বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙলা সাহিত্যে যুগের বৈশিষ্ট্য | বাঙলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাব

বঙ্কিমচন্দ্রের বাঙলা সাহিত্যে যুগের বৈশিষ্ট্য প্রভাব


বঙ্কিমচন্দ্র যুগস্রষ্টা ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক; যুগসৃষ্টির দুর্লভ প্রতিভা নিয়েই তিনি জন্মেছিলেন। তার প্রতিভার বিপুল ঐশ্বর্যে তিনি বাঙলা উপন্যাসকে যে সমৃদ্ধি দিয়ে গেলেন, তার তুলনা হয় না। তার আগেও বাঙলা সাহিত্য জগতে উপন্যাস রচনার যে স্বল্প প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিল তা উপন্যাসের সৃষ্টি ও কল্পনাকে খুব বেশি সঞ্জীবিত করতে পারে নি; উপন্যাসের উজ্জ্বল দিগন্ত প্রকাশিত হল বঙ্কিমচন্দ্রের যুগন্ধর প্রতিভার প্রাণস্পর্শে। বাঙালী ঔপন্যাসিকদের মানসলােকে উপন্যাস-সৃষ্টির যে বাসনা সংগােপনে লুকিয়ে ছিল, তা বঙ্কিম-উপন্যাসের সঞ্জীবনী মন্ত্র অল্পদিনের মধ্যেই উজ্জীবিত হয়ে উঠল। বঙ্কিমচন্দ্র একটা সুগভীর জীবনবােধ ও তার কল্পনার বিশালতা দিয়ে যে উপন্যাসগুলাে রচনা করলেন, তা বাঙালী লেখকদের উপন্যাসের স্বরূপ লক্ষণটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বাঙলা সাহিত্যে যা ছিল না, তারই একটা সত্যকার রূপ প্রতিষ্ঠিত হল। উপন্যাসের ভাষা সৃষ্টিতেও বঙ্কিমচন্দ্র অগ্রণী। জীবন-সমস্যার বিশ্লেষণের সঙ্গে নিজস্ব জীবনদৃষ্টির মায়া-রং মিশিয়ে সাহিত্যলােকে যা সৃষ্টি হবে, তার ভাষা কিরুপ হওয়া উচিত তাও নির্ধারণ করে দিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।


বিদ্যাসাগরের ভাষার আদর্শটাকে তিনি প্রথম জীবনে গ্রহণ করেছিলেন বটে, কিন্তু তার মধ্যে এমন একটা রসমধুর স্বচ্ছ প্রবাহ বইয়ে দিলেন যা বঙ্কিমচন্দ্রের নিজস্ব। ব্ণনার সাবলীলতা ও মিতভাষণের সংকেতধর্মিতায় তাঁর সৃষ্টি হল অপূর্ব। নতুন ভাষারূপের সৌধ নির্মিত হল, বাঙলা সাহিত্যলােকের প্রতিটি কক্ষেই যার বিস্ময় ও সৃষ্টিমাধুর্যের অপরূপত্ব। বাঙলাদেশে রেনেসাঁসের যুগে নতুন মানবরসের সঙ্গে জেগে উঠল গভীরতম জীবন-জিজ্ঞাসা, এই জীবন-জিজ্ঞাসারই সৃষ্টিরূপ দেখা দিল উপন্যাসে। এটাই সেদিনকার অন্যতম যুগ-বৈশিষ্ট্য। বঙ্কিমচন্দ্র তাই বাঙলা সাহিত্যে উপন্যাসের প্রথম ও সার্থক যুগস্রষ্টা, আর এই যুগসৃষ্টির সঙ্গে তার প্রভাব সঞ্চার করল বহু হৃদয়ে একটা সৃষ্টিলীলার রসপ্রেরণা।


বঙ্কিমচন্দ্রের এই সৃষ্টিপ্রেরণা ও জীবন-জিজ্ঞাসার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনায় আত্মনিয়ােগ করলেন। সকলের সৃষ্টিই যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে উঠল তা নয়, কিন্তু সেই যুগের সৃষ্টিকর্মের ঐতিহ্যে তাদেরও একটা মর্যাদার আসন আছে। উনিশ শতকের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে বঙ্কিমের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন তার অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, দামােদর মুখােপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার প্রভৃতি। আরও অনেক ঔপন্যাসিক উপন্যাস লিখেছিলেন, কিন্তু তাদের প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল না বলে বাঙলা সাহিত্যের পাঠক পাঠিকাদের মনে আজ তাদের স্মৃতিটুকু মুছে গিয়েছে।


বঙ্কিম-উপন্যাসের প্রধানতঃ দুটো ধারা। একটা ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রােমান্স সৃষ্টির ধারা, অন্যটা সামাজিক উপন্যাসের ধারা। এই দুটো ধারাকেই অনুসরণ করে তারা তাদের সৃষ্টিকর্মে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। কেউ কেউ বা দুটো ধারাকেই সৃষ্টি-কুশলতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত তাদের মধ্যে অগ্রণী। তবে এটা স্বীকার্য যে, বঙ্কিমচন্দ্রের রােমান্স রসসৃষ্টিকে একেবারে বাদ দিয়ে বড় একটা কেউই উপন্যাস রচনা করতে পারেন নি। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসেও যে রােমান্টিক কল্পনার প্রশ্রয় আছে, তা সেই যুগের শক্তিধর ঔপন্যাসিক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পূর্ণ পরিহার করে চলেছিলেন। এখানেই তার বৈশিষ্ট্য। গার্হস্থ্য জীবনের প্রাত্যহিকতার মধ্যে একটা অশ্রুসজল করুণ কাহিনীই তাঁর উপজীব্য, করুণার বর্ণবিলাস একেবারে নেই। কিন্তু করুণার একটু গভীরতর স্পর্শ না থাকলে জীবন-জিজ্ঞাসার গভীরতার দিক কোনােমতে আসতে পারে নি। তাই তারকনাথের ‘স্বর্ণলতা'য় গভীর কোনাে জীবন-জিজ্ঞাসার প্রকাশ নেই। সেইজন্য পরবর্তী যুগে এই উপন্যাসের কোনাে সুদৃুরপ্রসারী প্রভাবও স্বীকৃত হয় না। তবে রমেশচন্দ্রের মধ্যে এই একই প্রকার রােমান্স-ব্যঞ্জনাহীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্রয় দেখা যায়। রমেশচন্দ্র বঙ্কিমের দুটি ধারাকেই অনুবর্তন করেছেন এবং রােমান্স- রসাশ্রিত প্রণয় কাহিনী সৃষ্টিতে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ঐতিহাসিক পটভূমিকা তাঁর অনেক উপন্যাসেরই অঙ্গসৌষ্ঠব দিয়েছে। সামাজিক উপন্যাস রচনার পথে যে সমস্ত ঔপন্যাসিক পদক্ষেপ করেছেন তারা বঙ্কিমের অনুসরণেই সমাজসংস্কারমূলক ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বঙ্কিমের সৃষ্টিতে সমাজজিজ্ঞাসা জীবনদৃষ্টির গভীরতা নিয়ে একটা অপরূপ শিল্পকর্মে পরিণতি লাভ করেছে, তা তার অনুবর্তী ঔপন্যাসিকদের কোন গ্রন্থেই দেখা যায় না।


বঙ্কিমের এই দুটো ধারাকেই অতিক্রম করে উপন্যাস রচনা করতে চেয়েছিলেন প্রতাপচন্দ্র ঘােষ। তাঁর বঙ্গাধিপ পরাজয় দুই খণ্ডে বিভক্ত এবং বিপুলাকার ঐতিহাসিক উপন্যাস। প্রতাপাদিত্যের জীবনকাহিনী এই উপন্যাসের উপজীব্য। লেখক ছিলেন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক; বঙ্কিমের রােমান্টিক কল্পনাকে উপন্যাস-রচনার ক্ষেত্রে একেবারেই গ্রহণ করেন নি। কেবল তথ্যমূলক বিশ্বস্ততা রক্ষা করতে গিয়ে কাহিনীকার উপন্যাসের শিল্পরূপকে একেবারে মাটি করে দিয়েছেন। কাজেই যে প্রচেষ্টা নিয়ােজিত হয়েছিল বন্কিম-প্রভাবকে অতিক্রম করে নতুন বৈশিষ্ট্য দেখাবার জন্যে, তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেল।


বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের গঠন কৌশলে ও চরিত্র চিত্রণের বিশ্লেষণ-ভঙ্গিতে যে-শিল্পমাধুর্য সঞ্চার করেছিলেন, তার পরবর্তী যুগে ঔপন্যাসিকেরা সেই রীতিকেই, অনুসরণ করে চললেন। তাঁরই অনুসরণে কাহিনী চয়নের ক্ষেত্রে সমাজ-সমস্যার সঙ্গে জীবন-জিজ্ঞাসাকে মিশিয়ে কাহিনীর মধ্যে যেমন জটিলতা সৃষ্টির রীতিকে তারা গ্রহণ করলেন, তেমনি সংলাপের মধ্য দিয়ে চরিত্র-বিশ্লেষণের পদ্ধতিকে উপন্যাসের বিশিষ্ট গুণ বলেও স্বীকার করে নিলেন। এটা শুধু উনিশ শতকের নয়, বিংশ শতকেও ঠিক তাই হয়েছে। উপন্যাস সৃষ্টির ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র অপরাজেয়।


ব্যঙ্গরসাশ্রিত উপন্যাস ও গল্প রচনার ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল উনিশ শতকেই এবং তা হয়েছিল বঙ্কিম-প্রতিভার স্পর্শ না পেয়েই। যােগেন্দ্রনাথ বসু, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যে এই ধারাটার সূচনা করলেন তাতে তাদের নিজস্ব প্রতিভাই কাজ করে গেছে। ইন্দ্রনাথের 'কল্পতরু' বঙ্কিমচন্দ্রের 'মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ নামে ব্যঙ্গ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার আগেই বাঙলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল।