শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে জীবন বোধ | শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে সমাজ সচেতনতা | শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে লৌকিক উপাদান

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। জন-জীবনকে নিয়েই সমাজ। জীবন ও সমাজই হল সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়। কোনও সাহিত্য জীবন ও সমাজ ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। তাই সাহিত্যই নির্দেশ করে সমকালীন সমাজ ও জীবনকে, যে সাহিত্যে এই লৌকিক ভাব যত বেশি প্রকট সে সাহিত্য তত বেশি বাস্তবোচিত এবং চিরন্তনতার দাবীদার। মধ্য বাংলার আদি নিদর্শন ‘শ্রীকৃষ্ণ কীতন' কাব্যটিতে সেই বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। পণ্ডিতগণ বড়ু চণ্ডীদাসের কাব্যখানিকে শতাব্দীর ফসল রূপে চিহ্নিত করে থাকেন। নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে, রাধা কৃষ্ণের প্রেম লীলার মধ্য দিয়ে যে সমাজ ও লৌকিকতা দৃষ্ট হয় তা সেই সময়ের ছবি মাত্র। দেশ-কাল পাত্রকে অতিক্রম করে সাম্প্রতিক কালের বাঙালি সমাজ কতকটা পরিবর্তিত হয়েছে। যদিও রাধাকৃষ্মকে অবলম্বন করে বহু কবি বহু সময়ে বহু কাব্য রচনা করেছেন তবুও বড়ু চন্ডীদাসের কাব্য খানিকে কোনও নির্দিষ্ট স্থানের চিত্র রূপে না দেখে সমগ্র বঙ্গদেশের আঙিনায় তাকে স্থাপন করি তাহলে দেখবো এর গুরুত্ব কতটা।


‘দান খণ্ডে’ কৃষ্ণ রাধাকে জোর করে পাওয়ার তাগিদে যখন বারো বৎসরের জন্য রাধার কাছে দান চেয়ে বসে তখন রাধা সকাতরে বলেছে-

“এহে, সকল বত্রসে মোর এগার বরিষে। 

বারহ বরিষের দান চাহ মোরে কিসে।।"


এই বাক্যেই পরিস্ফুট এগারো বয়সেই তার বিবাহ হয়েছে। এবং গ্রন্থের প্রথম থেকেই জানতে পারি এই এগারো বছর বয়স থেকেই রাধা স্বামী আইহনের ঘর করে আসছে। অর্থাৎ তখন যে বঙ্গদেশে বাল্যবিবাহ গৌরীদান প্রথা প্রচলন ছিল তা নিঃসংসয়ে বলা যায় এবং স্বামী শাশুড়ী সখীকে নিয়ে একটা পারিবারিক পরিমণ্ডল যে ছিল তারও প্রমাণ মেলে। রাধার মাথায় দুধের পশরা নিয়ে মথুরা যাওয়ায় নির্দেশ করে। জীবিকার তাড়নায় তখনকার সময়ে বাড়ীর মেয়ে বৌরাও ঘরের বাইরে পা বাড়াতো।


সমাজে বিভিন্ন জাতিগত অস্তিত্ব তখনও প্রকট ছিল। যেমন—“মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পনী”, কিংবা, “কান্দে কুরুআ লআঁ তেলী আগে জাত্র।” এর মধ্যে দিয়ে কুমার ও তেলী জাতীয় সমাজের প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলে, তাছাড়া নাপিত, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শুদ্র ইত্যাদির সন্ধান মেলে। আর রাধিকার নিত্য দুধের পশরা নিয়ে যাওয়াকেই তো গোপজাতীর স্বরূপকে সহজেই ফুটিয়ে তোলে।


শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যখানি যদিও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা মূলক, তবুও এর মধ্যে একটা সুন্দর পারিবারিক চিত্র বিধৃত আছে। কুলবধূ, রাধিকার সংসার স্বামী আইহন ও শাশুড়ীকে নিয়ে। ঘর সংসার সমস্ত সামলে তাকে যেতে হয় মথুরাতে বিকিকিনি করতে। তবে সর্বদা শাশুড়ী চায় না ঘরের বধূ বাইরে বেরুক। স্বামীরও আপত্তি। কিন্তু পড়শীরা শাসায় আইহন ও “শাশুড়ীকে”—

আপন আপন বহু হাটক পাঠাইবে। 

তোয়ারর ঘরত অন্ন পানি না খাইব।।”


এই দলের পৌরোহিত্য করেন বড়ায়ি, কারণ, দৌহিত্র কৃষ্ণ অপেক্ষায় আছে রাধা দরশনে, রাধাকে যেনতেন প্রকারেণ ঘরের বাইরে নিয়ে যেতেই হবে। অতঃপর পড়শীর কথাতে ভয় পেয়ে শাশুড়ী কাল বিলম্ব না করে রাধাকে অনুমতি দেয় মথুরার হাটে যেতে। নাহলে কেউ আইহনের বাড়ীতে জল-অন্ন স্পর্শ করবে না। এই বক্তব্যে পরিস্ফূট তখনকার পাড়া প্রতিবেশিদের মধ্যে বিরোধ বাধলে একঘরে করার প্রথা ছিল।


বংশী খণ্ডে গৃহবধূ রাধিকার রন্ধনশালার একটি পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে। পূর্বের বিরূপতা ত্যাগ করে কৃষ্ণ কর্তৃক বলপূর্বক কয়েকবার সম্ভোগের পর রাধিকা যখন কৃষ্ণ অনুরাগে উন্মুখ তখন বেজে উঠলো বাঁশীর সুর—রাধা বলেই ফেললো—“বাঁশী শবদেঁ মো আউলাইলো রান্ধন।” প্রতিদিন সে যত্নের দ্বারা রান্না করে স্বামী শাশুড়ীকে খেতে দেয় আজ সব যেন বাঁশীর শব্দে গোলমাল হয়ে গেল। ‘রান্ধনের জুতী' সে আজ খুঁজে পায় না। পটল ভাজতে গিয়ে ভুল করে কাঁচা সুপুরী ঘিয়ে ভাজতে যায়, হাঁড়িতে জল না দিয়ে চাল চড়ায়, অম্বলে ঝাল এবং নিম তেতোতে লেবুর রস নিংড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি পরিবারের রন্ধন শালার একটা পরিপূর্ণ চিত্র ফুটে উঠেছে, যা বাস্তবোচিত।


গ্রামীণ সংস্কার বিধিনিষেধ ইংরেজীতে যাকে বলে Taboo তাও শ্রীকৃষ্মকীর্তনের অনেক স্থানে পাওয়া যায়। যেমন একস্থানে পাই—

“কমন আসুভ ক্ষণে বাঢ়ায়িলোঁ পা।

হাঁছী জিঠা তাত কহো নাহি দিল বাধা।”


যাত্রাকালে যে শুভ-অশুভের সংস্কার মানা হোত তাও এই পংক্তির মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়। কিংবা, বংশী খণ্ডের এই পদটি গ্রাম্য সংস্কারের হাতিয়ার রূপে চিহ্নিত করা যায়—

“শুন কলসী লই সখী আগে জাত্র।

বাঞর শিআল মোর ডালিনে জাত্র…”


অধুনাকালে গ্রাম বাংলায় মানুষ জনের মধ্যে তিক্ত বচসা শুরু হলে যেমন অশ্লীলতার সীমা মাঝে মধ্যে ছাড়িয়ে যায় অনুরূপ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধা ও কৃষ্ণের কটুক্তির মধ্য দিয়ে তার আভাস দেয়। দান খণ্ডে কৃষ্ণের হাত থেকে রক্ষা পেতে যখন মামী ও ভাগ্নের সম্পর্ক টানে তখন কৃষ্ণ নির্লজ্জের মতো বলে—‘নহসি মাউলানী রাধা সম্বন্ধে শালী। এই বাক্যে একা রাধিকা অভিশাপ দেয়—'দুঈ আখি আউ পড়ুক তার কন্দ। বিনিময়ে কৃষ্ণ তাকে ‘পামরী ছেনারী নারী' বলে গাল দিলে রাধা কৃষ্ণের বাপ তুলে বলে—‘বাঁন্ধিতে না পারে তোয়ার বাপে। এই কটূক্তির মধ্য দিয়েই তো আসল গ্রাম্য স্বরূপই ফুটে উঠেছে।


মৃত্যুর পর ভগবান যে বিচার করে পাপীর উপযুক্ত শাস্তি বিধান করেন এবং পুণ্যে পুরস্কার মেলে এই পদটি তার পরিচয়বাহী—

“পুণ্য কইলে স্বর্গ জাইত্র নানা উপভোগ পাইত্র

পাপেঁ হত্র নরকের ফল।”


জনসাধারণের মনে মন্ত্র তন্ত্রের বিশ্বাস ছিল প্রকট। বাণখণ্ডেই দেখি কৃষ্ণ মূর্ছিতা রাধাকে ঝাড় ফুঁকের দ্বারা জাগিয়ে তুলেছে। আবার বংশী খণ্ডে 'নিন্দাগুলী’ মন্ত্রে বড়ায়ি কৃষ্ণকে ঘুম পাড়ালে রাধিকা কৃষ্ণের বাঁশি চুরি করে।


স্ত্রীলোকের অলঙ্কার ও প্রসাধন চর্চারও কিছু কিছু পরিচয় মেলে। রাধা সম্পর্কে যেমন কবির বক্তব্য— “হৃদয়ে কাণ্ডুলী গজমুকুতার হার।” “অঙ্গদ ভুজ যুগলে।” রাধার কটিদেশে–“কনক কিঙ্কিনী” ইত্যাদির দ্বারা প্রমাণ করে অলঙ্কারেরও প্রাচুর্য্য ছিল।


শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন বৈক্ষ্ণব সাহিত্যরূপে আখ্যা পেলেও বাংলাদেশে তখন যে শক্তিপূজার বেশ প্রচলন ছিল তা স্বরূপ মেলে রাধা বিরহ অংশে, রাধা যখন কৃষ্ণের জন্য উন্মাদিনী প্রায় বড়াইকে বারে বারে শুধায় মথুরা থেকে কৃষ্ণ এনে দিতে তখন বড়াই তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানায়—

“বড় যতন করিয়া     চণ্ডীরে পূজা মানিআঁ

তবে তার পাইবে দরশনে।।”

শুধু চণ্ডীই কেন শীতলা, ষষ্ঠী, কালী প্রভৃতি শক্তিময়ীর উল্লেখ আছে।


এছাড়া শুভ তিথি, বার, ক্ষণ সম্পর্কে মানুষের ছিল সজাগ দৃষ্টি। নারী হত্যাই যে তখনকার সময়ে শ্রেষ্ঠ পাপ কর্ম বলে বিবেচিত বাণখণ্ডে “শতেক ব্রষ্মবধ নহে যার তুল।” বাক্যের মধ্যে প্রকটিত। সর্বোপরি 'রাজকর আদায়ের প্রথা' শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সময়ে বেশ প্রচলন ছিল তা কৃশ্বের দানী সেজে পথের মাঝে বসে থাকার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয়।


তাই বলতে হয় গ্রাম্য পরিবেশে দুই অনভিজ্ঞ নর-নারীর রাগ-অনুরাগ, মিলন বিরহের কাব্য হয়েও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' তৎকালীন সমাজের আপন আধারে এমনভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা সত্যই বিস্ময়কর। এককথায় একে মধ্যযুগীয় সমাজের দলিল রূপে চিহ্নিত করা যায়। সমালোচক বলেছেন—“শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই বঙ্গদেশ ও বাঙালির মনের ছাপটি নিঃসন্ধিন্ধভাবে অনুভব করা যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেই বাঙালি ভাবচেতনা ও জীবন রসবোধের প্রথম উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়াছে বলা চলে।”