বাঙলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন কোথায় পাওয়া যায় উল্লেখ করে প্রাচীন বাঙলা ভাষার লক্ষণগুলি নির্দেশ কর।

প্রাচীন বাঙলা ভাষার লক্ষণ


বর্তমান শতকের গােড়ার দিকে মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবার থেকে কিছু প্রাচীন পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে হাজার বছরের পুরাণ ঙলা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে প্রকাশ করেন। পরবর্তীকালে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী মনীষিগণ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেন যে উক্ত বৌদ্ধগানগুলির ভাষা প্রাচীন বাঙলা, যদিচ দোহার ভাষা অবহট্ঠ। বৌদ্ধগানগুলি সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধসাধকদের সাধনভজন-সংক্রান্ত বিষয়-অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। কিন্তু এই সাঙ্কেতিক পদগুলি সাধারণতঃ 'চর্যাপদ' নামে পরিচিত হলেও সম্ভবতঃ এদের প্রকৃত নাম ছিল 'চর্যাগীতি। এই চর্যাগীতিগুলি যারা রচনা করেছিলেন, তাদের জীবৎকাল ছিল খ্রীঃ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, হয়তাে বা এদের মধ্যে কেউ আরাে পূর্বেই বর্তমান ছিলেন। প্রাচীন বাঙলায় রচিত চর্যাপদই একমাত্র গ্রন্থ যাকে অবলম্বন করে তার ভাষাতাত্ত্বিক লক্ষণসমূহ বিচার করা চলে।


চর্যাপদ ছাড়াও প্রাচীন বাঙলার নিদর্শন পাওয়া যায়, এমন কিছু কিছু উপাদানের নাম উল্লেখ করা চলে—কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিক আলােচনার পক্ষে এদের কোনটিই যথেষ্ট নয়। দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত 'মানসােল্লাস' বা 'অভিলাষার্থ চিন্তামণি' নামক গ্রন্থের কোন কোন লােকসঙ্গীত প্রাচীন বাঙলায় রচিত। 'প্রাকৃতপৈঙ্গল' নামক ছন্দগ্রন্থে, 'সদুক্তিকর্ণামৃত' নামে প্রকীর্ণ কবিতার সঙ্কলনগ্রন্থে, ‘অমরকোষে'র সর্বানন্দ-কৃত ‘টীকাসর্বস্ব' নামক টীকায়, হেমচন্দ্র রচিত 'দেশী নামমালা' নামক গ্রন্থে এবং প্রাচীন তাম্রশাসনে কিছু কিছু প্রাচীন বাঙলা শব্দের সন্ধান লাভ করা যায়। টীকাসর্বস্ব গ্রন্থে প্রাপ্ত প্রাচীন বাঙলা শব্দেঅম্বাড় (আমড়া), উআরি (কাছারি বাড়ি), কালজা (কলিজা), খিরিসা, চিড়া, টের, পগার, বাদিয়া, মাল, হাতইড়া প্রভৃতি। প্রাচীন তাম্রশাসন বা ভূমি-দানপত্রে প্রাচীন কিছু গ্রাম নামের ও বাঙলা শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রাম নামের মধ্যেঅস্বয়িল্লা, বাল্লহিট্রা, বেতজ্ড প্রভৃতি এবং বাঙলা শব্দের মধ্যে— আঢ়া, খিল, জোল, বরজ প্রভৃতি।


বিভিন্ন সূত্রে কিছু উপাদান পাওয়া গেলেও প্রাচীন বাঙলা ভাষার লক্ষণ নির্ণয় করবার জন্য আমাদের পক্ষে একমাত্র গ্রহণযােগ্য গ্রন্থ 'চর্যাপদ'। প্রাচীন বাঙলার ধ্বনিগত, রূপগত এবং বাক্যগত—এই ত্রিবিধ লক্ষণ একমাত্র চর্যাপদেই লভ্য। কাজেই চর্যাপদের ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আমরা প্রাচীন বা আদিযুগের বাঙলা ভাষারই যথার্থ পরিচয় লাভ করবাে।


ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সাধারণ লক্ষণগুলি প্রাচীন বাঙলা ভাষাতেও উপস্থিত ছিল। প্রাকৃতের যুগ্ম ব্যঞ্জন প্রাচীন বাঙলায় একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয় এবং তৎপূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরের পরিপূরক দীর্ঘীকরণ (compensatory lengthening) ঘটে। যথা- জন্ম>জন্ম>জাম, ধর্ম>ধম্ম>ধাম; দর্পণ>দর্পণ>দাপন। অবশ্য কখন কখন যুগ্ম ব্যঞ্জনও বর্তমান ছিল, যেমন—'মিচ্ছা' এবং 'মিছা' চর্যাপদে এই দ্বিবিধ রূপই পাওয়া যায়। স্বরমধ্যবর্তী একক অল্পপ্রাণ ব্যঞ্জন লােপের ফলে উদ্বৃত্তস্বর কখনও বর্তমান রয়েছে (যেমন-সকল>সঅল), কখনও লোপ পেয়েছে (ছাড়িঅ>ছাড়ি), কখনাে একস্বরে পরিণত হয়েছে (অন্ধআর>অন্ধার), কখনও বা শুতিধ্বনির আগম প্রভৃতি ঘটেছে (নিকটে>নিঅডি>নিয়ড্ডি)। শব্দের আদিতে 'য'-প্রায়শঃ 'জ'- ধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল (জাই, জায়); 'ন' এবং ‘ণ’-র উচ্চারণে পার্থক্য বিলুপ্তি হয়েছিল (নাবীণাবী), শিধ্বনির বানানে যথেচ্ছাচার থেকে অনুমিত হয় যে তখন 'শ'-র উচ্চারণই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (ষহজে/সহজে, শূন/সুন) প্রভৃতি।


শ্বাসাঘাত রীতিতে বাঙলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আদিযুগে দেখা দিতে আরম্ভ করেছিল, তাই বাঙলায় আদ্যক্ষর অনেক সময়ই দীর্ঘ হতাে (অলাে/আলাে, অকট/আকট)। অবশ্য 'আ'-কারের আর একটা সম্ভাব্য কারণ এই হতে পারে যে, ‘অ'-কারের যে বিবৃত উচ্চারণ অর্থাৎ 'হ্রস্ব আ' সংস্কৃতে প্রচলিত ছিল, তা হয়তাে প্রাচীন বাঙলাতেও বর্তমান ছিল। এছাড়া তৎকালে বাঙলায় হ্রস্ব-দীর্ঘ উচ্চারণ-পার্থক্যও প্রায় লোপ পেয়েছিল। তাই বানানে দেখা যায় নির্বিচারত্ব (দিসই/দীসই, শবরি/সবরী) প্রভৃতি।


রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যঃ চর্যাপদের রূপতত্ত্ব-বিচারে বাঙলার স্বরূপ-লক্ষণ স্পষ্টতরভাবে প্রতীয়মান হয়। নাম শব্দে ষষ্ঠী বিভক্তির চিহ্ন ‘র’-এর’ (হরিণার, রুখের); কচিৎ 'ক' বিভক্তিও দেখা যায় (ছান্দক বান্দ)। কর্ম-সম্প্রদায়ের বিভক্তি প্রধানতঃ '-রে' এবং কচিৎ 'ক' বা ‘কে’ (তােহােরে, ঠাকুরক)। অধিকরণ কারকে ‘ত' বিভক্তি বাঙলার নিজস্ব (টালত, সামত), অবশ্য ‘এ’ বিভক্তিও রয়েছে (ঘরে)। করণ কারকে প্রধান বিভক্তি '-তে' এবং 'তে' (সুখ দুঃখতে)। কর্তৃকারকে ‘-এ,-এ’ (কাহ্নে গাইউ), অপাদানে 'এ' (জামে কাম); অধিকরণ কারকে 'ই,-হি' বিভক্তিও বর্তমান ছিল (নিয়ড্ডি,-হিঅহি)। বিভিন্ন কারকে বিভক্তিহীনতাও চর্যাপদে অপ্রাপ্য নয় (সরহ ভণই গুরু পুচ্ছি জান)। এই বিভক্তিচিহ্গুলির অনেকগুলিই বাঙলার নিজস্ব, অপরাপর সহােদরা-স্থানীয় ভাষাতেও এগুলি অপ্রাপ্য।


বাঙলা ভাষার আদিযুগেই অনুসর্গের ব্যবহার দেখা দিয়েছিল (তােএ সম, তুই বিনু); অনুসর্গ অসমাপিকার সাহায্যেও প্রকাশিত হতাে (দিঢ় করিঅ)।


বাঙলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অতীতকালে 'ইল' এবং ভবিষ্যৎকালে 'ইব' আদিযুগেই সূচিত হয়েছিল (রুদ্ধেলা, জাইবে)। 'ইআ'-যুক্ত অসমাপিকা বাঙলা ভাষার আদি যুগেই দেখা দিয়েছিল (আখি বুজিঅ); 'ইলে, -অন্তে'-যুক্ত অসমাপিকার ব্যবহারও এই যুগেই শুরু হয়েছিল (সাঙ্কমত চঢ়িলে, চিন্তা চিন্ততে)।


আদি যুগে বিশেষ্য-অনুযায়ী ক্রিয়ার ও লিঙ্গভেদ হতাে (লাগেলি আগে); বহুবচন বােঝানাের জন্য বহুত্ববাচক শব্দ বা সংখ্যা শব্দ ব্যবহৃত হতাে (পারগামি লাগে, পঞ্চবি ডাল)।


ক্রিয়াপদের একবচনে ও বহুবচনে পৃথক রূপ থাকলেও ব্যবহারে কোন কড়াকড়ি ছিল না। প্রথম পুরুষে বহুবচনের পদ সম্ভবতঃ সন্ত্রমে ব্যবহৃত হতাে, পুরুষ-ভেদে ক্রিয়া-বিভক্তির পার্থক্য আদি যুগে বর্তমান ছিল।


প্রাচীন বাঙলায় কাল ছিল তিনটি বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ। নিত্যবৃত্ত অতীত কখনাে উদ্ভূত হয়নি। যৌগিক কালের দৃষ্টান্ত চর্যাপদে পাওয়া না গেলেও যৌগিক ক্রিয়াপদের ব্যবহার পাওয়া যায় (গুনিয়া লেহঁ, উঠি গেল)। তিন কালেই কর্ম-ভাববাচ্যের বহুল ব্যবহার বর্তমান ছিল (খুর নদীস, মই দিবি পিরিচ্ছা)।


পদগত বৈশিষ্ট্যঃ চর্যাপদের তৎসম শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা প্রাকৃত অবহটঠ অপেক্ষা বেশি ছিল। সংস্কৃত বানান বজায় রাখবার দিকে চর্যাকারদের দৃষ্টি ছিল অধিকতর সজাগ। তাই উচ্চারণগত পার্থক্য না থাকা-সত্ত্বেও তারা প্রয়ােজন মতাে 'ন' ও 'ণ' এবং 'শ' 'ষ' বা 'স' ব্যবহার করেছেন। তৎসম শব্দের পাশাপাশি তারা অকৃপণভাবেই অর্ধ-তৎসম শব্দও ব্যবহার করেছেন। চর্যায় ব্যবহৃত প্রবচনগুলাে নিশ্চিতভাবেই বাঙলার ঐতিহ্যবাহী—‘অপণা মাসে হরিণা বৈরী, হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী' প্রভৃতি।