বাংলা ছােটোগল্পে আশাপূর্ণা দেবীর অসামান্য প্রতিভার পরিচয় | বাংলা ছােটোগল্পে আশাপূর্ণা দেবীর অবদান, প্রতিভা ও ভূমিকা

বাংলা ছােটোগল্পে আশাপূর্ণা দেবীর কৃতিত্ব ও দান


শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, আশাপূর্ণা দেবী ভারতীয় ভাষা-সাহিত্যের ছােটোগল্পকারদের মধ্যেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসাবে আজ স্বীকৃত। বাংলা কথাসাহিত্যে একটি বহু উচ্চারিত এবং জনপ্রিয় নাম আশাপূর্ণা দেবী। চিত্তচামতকারিণী কাহিনী রচনা করে আজ মুষ্টিমেয় যে ক'জন সাহিত্যিক আমাদের সাহিত্যের আসর আলােকিত করে রেখেছেন আশাপূর্ণা তাঁদের অন্যতম। একদা বাঙালী পাঠক সমাজে শরৎচন্দ্র এবং পরবর্তীকালে তারাশংকর এবং বিভূতিভূষণ যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, সাম্প্রতিককালে আশাপূর্ণা দেবী সেই জনপ্রিয়তার অধিকারিণী। বলা বাহুল্য জনপ্রিয়তাই সার্থকতার একমাত্র প্রমাণ নয়। জনপ্রিয়তার সঙ্গে উৎকর্ষ যুক্ত হলে তবেই সে জনপ্রিয়তা স্থায়িত্ব লাভ করে। আধুনিক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, রাজা-রাজড়ার জয়-পরাজয়, রাজত্বকাল, কর্মকাণ্ডের সন-তারিখের জটিলতায় প্রকৃত ইতিহাসের অনুসন্ধান নিষ্ল। ঘরে ঘরে মানুষ যেখানে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় নিত্যদিনের জীবন যাপন করছে সেখানেই মানুষের সত্যিকার ইতিহাস রচিত হচ্ছে। আমরা যাকে কথাসাহিত্য বলি তার উপকরণ সেই যথার্থ জীবনের ইতিহাস থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। আশাপূর্ণার ছােটোগল্পের উপাদান-উপকরণ সেই চিরচেনা জগৎ থেকেই সংগৃহীত। তাই তার গল্পগুলি আমাদের জীবনেতিহাসেরই গুরুত্বপূর্ণ দলিল।


আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি হয়েছিল অতি শৈশব থেকেই। মাত্র তেরাে কি চোদ্দো বছর বয়সেই নিতান্ত কৌতূহলের বশে কাউকে কিছু না বলে লুকিয়ে তখনকার বিখ্যাত শিশুসাহিত্য পত্রিকা 'শিশুসাথী'র দপ্তরে একটা কবিতা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং আশ্চর্যের বিষয়, প্রথম লেখা সেই কবিতা অপ্রত্যাশিতভাবেই ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। এর পরের লেখাটিও 'শিশুসাথী'তেই পাঠিয়েছিলেন। এটি একটি গল্প। অর্থাৎ ছােটদের জন্য গল্প দিয়েই কথা সাহিত্যের জগতে কিশােরী আশাপূর্ণার প্রবেশ। আঠাশ বছর বয়সে লিখলেন বড়দের জন্য প্রথম গল্প। আনন্দবাজার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল 'প্রেম ও প্রেয়সী' নামে সেই প্রথম গল্প।


রক্ষণশীল পরিবারে বিবাহ হলেও বিবাহিত জীবন তার সাহিত্যচর্চার পথে কখনাে বাধা হয়ে ওঠেনি। সারা জীবনে অবিশ্রাম কথাসাহিত্যের সেবা করে গেছেন তিনি। আশাপূর্ণা স্বয়ং লিখেছেন,- "উপন্যাস লিখেছি দেড়শাের বেশী আর ছােটগল্প হাজার দেড়েকের ওপর। ... বাল্য থেকে বার্ধক্যে দীর্ঘকাল ধরে লিখে চলেছি। ... যা দেখেছি আর দেখে যা মনে হয়েছে সেটাই লিখে চলেছি।" স্বামী এবং আশাপূর্ণার প্রায় সমবয়স্ক দেওরটি লেখার ব্যাপারে তাঁকে- সব সময়ে উৎসাহ দিয়েছেন। আশাপূর্ণা দেবী নিজেও ছিলেন একজন আদর্শ পত্নী এবং আদর্শ গৃহিণী। সংসার-ধর্মে এবং সাহিত্য-কর্মে কোন বিরােধ ঘটেনি তাঁর জীবনে। সাহিত্যের প্রতি যতখানি তাঁর আনুগত্য, সংসারের প্রতিও ততখানি। আলােচক আশাপূর্ণার ব্যক্তিজীবন তথা সাহিত্যজীবনকে তুলনা করেছেন নদীর সঙ্গে ; বলেছেন,- "নিজের সংসার, প্রতিবেশীর সংসার, নিত্য দিনের জীবন, চোখের সমুখে চলমান জীবনের যে ছবি সাহিত্যে তারই প্রতিচ্ছবি। নদীর এক নাম চিত্রবহা, সে তার দুই তীরের চিত্র বহন করে চলে।..... আশাপূর্ণা দেবী কখনাে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে যান নি। এত যে গল্প উপন্যাস লিখেছেন, কত সব মানুষের কথা বলেছেন তারা সবাই চেনা মানুষ শুধু তার নয়, আমার আপনারও চেনা।"


জীবনে দেড়শাের বেশি উপন্যাস লিখলেও আশাপূর্ণা ছছাটোগল্প রচনাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তিনি নিজেই বলেছেন যে, ছােটোগল্পই তাঁর 'প্রথম প্রেম'। আশাপূর্ণার ভালােবাসার জগৎ তাঁর ছােটোগল্পের জগৎ। আশাপূর্ণার ছােটোগল্পের প্রাণ নিহিত আছে তাঁর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে। সেইসঙ্গে ঈর্ষণীয় তার গল্প বলার ভঙ্গি। তার গল্পগুলিতে কাহিনি সহজ হলেও নিটোল। কিন্তু গল্পের মধ্যেই তার আবেদন সমাপ্ত হয় না। পাঠকের বােধের মধ্যে তার একটি অনুরণন চলতে থাকে। আশাপূর্ণা বলেন,- "উপন্যাস আমাকে অনেকটা প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তবু ছােটগল্পের ওপরেই আমার পক্ষপাত।... হয় তাে ছােটগল্পই আমার 'প্রথম প্রেম' বলে। এবং এখনও ছােট গল্প লিখতেই বেশি ভাল লাগে।" ক্ষুদ্র পাত্রস্থিত জলের মধ্যে সূর্যের প্রতিবিশ্ব দেখার মতাে তাঁর ছােটোগল্পে প্রতিবিম্বিত হয় আমাদের চিরচেনা সমাজ-সংসার এবং মানুষ। ছােটোগল্পেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ এবং এই প্রকরণেই তাঁর মনন ও মেধার উজ্জ্বলতম ও বৈচিত্র্যময় প্রতিফলন।


আশাপূর্ণা তাঁর ছােটোগল্পে চরিত্র এবং চরিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্ন নির্মমতম সত্যকে উদঘাটিত করে দেন। সংসারের কোনাে বহুপ্রশংসিত মানবিক সম্পর্ককেই তিনি বিচার বা ব্যবচ্ছেদ না করে নিছক ভাবালুতার বশে ছাড়পত্র দেন নি। মাতৃত্বের বা পিতৃত্বের যে মহৎ আদর্শ মহিমান্বিত চেহারা নিয়ে আমাদের মনের কন্দরে উপস্থিত, তার কোনাে সরলীকৃত ছবি আশাপূর্ণা দেখান না আমাদের। বরং নির্মম সত্যদৃষ্টি নিয়ে তিনি সেই বাহ্য আদর্শের অস্তরালস্থিত কুটিল মানস- লীলাটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেন। এমনকি আশাপূর্ণার ছােটোগল্পে বারবার তথাকথিত মাতৃহৃদয়েও প্রতিবিম্বিত হয়েছে স্বার্থপরতা ও আত্মরতির চোরাবালি। কোনাে ধর্ষিতা মেয়ের ঠিকানা উনুনে খুঁজে দেন মা সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্যে, বলেন- "বেঁচে থাকতে ইচ্ছে নেই, কিন্তু মরতে বড় ভয় করে।" কোথাও সদ্য পুত্রহারা মা মনে মনে পুত্রবধূর বৈধব্যে খুশি হন। 'ভয়' গল্পে সাত-সন্তান মারা যাবার পর বৃদ্ধা জননী সাহেব ডাক্তার দেখাতে চান। মৃত্যুভয়ের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় তার সন্তান হারাবার দুঃখ। 'ছিন্নমস্তা' গল্পে একটি পুরুষকে ঘিরে তার মাতা ও বধূর অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ হয় মানুষটির মৃত্যুতে। কিন্তু পুত্রশােকের ভাবালুতায় গল্প শেষ হয় না; শেষ হয় পুত্রবধূর ওপর মায়ের জয়ােল্লাসের অস্ফুট ভয়াবহতায়।


‘আয়ােজন’ গল্পে আবার মাতৃস্নেহ নয়, উন্মােচিত হয়েছে নাতির প্রতি দাদুর স্নোহাতিরেক। নাতির প্রতি দাদুর স্নেহ এবং শিশুটির প্রতি মায়ের মনােযােগ এ গল্পে এক পরিচিত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শুধু এই পরিচিত দ্বন্দ্বটিই এ গল্পের সব কথা নয়। আমাদের সচকিত করে গল্পের মনস্তত্ত্বের দিকটি। এখানেও নাতির মৃত্যুকামনার মধ্যে দিয়ে দাদুর মনের তীব্র অহং তৃপ্তির বাসনার নগ্ন রূপ দেখা গেছে। বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতির চাপে আশাপূর্ণার গল্পে আমরা মানবিক সম্পর্কগুলিকে নির্মমভাবে ভেঙে যেতে দেখি। 'কসাই', 'স্থিরচিত্র' প্রভৃতি গল্পেও তার প্রমাণ আছে। মৃতপুত্রের ক্ষতিপূরণের অর্থে মা পুত্রের নামে স্মৃতিমন্দির প্রতিষ্ঠায় উন্মত্তের মতাে উদ্যোগী হন। সেই স্মৃতিমন্দির যখন বাস্তবে রূপায়িত হয়, তখন পুত্রশাক নয়, মায়ের মন ভরে ওঠে সংকল্প-পূরণের অহংকারে ও আনন্দে। কিন্তু আশাপূর্ণা এই আত্মরতিকে মুহূর্তে তছনছ করে দেন পুত্রের মৃত্যুসংবাদ ভ্রান্ত প্রমাণ করে। মায়ের সেই আনন্দ-মুহূর্তে আকস্মিকভাবে একটি চিঠি এসে পৌছয় তার হাতে, তাতে সেই মৃত বলে ঘােষিত পুত্র জানিয়েছেন যে, আপাতত তিনি বিকলাঙ্গ হয়ে জীবিত আছেন এবং চিঠিতে তার বর্তমান ঠিকানা জানানাে হয়েছে। বলা বাহুল্য, সেই মুহূর্তে মায়ের কাছে পুত্রের বেঁচে থাকার সংবাদটি সুসংবাদ হিসেবে আর প্রতিভাত হয় না।


আবার তাঁর ছােটোগল্পের অনেক নারীচরিত্রকে আমরা দেখি আত্মবিলােপের মধ্যে দিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করতে। আশাপূর্ণার ছােটোগল্পে সমাজই মুখ্য। সামাজিক নানা সংস্কারের অনর্থক অত্যাচারের দিকটি তিনি তুলে ধরেন তার গল্পে। কোথাও প্রেমিকের হাতে গােপনে গহনা তুলে দিয়ে মা তার স্বামী-কন্যাকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই প্রতারিত হয়েছেন। অথচ সেই কন্যাকে সব জেনেও মায়ের সম্পর্কে কিছু না জানার ভান করতে হয়। যে নারীরা অত্যাচারিত হয়, তারাও সংস্কার-মুক্ত নয়। সমাজশৃঙ্খলিত অবস্থাই তাদের বিনষ্টির কারণ হয়ে ওঠে। যেমন দেখি 'একটি মৃত্যু ও আরেকটি', 'পরাজিত হৃদয়', 'কার্বন কপি' প্রভৃতি গল্পে। 'কার্বন কপি' গল্পে নির্জন প্রবাসগৃহে পুরােনাে প্রণয়ীর উপস্থিতিতে রাত্রিবাস অসম্ভব হয় আধুনিকা উত্তর ত্রিশ ডিভাের্সীর পক্ষে। 'পরাজিত হৃদয়' গল্পে ধর্ষিতা সন্তানকে কোল দিতে সাহস পান না আধুনিক বাবা-মা। কিংবা 'বক’ গল্পে জামাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও মা তরুণী কন্যাকে সংবাদ না দিয়ে তাকে উপহার দেয় বিয়েবাড়ির একটি সন্ধ্যা। বাহ্যিক দিক থেকে আধুনিক হয়েও আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ যে এখনও পুরােনাে সংস্কারের সীমানা পেরােতে পারেনি, তার নানা দৃষ্টান্ত আশাপূর্ণা তুলে ধরেন কখনাে কৌতুকে, কখনাে নির্মমতার সঙ্গে 'সবদিক বজায় রেখে’, ‘বে-আভু’, ‘স্বগের টিকিট', 'বড় রাস্তা হারিয়ে', 'ঘূর্ণমান পৃথিবী' প্রভৃতি গল্পে। 'স্বর্গের টিকিট' গল্পে চামেলী গায়ে আগুন দেয় তার জেঠী রসিকে রসিয়ে দুঃসংবাদটি পরিব্যণ করার কারণেই। 'ছুটি নাকচ' গল্প শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে মনিববাড়ির নিঃসন্তান মেয়েটিকে বাঁচাতে হাসপাতাল থেকে ছেলে চুরি করতে গিয়ে জেলে যায় কাজের মেয়েটি। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর সে আবিষ্কার করে যে, গ্রামের শ্বশুরঘরে আর জেলফেরৎ বধূর কোনাে ঠাই নেই। অবশ্য তার অপরাধের জন্য প্রাপ্ত অর্থানুকূল্যটুকু ভােগ করতে কারাে কোনাে আপত্তি হয়নি।


আশাপূর্ণা দেবীর ছােটোগল্প সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালের কথাসাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন মন্তব্য করেছেন— "আশাপূর্ণার ছােটগল্পে মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন এবং ইতিহাস দুটোই ধরা আছে, কিন্তু শ্লোগান নেই, পােস্টার নেই। জীবনের নিষ্ঠুরতম সত্যগুলি, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, বিড়ম্বনার কাহিনীগুলি তিনি যেন ছােট ছােট খড়ির গায়ে নরুন দিয়ে খােদাই করে কালস্রোতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। বড়াে কথা ছােটো করে বলায় তিনি ওস্তাদ, মনুষ্যজীবনের বড়া বড়াে ধাক্কাগুলিকে ছােটোগল্পের ছােটো পরিসরের মধ্যে ধরে ফেলায় তার অনায়াস নৈপুণ্য।" আসলে আমাদের পরিচিত জীবনকেই এমন আশ্চর্য কৌশলে উন্মােচিত করেন আশাপূর্ণা যে, মুহূর্তে প্রকাশিত হয়ে যায় আমাদের অনেক আদর্শ, মহত্ত্ব, উদারতা, ত্যাগের অন্তরালবর্তী ফাকি, আত্মপ্রবঞ্চনা, মিথ্যাচার, আশাপূর্ণা দেবীর ছোট গল্প তাই আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের আত্ম-উন্মােচনের গল্প।