটা মধ্যযুগীয় বাংলা মঙ্গলকাব্য জাতীয় রচনা। কিছু কিছু জীবনী কাব্য তো স্পষ্টতই ‘মঙ্গল’ নাম যুক্ত— যথা, চৈতন্য ভাগবত (পূর্বনাম চৈতন্য মঙ্গল ?) জ্ঞানানন্দ ও লোচনদাসের চৈতন্য মঙ্গল, চূড়ামণিদাসের গৌরাঙ্গ বিজয় ইত্যাদি। এগুলি মঙ্গলকাব্যের রীতিতে রচিত—গীতের উদ্দেশ্যে পাচঁলীর ঢঙে লেখা গেয় বা শ্রব্য কাব্য। একমাত্র চৈতন্য চরিতামৃতই পাঠের উদ্দেশ্যে পরিচ্ছদাদিতে বিভক্ত, অন্যগুলি লীলা পর্যায় অনুসারে খণ্ডে বিভক্ত—চৈতন্য ভাগবতও আদিতে সেই রূপ ছিল বলে মনে হয়।


গৌরাঙ্গ পদ :

এক হিসেবে শ্রীচৈতন্য জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত হয় শ্রীচৈতন্যের জীবনকালে। তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্ত কীর্তন-সহচর পরিকর বৃন্দের মধ্যে অনেকেই তাঁর জীবনের ঘটনা ও তাঁর রূপগুণ নিয়ে ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক’ পদ লিখতে শুরু করেন। নবদ্বীপ লীলায় গৌরাঙ্গদেবের অন্যতম সঙ্গী নরহরি সরকারই বোধ হয় প্রথম গৌরপদ রচনা করেন। তিনি বলেছেন—“গৌরলীলা দরশনে। ইচ্ছা বড় হয় মনে। ভাষায় লিখিয়া রাখি সব।” তাঁর এই ইচ্ছা থেকে গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের জন্ম। এরপর বাসুঘোষ, রামানন্দ বসু, শিবানন্দ সেন, বংশীবদন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাব্যে চৈতন্য জীবনকথা পদাকারে বিধৃত হয়েছে। খণ্ড বিচ্ছিন্ন কখনও আবার পালাকারে গ্রথিত এই সব পদে শ্রীচৈতন্যের বাস্তব জীবনের বহু তথ্য ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। সেদিক থেকে দেখলে এই গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদের কিছু ঐতিহাসিক মূল্য আছে।


সংস্কৃতে রচিত গ্রন্থ :

সংস্কৃতে শ্রীচৈতন্যের জীবন-বৃত্ত নিয়ে যে কখানি গ্রন্থ রচিত হয় তারমধ্যে চৈতন্য সহপাঠী ও পরিকর মুরারিগুপ্তের কচড়া বা 'শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য চরিতামৃতম’ কবিকর্ণপুরের ‘চৈতন্য চরিতামৃত মহাকাব্যম ও চৈতন্য চন্দ্রোদয় নাটকম এবং 'শ্রী গৌর গনোদ্দেশ দীপিকা চৈতন্য চরিত কথা রূপে সমধিক প্রসিদ্ধ। পরবর্তী কালে বাঙালি চরিত কারগণ এই সবপদ ও গ্রন্থ অবলম্বনে নিজ নিজ গুরুর নির্দেশ ক্রমে বাংলায় শ্রীচৈতন্য জীবনীকাব্য রচনা করেন।


বৃন্দাবন দাশের চৈতন্য ভাগবত :

বাংলা ভাষায় শ্রীচৈতন্যের জীবনী-কাব্য প্রথম রচনা করেন শ্রীচৈতন্য লীলার ব্যাস বৃন্দাবনদাস। তাঁর চৈতন্য ভাগবত যার পূর্বনাম চৈতন্য মঙ্গল বলা হয়, আসলে চৈতন্য চরিত এবং চৈতন্য কীর্তন রূপেই কবির নিজের বর্ণনায় উল্লিখিত হয়েছে। গ্রন্থটি শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যে নিত্যানন্দের আদেশে লেখা হয়েছিল। শ্রীচৈতন্যকে শ্রীকৃষ্ণের এবং নিত্যানন্দকে বলরামের অবতার বলে স্বীকার করে সেই ধারণা প্রচার ও এই দুইজনের ঈশ্বরত্ন প্রতিষ্ঠার জন্যই বৃন্দাবনদাস ব্যাসদেব রচিত ভাগবতের অনুসরণে চৈতন্য লীলার বর্ণনা করেছেন। গ্রন্থটি তিন খণ্ডে বিভক্ত, আদিখণ্ডে—শ্রীগৌরাঙ্গের 'বিদ্যার বিলাস'—তথা তাঁর জন্ম থেকে গয়াগমন পর্যন্ত জীবনের বৃত্তান্ত বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। মধ্য খণ্ডে— কীর্তন প্রকাশ অর্থাৎ গয়া প্রত্যাগত কৃষ্ণপ্রেমাকুল গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত জীবন লীলা বর্ণনার উপর লেখক বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। অন্ত্যখণ্ডটি কিঞ্চিৎ ক্ষুদ্র— এই খণ্ডের দশটি অধ্যায় চৈতন্যের সন্ন্যাসোত্তর চব্বিশ বৎসর জীবনের নীলাচল বাসের কথাই সংক্ষেপে বলা হয়েছে। লেখক অন্ত্যখণ্ডটি সংক্ষেপে সেরেছিলেন বলে কাব্যপাঠে চৈতন্যজীবন কথা সম্পর্কে কেমন অসম্পূর্ণতা বোধ আমাদের মনে জাগে ৷


লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল:

লোচন দাস মূলত পদকর্তা ছিলেন। তাঁর ‘চৈতন্য মঙ্গল’ পাণ্ডিত্য বর্জিত মঙ্গলকাব্য জাতীয় লৌকিক আখ্যান কাব্য। তিনি গৌর নাগরীয় ভাবের কবি–তাই তাঁর কাব্যে প্রকৃত চৈতন্য অপেক্ষা কল্পনার গৌরসুন্দরই অধিক মাত্রায় উপস্থাপিত। তাঁর কাব্যে চৈতন্য ঐতিহাসিক চরিত্র না হয়ে কল্পলোকের চৈতন্য হয়ে উঠেছে। তবে, এই কাব্যে বিরহিণী বিষ্ণুপ্রিয়ার দুঃখ আমাদের বিহ্বল করে তোলে। (সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বরাত্রে বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে চৈতন্যের মিলন দৃশ্য বর্ণনায় লোচনদাস সত্য ইতিহাস প্রকাশ করেননি। সমগ্র কাব্যে লেখক ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠা অপেক্ষা নিজের কবিত্ব শক্তির অধিক পরিচয় দিয়েছেন)।


জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল :

জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল কাব্য ও জনসাধারণের জন্য লেখা এবং প্রধানত গীত হওয়ার উদ্দেশ্যেই রচিত। গ্রন্থমধ্যে তাই নানা রাগ রাগিনীর উল্লেখ আছে । কবিত্ব শক্তিতে জয়ানন্দ লোচন দাস অপেক্ষা কিঞিৎ ন্যূন হলেও ঐতিহাসিক তথ্য পরিবেশনে তিনি বাস্তবতা বোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সব তথ্যই হয়তো প্রমাণিক নয়—কিন্তু চমকপ্রদ। ভক্ত সমাজে তাঁর গ্রন্থ চৈতন্য ভাগবতের ন্যায় জনপ্রিয় না হলেও চৈতন্য চরিত্রাঙ্কনে তিনি কিছুটা কৃতিত্বে দাবী করতে পারেন।)


গোবিন্দ কর্মকারের কড়চা :

গোবিন্দ কর্মকারের কড়চা একখানি চৈতন্য জীবনী কাব্য। এই গ্রন্থখানির প্রমাণিকতা নিয়ে পন্ডিত মহলে সন্দেহ থাকলেও প্রভুর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় গোবিন্দ কর্মকারের বাস্তব জ্ঞানের সঙ্গে সহজ কবিত্ব শক্তির যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ড. নির্মল নারায়ণ গুপ্ত এই গ্রন্থের প্রামাণিকতা প্রসঙ্গে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন— “গোবিন্দ-কর্মকারের কড়চা প্রামাণিকতা বিচার।” যদি ড. গুপ্তের অনুমান সত্য হয়, তবে এই চরিত্রগ্রন্থটি বাংলা সংস্কৃত ওড়িয়া চৈতন্য চরিত্র গ্রন্থগুলির মধ্যে শুধু সম্মানিত হবে না, চৈতন্যের বাস্তব জীবনীরূপেও স্বীকৃত হবে।


চূড়ামণিদাসের গৌরাঙ্গ বিষয়:

জগন্নাথ মিশ্র যে বাল-গোপালের উপাসক ছিলেন এবং তাঁর গৃহে নিত্য শালগ্রাম শিলা পূজা পেতেন তার বিবরণ চূড়ামণি দাস দিয়েছেন। গৌরাঙ্গের জন্মস্থান আজ গবেষণার বিষয় হয়ে উঠলেও জগন্নাথ মিশ্রের গৃহের বর্ণনা ‘গৌরাঙ্গ বিজয়ে’ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাই— “দক্ষিণ ও পূর্ব দ্বারী সুন্দর শ্রীঘরে। পূর্বদ্বারে অভ্যন্তরে সুরম্য চত্বরে। দক্ষিণ কপাট অভ্যস্তরে আসি। ময়ূরের সাথ ডাকে বালক বিলাসী।” এতে চূড়ামণি দাসও নিজের পরিচয় দিয়েছেন—নবদ্বীপে কোন্ কোন্ পরিবারের সঙ্গে নিত্যানন্দের পরিবারের সম্পর্ক ছিল তার পরিচয় পাই। তবে তাঁর কাব্য অসম্পূর্ণ হওয়ায় সমগ্র চৈতন্য চরিত উদ্ধার এই কাব্য থেকে সম্ভব নয়। চূড়ামণিদাসের ‘গৌরাঙ্গ বিজয়' যদিও কাব্য হিসাবে অসম্পূর্ণ, তবু এই কাব্যে গৌরাঙ্গের প্রথম জীবনের অনেক নির্ভর যোগ্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়।


কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য চরিতামৃত :

কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত' চৈতন্য জীবনী কাব্যগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। তাঁর এই গ্রন্থের প্রেরণাদাতা বৃন্দাবনের ছয় গোস্বামী। তাঁর সাক্ষাৎ গুরু তিনজন রূপ, সনাতন ও শ্রীজীব। শ্রীচৈতন্যের প্রায় আটচল্লিশ বছরের জীবনকথা তাঁর গ্রন্থে তিন খণ্ডে বাষটিটি পরিচ্ছেদে কাল ও ঘটনার ক্রমানুসারে সুসজ্জিত করে চৈতন্য-তত্ত্ব-কথা গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমাদের শুনিয়েছেন। জীবনের শেষ ভাগে চৌদ্দ বছর ধরে পরিশ্রম করে তিনি এই মহাগ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থ রচনার সূচনা ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দ। কিন্তু সমাপ্তি ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দ—চৈতন্য তিরোভাবের ঊনআশি বছর পরে—তখন কৃষ্ণদাসের নিজের বয়সও হয়েছিল পচাঁত্তর বছর। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর এই শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে চৈতন্য আবির্ভাবের বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ কারণ নির্দেশ করেছেন গ্রন্থ সূচনাতেই—যদিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন গ্রন্থের আদিলীলার চতুর্থ পরিচ্ছেদে। মধ্য লীলার অষ্টম পরিচ্ছেদে রায় রামানন্দের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীচৈতন্যের মুখে সাধ্য সাধন তত্ত্বের বিস্তারিত বিশ্লেষণ, ১৯শ থেকে ২৪শ পরিচ্ছেদে রূপ সনাতনকে শিক্ষা দেওয়ার ছলে গৌড়ীয় বৈষ্ণুব ধর্ম ও দর্শনের আলোচনা, অন্ত্যলীলার বিংশ পরিচ্ছেদে প্রভুর শিক্ষা শ্লোকাষ্টকে বৈশ্ব্ববের সাধনা ও সিদ্ধির লক্ষণ এবং সিদ্ধির নিষ্ঠার স্বরূপ—এই সব অতি প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত কৃষ্ণদাস অতীব সুকৌশলে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। (“ড. বিমান বিহারী মজুমদার মন্তব্য করেছেন– “শ্রীচৈতন্যের ভাবকে আস্বাদন করে যদি সাধন পথে অগ্রসর হইতে হয় তাহা হইলে শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত ছাড়া আর গতি নাই।” তবে কাব্য সৃষ্টিতে কৃষ্ণদাসের বক্তব্য হয়তো এই রকম ছিল—যা ঘটেছে তা সত্য, কিন্তু যা ঘটেনি কিন্তু ঘটতে পারতো বা ঘটা উচিত ছিল তা সত্যতর। (not true but true than facts)। এর প্রমাণ মেলে তখন যখন দেখি লেখক প্রায় পঁচাত্তরখানি আকর গ্রন্থথেকে ৬৬২টি শ্লোক উদ্ধার করে তাঁর গ্রন্থে প্রকাশিত বক্তব্যের পোষকতা করেছেন।)


সর্বোপরি শ্রীচৈতন্যের ‘ভেদভুলানো' 'প্রাণজাগানো ব্যক্তিত্ব, কবিরাজ গোস্বামী অতি সুন্দরভাবেই করেছেন। মহাপ্রভুর প্রেম বিগলিত লাবণ্য কোমল চরিত্রের অন্তরালে ‘বজ্রাদপি কঠোর’ মূর্তিটিকে প্রত্যক্ষ করেছেন—কাজীদলন, ছোট হরিদাস বর্জন প্রভৃতি ঘটনা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। সর্বোপরি চৈতন্যদেব কেমন করে সব মানুষকে ভালো বেসেছিলেন এবং কোন গুণে যুগ ও জাতির ভালোবাসা লাভ করে ছিলেন কৃষ্ণদাস সুন্দরভাবে তা তাঁর কাব্যে দেখাতে পেরেছেন। তাই তাঁর কাব্য বৈষ্ণুব সমাজে এত সমাদৃত। গ্রন্থখানি শুধু বৈব সাহিত্যের নয় মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের গৌরব।