শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যের পরিচিতি সহ তার ইতিহাস | কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার কারণ

কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার কারণ


রবীন্দ্র-প্রতিভা যখন মধ্যগগনে, তখন ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের আবির্ভাব এবং চোখের বালি উপন্যাসই শরৎচন্দ্রের রচনার এক আদি প্রেরণা। তবু রবীন্দ্রনাথের সমকালে পাঠকজনচিত্তরঞ্জনে বা জনপ্রিয়তায় শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করেছিলেন।


বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষতায়, বাস্তব অনুভূতির তীব্রতা ও সহমর্মিতায়, তীক্ষ্ম সমালােচনা ও নারী চরিত্রের অন্তর্গঢ় আবেগ অনুভূতির গভীর বিশ্লেষণে শরৎচন্দ্র বাঙলা উপন্যাসকে ঐশ্বর্যসমৃদ্ধ করে গেছেন। ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুসরণে আমরা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলােকে এই কয়েকটা শ্রেণীতে ভাগ করে নিতে পারি- 


  • (ক) পারিবারিক বিরােধের চিত্র- 'পণ্ডিতমশাই' (১৯১৪), 'বৈকুণ্ঠের উইল' (১৯১৫), 'নিষ্কৃতি' (১৯১৭); 

  • (খ) সমাজবিধির প্রাধান্যচিহ্নিত দাম্পত্যপ্রেম ও বিরােধ কাহিনী- 'শুভদা' (রচনাকাল ১৮৯৯), 'বড়দিদি' (১৯১৩), 'চন্দ্রনাথ' (১৯১৪), 'বিরাজ বৌ' (১৯১৬), 'দেবদাস' (১৯১৭); 

  • (গ) সমাজ সমালােচনামূলক উপন্যাস- 'অরক্ষণীয়া' (১৯১৬), ‘পল্লীসমাজ' (১৯১৬), 'বামুনের মেয়ে' (১৯২০) প্রভৃতি; 

  • (ঘ) পূর্বরাগপুষ্ট মধুরাস্তিক প্রেম- 'পরিণীতা', 'দত্তা' (১৯১৮), 'দেনাপাওনা' (১৯২৩); 

  • (ঙ) নিষিদ্ধ সমাজবিরােধী প্রেম—'চরিত্রহীন' (১৯১৭), 'শ্রীকান্ত' (প্রথম পর্ব ১৯১৬, দ্বিতীয় ১৯১৮, তৃতীয় ১৯২৭, চতুর্থ ১৯৩৩), 'গৃহদাহ' (১৯২০); 

  • (চ) মতবাদপ্রধান উপন্যাস—'পথের দাবী' (১৯২৬), 'শেষ প্রশ্ন' (১৯৩১), 'বিপ্রদাস' (১৯৩৫)।


পারিবারিক বিরােধমূলক চিত্রাঙ্কনে শরৎচন্দ্রের এই জাতীয় উপন্যাসে বাস্তবতা অতিশয় তীক্ষ্ণ, উজ্জ্বল এবং অসন্দিগ্ধ। সাধারণতঃ পারিবারিক বিরােধচিত্রগুলােতে এক পক্ষ পাষণ্ড, অন্যায়কারী; অন্যপক্ষ তার দ্বারা নিপীড়িত হয়ে থাকে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতে এই ধরনের স্থূল, দ্বন্দ্ব জটিলতাবর্জিত চিত্র দেওয়া হয়নি; তিনি বিরােধের দায়িত্ব দুপক্ষেরই ওপর প্রায় সমানভাবে বণ্টন করে দিয়ে সংঘর্ষটিকে মনস্তাত্ত্বিক, চরিত্রগত ও জটিল করে তােলেন। 'নিষ্কৃতি’র ভ্রাতৃ-বিরােধের চিত্রে হরিশ ও তার স্ত্রী নয়নতারার কুটিল স্বার্থপরায়ণতা বিরােধের প্রধান উৎসরূপে চিহ্নিত হলেও সিদ্ধেশ্বরীর ব্যক্তিত্বহীনতা ও দুর্বলচিত্ততা এবং বাড়ির ছােটবে শৈলর কঠোর তেজস্বিতা সংঘর্ষকে তীক্ষ্ম করে তুলতে কম সাহায্য করে নি। 'পণ্ডিতমশাই'-এ বৃন্দাবন ও কুসুমের সম্পর্কে টানাপােড়েনের পশ্চাৎপট হিসেবে পারিবারিক বিরােধকেই লক্ষ্য করি। 'বিকুণ্ঠের উইল'-এ ভ্রাতৃবিরােধের পটভূমি হিশেবে গােকুলের বিচিত্র মনােভাবকে লক্ষ্য করতে পারা যায়, আচার-আচরণে প্রকাশিত তার চরিত্রগত অসংযম ও অস্থিরচিত্ততাও এই বিরােধের জন্য কম দায়ী নয়।


সমাজবিধির প্রাধান্যে চিহ্নিত প্রেম ও বিরােধকাহিনীমূলক উপন্যাসের প্রেম বিশ্লেষণে শরৎচন্দ্রের নৈপুণ্যের পরিচয় মেলে। প্রথম জীবনের রচনা বলে ‘শুভদা'র ঘটনা বিন্যাসের শৈথিল্য ও কার্যকারণ সম্পর্কের সূত্রহীনতা, ভাবালুতার আতিশষ্য ও ভাবসংহতির অভাব প্রভৃতি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তার মধ্যে শরৎচন্দ্রের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রচনারীতির পূর্বাভাস মেলে ও বিশেষত চরিত্রের সরলীকরণ সত্ত্বেও শুভদার সকল দুঃখবরণের অটল সহিষ্ণুতা ও অভিযােগহীন পাতিব্রত্যের কারুণ্য ও শুচিতা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ না করে পারে না। 'বড়দিদি' রচনাটি অপরিণত। আজন্ম বৈধব্যের সংস্কার অতিক্রম করে মৃত্যুপথযাত্রী সুরেশের ব্যাকুল আহ্বানে সাড়া দিয়ে মাধবী তাদের সম্বন্ধকে স্বীকৃতি দিলেও সম্পর্কের চিত্রণ স্পষ্ট হয় নি। 'চন্দ্রনাথ-এ বিশেষ কোনও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় না; সরযুর কুষ্ঠিত প্রেমের, কৈলাস খুড়াের পৌরুষ ও স্নেহ বাৎসল্যের অপূর্ব চরিত্রের চিত্রণের মাধুর্য ও সৌন্দর্য ব্যতীত তার কোনও দিক উল্লেখযােগ্য নয়। দেবদাস-এর নায়িকা নিজ স্বামী ও পরিবারের প্রতি কর্তব্য পালনে কোন ত্রুটি না রেখেও নিজের বাল্যপ্রেমকে যেভাবে নিভৃত হৃদয়ে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যরুপে রক্ষা করেছে, তাতে সামাজিক নীতির গণ্ডীর মধ্যেই প্রেমের মহত্ত্ব ও গৌরব উদ্ভাসিত হয়েছে। 'বিরাজ বৌ-কে কোনও কোনও সমালােচক শরৎচন্দ্রের এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে মনে করেন ঃ “ইহাতে দাম্পত্য প্রেমের নিবিড় একান্ত মিলন হইতে উহার দারুণ বিপর্যয়, অগাধ প্রীতি হইতে ঈর্ষা ও অভিমানজাত সন্দেহবিকার আকস্মিক সংঘটনের সহিত চারিত্রিক প্রতিক্রিয়ার জটিল যােগাযােগে এক ট্র্যাজেডি-করুণ পরিণতিতে পৌছিয়াছে।"


'অরক্ষণীয়া', 'পল্লীসমাজ', 'বামুনের মেয়ে' প্রভৃতি সমাজসমস্যামূলক উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সামাজিক অত্যাচার-উৎপীড়নের অমানুষিকতার স্বরূপ উদঘাটনের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও জ্ঞাপন করেছেন। এই জাতীয় সামাজিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে যারা উপন্যাস রচনা করেছেন, তাদের রচনার তুলনায় শরৎচন্দ্রের সমাজের হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার চিত্রণ আরও বাস্তব, প্রত্যক্ষ এবং মর্মান্তিক; তীক্ষ্ম ও মর্মভেদী বিশ্লেষণ লেখকের তীব্র সহানুভূতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সমাজ চিত্রণকে মর্মস্পর্শী করে তুলেছে। এই শ্রেণীর উপন্যাসগুলাের মধ্যে পল্লীসমাজ ই শ্রেষ্ঠ- "এই উপন্যাসে কোন একটি বিশেষ সামাজিক কুপ্রথার প্রতি কটাক্ষপাত করা হয় নাই, কিন্তু হিন্দু সমাজের প্রকৃত আদর্শ ও মনােভাবের, ইহার সমগ্র জীবনযাত্রার একটা নিখুঁত প্রতিকৃতি দেওয়া হইয়াছে। অঙ্কনের বাস্তবতায়, বিশ্লেষণের তীক্ষ্মতায় ও সহানুভূতির গাঢ়তায় ইহা অনুরূপ বিষয়ে সমস্ত উপন্যাস হইতে বহু উচ্চ স্থান গ্রহণ করিয়াছে।"


শরৎচন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণীর উপন্যাসগুলাের মধ্যে বিষয়বস্তুর অভিনব্বে 'দেনাপাওনা' বিশিষ্ট রচনা। অত্যাচারী দুশ্চরিত্র, পাপপুণ্যের বােধবর্জিত জমিদার জীবানন্দের বিবাহিত পরিত্যক্তা স্ত্রী অলকা চণ্ডীগড়ের ভৈরবী যােড়শীতে রূপান্তরিত হয়, অবশেষে ঘটনাচক্রে যােড়শীর সংস্পর্শে জীবানন্দের পরিবর্তনই উপন্যাসটির বিষয়বস্তু। 'পরিণীতা'র শেখর চরিত্রটির মৌলিক দুর্বলতার জন্য তার ও ললিতার প্রেম সম্বন্ধে গভীরতা অনুভূত হয় না, ললিতা যেভাবে শেখরকে নিজের হৃদয়ে পতিরূপে বরণ করে নানা প্রতিকূল অবস্থায় তারা প্রেমের তপস্যায় অবিচল থেকেছে, কেবল সেই চিত্রটিই আকর্ষণীয় হয়েছে। 'দত্তা জটিল বিশ্লেষণবর্জিত সহজ ও নির্মল প্রেমের আনন্দরসসিক্ত উপন্যাস।


'চরিত্রহীন', 'শ্রীকান্ত', 'গৃহদাহ' প্রভৃতি নিষিদ্ধ সমাজবিরােধী প্রেমমূলক উপন্যাসগুলােকে কেন্দ্র করেই শরৎচন্দ্রের যত কিছু খ্যাতি ও নিন্দা। শরৎচন্দ্র এই শ্রেণীর উপন্যাসে সমাজের প্রথানুগত্যের মােহান্ধতা, হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে নারীর আত্মােপলব্ধির আকৃতির বেদনাময় আলেখ্য রচনা করেছেন। মানুষের পাপ, ক্ষণিকের দুর্বলতায় পদস্থলন, বাসনা-কামনার বিড়ম্বনা—তার জীবনের সকল গ্লানি ও ক্লেদের মধ্যেও, পঙ্কস্তরে জন্মেও পঙ্কজের সূর্যবন্দনার পবিত্রতার মত আত্মার শুচিতা কখনও ক্ষুন্ন হয় না, তাকে প্রচলিত সামাজিক বুদ্ধি ও ক্ষুদ্র নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করা যায় না শরৎচন্দ্র তাঁর এই উপন্যাসগুলােতে বিভিন্নভাবে সেই মানবিক ভাস্বর রূপ রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ নারী চরিত্র একটা ভাবাদর্শে আদর্শ-কল্পনায় অনুরঞ্জিত। কিন্তু শরৎচন্দ্র বাস্তব জীবনের তীব্র বেদনায় অন্তর ও বাহিরের সংঘাতে, প্রাত্যহিকতায় মর্মভেদী বিশ্লেষণে নারীহৃদয়ের যে রূপ উন্মােচিত করেছেন, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার কোনও তুলনা নেই।


'চরিত্রহীন' উপন্যাসটিতে নারীর মনস্তত্ত্ব ও আবেগ-চিত্রণে শিল্পী আমাদের প্রচলিত সমাজনীতির আদর্শকে অনেকটা পরিমাণেই অগ্রাহ্য করেছেন। কিরণময়ীর বিচিত্র মনস্তত্ত্বের ক্ষুরধার বিশ্লেষণে নারীর প্রেমের রহস্যলীলাই অভিব্যক্ত। তার উন্মাদ অবস্থার পরিণতিতে শুষ্ক প্রখর বুদ্ধির অভিমানে, অহংবােধে যে আত্মা তৃপ্ত হয় না, আত্মসমর্পণের নম্রতায়ই যে তার জীবন পিপাসার চরিতার্থতা, এই ইঙ্গিতটুকু আভাসিত হয়েছে। আর সাবিত্রীর মধ্যে চতুর্দিকে পঙ্কিলতার মাঝখানে আত্মদানে সদা তৎপর শুচি প্রেমের স্নিগ্ধ জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়েছে। তার কলুষিত পূর্বজীবন তার চরিত্রে কোথাও অন্ধকার ছায়া বিস্তার করতে পারে নি।


'শ্রীকান্ত' শরৎচন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস। শ্রীকান্ত ও রাজলক্ষ্মীর প্রণয়লীলার মধ্যে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘাত-প্রতিঘাত লক্ষ্য করা যায়। একদিকে শ্রীকান্তের সূক্ষ্ম আত্মসচেতনতা, আত্মসমবােধ, অন্যদিকে রাজলক্ষ্মীর গৃহকর্তীসুলভ মর্যাদাবােধ, জননীর ভূমিকা পালনের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতনতা, সর্বোপরি সামাজিক সংস্কারবােধ তাদের সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রাজলক্ষ্মীর ক্ষেত্রে আমরা দেখি ধর্মসংস্কার বাইরের শক্তিরুপে তাদের জীবনকে সমস্যাসংকুল করেনি। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যেই এই স্ববিরােধী শক্তিরূপে নিহিত, অন্তর্দ্বন্দ্বের মূলে আছে নিজের মানসগত সংস্কারের সঙ্গে হৃদয়ের স্বাভাবিক সংঘাত। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট পরিণতিতে এই প্রেম রূপায়িত হয় নি বলে তাকে শেষ পর্যন্ত তাৎপর্যহীন বলেই মনে হয়। আলােচ্য উপন্যাসটিতে অন্নদাদিদির মধ্যে প্রেমের দুঃখময় তপস্যার মহিমা এবং অভয়ার নির্ভীক বিদ্রোহী নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের স্ফুরণ যে উজ্জ্বলতায় চিত্রিত হয়েছে তাও তার আকর্ষণীয়তাকে কম বৃদ্ধি করেনি। অনেকের মতে 'শ্ৰীকান্ত- এ উপন্যাসের ভাবসংহতি নেই, "ইহা কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদের সমষ্টি।" তবু তার প্রেমচিত্রণ ও নারীচরিত্রগুলাে বাদ দিলে শ্রীকান্তের জীবনদর্শন ও জীবনের বিচিত্র রসের আস্বাদনকারীর ভূমিকা এবং বিভিন্ন জীবন ও চরিত্র রেখাচরিত্রগুলাের অনন্যতায়ও রচনাটি উজ্জ্বল। ইন্দ্রনাথের মত অবিস্মরণীয় চরিত্র, নতুনদার স্বার্থপরতা, ইন্দ্রনাথ ও শ্রীকান্তের অভিযানের অপূর্ব বর্ণনা ও মননশক্তিতে উজ্জ্বল। শ্মশানে শ্রীকান্তের অন্ধকারের রূপধ্যান, গৌরী তেওয়ারীর প্রবাসী কন্যার নিঃসঙ্গ বেদনা, রামবাবু ও তার স্ত্রীর কৃতগ্নতা, সমুদ্রযাত্রা বর্ণনার অনবদ্য কবিত্ব, ব্রহ্মদেশের বাঙালী সমাজের চিত্র, অভয়া, সন্ন্যাসী ব্রজানন্দ, গহর ও কমললতার বিচিত্র চরিত্র প্রভৃতি উপন্যাসটির অপূর্ব সম্পদ।


জীবন সমস্যার তীক্ষ্মতম রূপায়ণে 'গৃহদাহ'ই শরৎচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। নারীর ব্যক্তিত্বের কঠিনতম সমস্যায় নায়িকা অচলার জীবন জর্জরিত রক্তাক্ত হয়েছে। উপন্যাসটির সমস্যা বহির্ঘটনার প্রভাব অপেক্ষা পাত্রপাত্রীদের মানসিক গঠনের বৈশিষ্ট্য থেকে অধিক পরিমাণে উৎসারিত হয়েছে। সুরেশ ও মহিমের প্রতি অচলার আকর্ষণ, দোলাচলবৃত্তি, গভীর তীক্ষ্ম বিশ্লেষণ অতিশয় নৈপুণ্যের সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। নারীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের দিক দিয়ে এই উপন্যাসটি বাঙলা সাহিত্যে অদ্বিতীয়।


শরৎচন্দ্রের শেষ পর্যায়ের উপন্যাসগুলােতে তার শক্তি যে ক্রমশঃ ক্ষীয়মাণ তা বােঝা যায়। ভারতবর্ষের পরাধীনতার মর্মর্যন্ত্রণা ও বিপ্লববাদের মূলতত্ত্বই 'পথের দাবী'র উপজীব্য বিষয়, কিন্তু এখানে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের গৃঢ় প্রাণময় সম্পর্কসূত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি। 'শেষ প্রশ্ন’-এ শিল্পী নায়িকা কমলের মাধ্যমে এক নতুন জীবনবাদকে প্রকাশিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু জীবনচিত্রণের মধ্য দিয়ে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি; উপন্যাসটি কেবল কতকগুলাে যুক্তিতর্কের সংকলনে পর্যবসিত হয়েছে। ‘বিপ্রদাস'-এও শরৎচন্দ্র ভাবাদর্শের সংঘাত চিত্রিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু উপন্যাসের নিজস্ব প্রাণধর্মে তাকে সফল করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। 'শেষের পরিচয়' গ্রন্থটি তিনি শেষ করে যেতে পারেন নি, কবি রাধারাণী দেবী উপন্যাসটিকে সমগ্রতা দান করেন।