বাংলার লেখা চৈতন্য জীবনী সংক্রান্ত গ্রন্থগুলি উল্লেখ করো। এই ধারায় শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোন্‌টি এবং কেন সে বিষয়ে তোমার অভিমত দাও।

চৈতন্য জীবনী সংক্রান্ত গ্রন্থ


বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যের মত জ্যোতিষ্ককে নিয়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল জীবনী সাহিত্যের ধারা। মূলত এই ধারা ছিল নতুন। কারণ সে সময় সাহিত্যে দেব দেবীর মাহাত্ম বণিত হত সেই সময়ে ব্যক্তি কেন্দ্রিক জীবনী ধারা প্রবাহিত থাকল। তাঁকে কেন্দ্র করেই নানা সাহিত্য গড়ে উঠেছিল।


চৈতন্য জীবনী কাব্য সমূহ :

(1) বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত, (2) লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল (3) জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল (4) কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি।


বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত:

বাংলাভাষায় রচিত প্রথম চৈতন্য বিষয়ক কাব্য হল বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ । এটি ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামেও পরিচিত ছিল। ভাগবতে যেমন কৃষ্ণলীলা বর্ণিত আছে চৈতন্য ভাগবতেও চৈতন্যলীলা বর্ণনা করা আছে। উভয় কাব্যের মধ্যে বহু অলৌলিক বিষয় সংযুক্ত ছিল।


বৃন্দাবন দাসের কবি পরিচয়ঃ

এই কাব্যে কবি বৃন্দাবন দাসের আত্মপরিচয় অতি সংক্ষিপ্ত। তাঁর যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায় তাতেও তাঁর মায়ের নামই প্রাধান্য পেয়েছে। কবি-জননী নারায়ণী ছিলেন শ্রীবাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী এবং বাল্যবিধবা। কবির দীক্ষাগুরু ছিলেন শ্রীচৈতন্যের নবদ্বীপ লীলার নিবিড় সহচর শ্রীনিত্যানন্দ।


বৃন্দাবন দাসের রচনাকাল :

জননীর প্রেরণায় দীক্ষাগুরু নিত্যানন্দের প্রেরণায় তিনি কাব্যটি রচনা করেন। নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য এবং অন্যান্য পার্ষদের কাছ থেকে বৃন্দাবন দাস কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন। কবির জন্মকালের মত তাঁর কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ্ব আছে। কবির জন্মকাল সম্ভবত ১৫১৯ খ্রীঃ বা তারও কাছাকাছি সময়ে এবং কাব্য রচনাকাল সম্ভবতঃ ১৫৪২ খ্রীঃ।


চৈতন্যভাগবতের বিষয়বস্তু :

চৈতন্যভাগবত আদি, মধ্য, অস্ত—এই তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। শ্রীমদ্ভাগবতের কৃষ্ণলীলার মতো এতে চৈতন্য লীলা বর্ণিত হয়েছে। শ্রীচৈতন্যের বাল্যলীলা, সন্ন্যাসপূর্ব জীবনের বর্ণনায় কল্পনা ও অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি। বৃন্দাবন দাসের কাব্যের মূল উৎস ছিল নিত্যানন্দ, তাঁর বাল্যসঙ্গী। নীলাচল লীলায় তিনি সঙ্গে ছিলেন না বলে কবিকে মুরারি গুপ্তের কড়চার উপর নির্ভর করতে হয়।


চৈতন্যভাগবতের ঐতিহাসিকতা :

বৃন্দাবন দাসের কাব্যটি সেকালে এবং একালে সমাদর লাভের মূল কারণ হল এর তথ্যপূর্ণ ঐতিহাসিকতা। এই কাব্যে অলৌকিক ঘটনা যেমন রয়েছে তার পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যও বর্তমান। এই কারণে একে মধ্যযুগের ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য দলিল নামে অভিহিত করা যায়। এটিতে তৎকালীন নবদ্বীপের ঐশ্বর্যখ্যাতি, বুদ্ধিজীবী ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সম্প্রদায়ের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের বাংলা ও বাঙালির সামাজিক ও নৈতিক জীবনের একখানি অন্যতম প্রামাণিক গ্রন্থ এটি।


সর্বশেষ একথা বলতে হয়, সহজ সরল ঘটনা বর্ণনায় এবং কল্পনার সুদূরাভিসারে গ্রন্থখানি অসাধারণ। প্রাঞ্জল ভাষা, প্রধানতঃ পয়ার, কোথাও কোথাও ত্রিপদী রয়েছে। শ্রীচৈতন্যের আধ্যাত্মিক মহিমায় গভীর বিশ্বাসী হয়েও তিনি মানবিক আবেদনের প্রতি উদাসীন থাকেননি এখানেই তাঁর সার্থকতা।