বঙ্কিমচন্দ্র চন্দ্রশেখরের শৈবালিনী-প্রতাপ চরিত্র তিনটির মধ্য দিয়ে নরনারীর জটিল ও বৈচিত্র্যময় সম্পর্কে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন– আলোচনা করো।

‘চন্দ্রশেখর' উপন্যাসমধ্যে প্রতাপ ও শৈবালিনী ছিল বাল্য হতে প্রেমিক প্রেমিকা। কিন্তু, প্রতাপ অস্তকরণে জেনেছিলেন– শৈবালিনীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে না। কারণ, শৈবালিনী তাঁর জ্ঞাতি কন্যা। কিন্তু শৈবালিনী জানতেন প্রতাপের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হবে। যখন প্রতাপের নিকট ক্রমেই অবগত হল– ইহজীবনে প্রতাপের সঙ্গে তাঁর বিবাহ অসম্ভব, তখন শৈবালিনী বুঝলেন, প্রতাপ ভিন্ন তাঁর ইহজীবনে সুখ নেই। কাজেই দুজনে গভীর পরামর্শের পর একসাথে নদীতে ডুবে মরতে গেলেন– কিন্তু তাদের মৃত্যু হল না। কিন্তু সেদিন যদি তাঁদের মৃত্যু হত, তাহলে শৈবালিনীর জীবনের সমস্যারও সমাধান সেইখানেই হত। চন্দ্রশেখর তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন, তিনি প্রতাপকে বাঁচালেন। এবং শৈবালিনীকে বিবাহ করে তিনি শৈশবের সহচর সহচরীকে পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন করলেন। অদর্শনের ফলে শৈবালিনী বাল্যপ্রণয় বিস্মৃত হল। কিন্তু চন্দ্রশেখর উদ্যোক্ত হয়ে যখন প্রতিবেশী কন্যা রূপসীর সঙ্গে প্রতাপের বিবাহ ঘটালেন তখন তাঁর রূপরাশি আবার নূতন করে শৈবালিনীকে আকৃষ্ট করলো। প্রতাপকে পাবার আশায় শৈবালিনী মরিয়া হয়ে ফক্টরের সঙ্গে ‘গৃহত্যাগী’ হলেন। পরিশেষে বিরুদ্ধ ঘটনাস্রোতের আবর্তে পড়ে প্রতাপকে ভুলতে প্রতিশ্রুত হয়ে গোপনে তাঁর নিকট হতে পলায়ন করলে, দুর্যোগময়ী রজনীতে অরণ্যসঙ্কুল পার্বত্য প্রবেশে যখন শৈবালিনীর জীবন সংশয় হল, তখন রমানন্দ স্বামীর নির্দেশে চন্দ্রশেখর অলক্ষ্যে তাঁর অনুসরণ করে তাঁর প্রাণ রক্ষা করলেন এবং চন্দ্রশেখরকে অবলম্বন করে শৈবালিনী নবজীবন লাভ করলেন। প্রতাপ যখন জানলেন তিনি বেঁচে থাকতে ইহজীবনে শৈবালিনীর সুখ নেই, তখন তিনি স্বেচ্ছায় আত্মবিসর্জন দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে। তিনি প্রমাণ করে গেলেন তাঁর ভালোবাসার নাম– আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।


বালিকা শৈবালিনী সপ্রতিভ, চঞ্চল, কৌতুকদীপ্ত। প্রতাপের প্রতি তাঁর আকর্ষণ Love at the first sight এই অনুভূতি প্রথম থেকেই শৈবালিনীর ক্ষেত্রে ‘মর্মে তার বিজড়িত মূল'। কিন্তু শৈশর-কৈশোর-যৌবনের বিকাশের সঙ্গে ধীরে ধীরে এই অনুভূতির ক্রমপ্রসার ঘটেছে। তারপর একদিন তা তাঁর সমগ্র অস্তিত্বকে ব্যাপ্তি করেছে, প্রতাপকে কেন্দ্র করে তাঁর হৃদয় কামনা বিকশিত হয়েছে। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্কসূত্রে উভয়ের বন্ধন গড়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। তাই উভয়েই সংকল্প করেছেন গঙ্গায় আত্মবিসর্জন করবেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা গেল প্রতাপ ডুবেছেন, শৈবালিনী ডুবতে পারেননি। লেখক শৈবালিনীর এই সময়ের মানসিক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলেছেন- “সেই সময়ে শৈবালিনীর ভয় হইল। মনে ভাবিল– কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না। শৈবালিনী ডুবিল না, ফিরিল।” এ থেকে প্রমাণিত শৈবালিনী নিজেকে ভালোবাসেন, অপরের প্রতি ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে আত্মবিসর্জনের শক্তি তাঁর নেই। এরপর প্রতাপকে নিমজ্জিত অবস্থা হতে রক্ষা করার সূত্রে শৈবালিনীর সঙ্গে চন্দ্রশেখরের বিবাহ হয়ে যায়। দীর্ঘ আট বৎসর তাঁদের দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত হয়েছে বটে কিন্তু প্রতাপকে তিনি ভুলতে পারেননি। শৈবালিনীর প্রতিবেশিনী রূপসী প্রতাপের স্ত্রী। সেই সূত্রে পিতৃগৃহে যাতায়াতের কারণে প্রতাপের সঙ্গে শৈবালিনীর সাক্ষাৎ হয়ে যায়। অনাসক্ত চন্দ্রশেখরের প্রতি শৈবালিনীর মন স্থায়ী হয় না। তিনি প্রতাপকে পাওয়ার কামনায় একদিন ফষ্টরের সঙ্গে গৃহত্যাগিনী হন। প্রতাপের তৎপরতায় তিনি উদ্ধার হলেও প্রতাপের নিকট এটুকু বুঝলেন, ইহজীবনে আর তাঁদের মিলিত হবার সম্ভাবনা নেই। শৈবালিনী নিজেই প্রতাপের সান্নিধ্য ত্যাগের জন্য আপনা থেকেই অরণ্য মাঝে বিসর্জিতা হলেন। রমানন্দ স্বামীর দ্বারা কঠোর তপশ্চর্যার পর স্বামী চন্দ্রশেখরের সান্নিধ্য লাভ করেন। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে বেদগ্রামে চলে এলেও প্রতাপের চিন্তা থেকে তিনি অব্যহতি পেলেন না। অবশেষে নিজের সুখী জীবনের জন্য প্রতাপকে তিনি সোচ্চার কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন— প্রতাপ জীবিত থাকতে তাঁর ইহজীবনে কোনো সুখ নেই। অর্থাৎ কামনাবাসনাময়ী নারীরূপে, নিজ আত্মসুখ চরিতার্থতার জন্য তিনি প্রতাপকে একরকম মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন। প্রেমাম্পদের সঙ্গে তিনি ডুবে মরতে ভয় পান। তিনিই পরবর্তী জীবনে সুখ পাননি প্রেমাস্পদের দুঃশ্চিন্তায়। এই দ্বৈতভাবই শৈবালিনী চরিত্রকে সম্পূর্ণতা দান করেছে।


প্রতাপ শৈবালিনীকে উন্মাদের মতো ভালোবাসতেন। বাল্যপ্রণয়িনী শৈবালিনীর সঙ্গে বিবাহ হবে না জেনে তিনি ইহজীবনের পরিসমাপ্তি সূচিত করতে একসাথে ডুবে মরতে গিয়েছিলেন। তিনি ডুবেও ছিলেন, কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য মরা তার হল না। চন্দ্রশেখরের দাক্ষিণ্যে তিনি বেঁচে গেলেন। তবে শৈবালিনীকে তিনি ভুলতে চেষ্টা করলেন। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে শৈবালিনীর বিবাহ হয়ে যাবার পর চন্দ্রশেখরের জ্ঞাতিকন্যা রূপসীকে বিবাহ করে প্রতাপ সুখী হয়েছিলেন। তবে প্রতাপ ও রূপসীর দাম্পত্য জীবন কেমন কেটেছিল সে সম্পর্কে লেখক আমাদের তেমন কিছু জানাননি। দেখতে দেখতে আট বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। একদিন শ্যালিকা সুন্দরী মারফৎ প্রতাপ জানলেন লরেন্স ফষ্টর কর্তৃক শৈবালিনী অপহূতা হয়েছেন। প্রতাপের মধ্যে জেগে উঠল পূর্ব প্রণয়, ভালোবাসার স্মৃতি। তিনি জীবনপণ তুচ্ছ করে শৈবালিনীকে উদ্ধার করলেন এবং শৈবালিনীকে বুঝিয়ে দিলেন প্রতাপের জন্য শৈবালিনীর এ চিত্তচাঞ্চল্য অনর্থক। শৈবালিনীও প্রতিশ্রুত হলেন ইহজীবনে তিনি প্রতাপকে ভুলতে সচেষ্ট হবেন। কিন্তু ইংরাজদের দ্বারা ধৃত হয়ে প্রতাপ যখন শৈবালিনীর দাক্ষিণ্যে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলেন তখন গঙ্গাবক্ষে সত্তরণ কালে প্রতাপের ঘটল চিত্তবিভ্রম। তিনি বাল্যের সেই প্রিয় নাম 'শৈ-ব-লি-নী' ডাকে শৈবালিনীকে চমৎকৃত করেছিলেন। শৈবালিনীও আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন প্রতাপের ডাকে। ক্ষণিকের জন্য তাঁদের চিত্তবিভ্রম ঘটলে সামাজিক বিধিনিষেধের কথা তাদের মনে পড়তেই তারা দুজন দুজনকে ভুলবেন এমন প্রতিশ্রুত হলেন। এরপর শৈবালিনী রাজদরবারে ইংরাজ কর্তৃক আক্রান্ত হলে প্রতাপ সসৈন্যে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি শৈবালিনীর মুখে শুনলেন– “আমি সুখী হইব না, তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই—" তখন ইহজীবনে শৈবালিনীকে সুখী করতে প্রতাপ রণক্ষেত্রে গিয়ে জীবনকে উৎসর্গ করলেন। কোনো কামনাবাসনা আসক্তির দ্বারা আপ্লুত হয়ে নয়, তিনি তাঁর ভালোবাসাকে সমাযোগ মর্যাদা দিতে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন।


চন্দ্রশেখর ছিলেন জ্ঞান তাপস, ব্রথচারী, শাস্ত্রাধ্যায়নে তৎপর। ভেবেছিলেন ইহজীবনে তিনি সংসারী হবেন না। কিন্তু অকস্মাৎ মাতৃবিয়োগের জন্য তাঁর বিবাহ জরুরী হয়ে উঠলো। তবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি রূপসী মেয়েকে বিবাহ করবেন না, কারণ মোহগ্রস্ত হওয়ার ভয়। তবে শৈবালিনীকে দেখার পর তার সে ধারণা ভ্রান্ততার পর্যবসিত হয়। শৈবালিনী রূপে চন্দ্রশেখর মোহগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। শৈবালিনীর রূপে তিনি যতই মোহগ্রস্থ হোন না কেন তাঁর নিরাসক্ত চিত্তে শৈবালিনী কোনো রেখাপাত করতে পারলো না। কাজেই চন্দ্রশেখরের মতো সুপুরুষকে স্বামীরূপে পেয়েও শৈবালিনী অতৃপ্ত হৃদয়ে পুনঃ প্রতাপের ধ্যান করতে থাকলেন। একদা চন্দ্রশেখর জ্যোতির্বিদ্যা গণনার জন্য মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেছিলেন। সেই অবসরে লরেন্স ফক্টর কর্তৃক শৈবালিনী অপহ্তা হন। বাড়ি ফিরে শৈবালিনীকে না পেয়ে চন্দ্রশেখর উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। একে একে নিজের সাংসারিক দ্রব্যাদি প্রতিবেশীদের বিলিয়ে দেন। পরে শাস্ত্রগ্রন্থগুলি একত্রিত করে তাতে অগ্নিসংযোগ করে সবার অলক্ষ্যে রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগী হন। কঠোর ব্রহ্মচর্য পালনে বিরত হন। শৈবালিনীর জন্য তাঁর যে এই কঠোর ব্রত, তা বলাই বাহুল্য। তিনি শৈবালিনীর বিপৎকালে সারাক্ষণ অলক্ষ্য থেকে অনুসরণ করেছিলেন। তারপর শৈবালিনীর কঠোর তপশ্চর্যার পর রমানন্দ স্বামী যখন তাঁকে নির্দেশ দিলেন শৈবালিনীকে নিয়ে বেদগ্রামে ফিরে সংসারী হতে, তখন চন্দ্রশেখর জানিয়ে দিলেন– ইহজীবনে তিনি আর সুখী হবেন না। তবে অনুমান করা চলে, প্রতাপের মৃত্যুর পর তারা বোধ করি সুখী হয়েছিলেন।