কথাসাহিত্যিক বলাইচাদ মুখােপাধ্যায়ের দান, কৃতিত্ব ও অবদান | কথাসাহিত্যিক বনফুলের দান, কৃতিত্ব ও অবদান

কথাসাহিত্যিক বলাইচাদ মুখােপাধ্যায়ের অবদান ও স্থান


রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা সৃজনশীল সাহিত্য, বিশেষত কথাসাহিত্য যাদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে বলাইচাদ মুখােপাধ্যায় বা বনফুল তাদের মধ্যে অন্যতম। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে তাঁর সাহিত্য সাধনার সুচনা। জীবনের শেষপর্ব পর্যন্ত চিকিৎসর্কবৃত্তির সমান্তরালে বিচিত্র ধারায় তাঁর সাহিত্যচর্চা অব্যাহতভাবে চলেছে। শ্রদ্ধেয় কালিদাস রায় বনফুলের সাহিত্য-প্রতিভা সম্বন্ধে বলেছিলেন—যে সব লেখকের ভাবধারা বিচিত্র এবং হৃদয়াবেগের উৎসার দুর্দম, দুর্নিবার ও বেগবান তাদের আত্মবিকাশের পক্ষে সাহিত্যপ্রবাহের একটিমাত্র পরিখাতেই যথেষ্ট নয়। তাই উপন্যাস, ছােটগল্প, নাটক, নক্সা, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি বিবিধ খাত দিয়ে তার সৃষ্টির প্রবাহ দ্রুত চলেছে।


রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালেই বনফুলের সাহিত্যপ্রতিভা সুপ্রতিষ্ঠিত এবং রবীন্দ্রনাথের দ্বারা তার স্বাতন্ত্র স্বীকৃত। তথাপি সমকালে বা তৎপরবর্তীকালেও বনফুল সেভাবে আলােচিত নন। প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ, তারাশংকর, মানিক প্রমুখেরা বঙ্গ সাহিত্য আলােচনায় যতখানি উপস্থিত, বনফুল সেভাবে উপস্থিত নন। সম্ভবত তার প্রথম ও প্রধান কারণ প্রকাশক ও বৃহত্তর মহলে তিনি যাতায়াতে উৎসাহী ছিলেন না এবং দীর্ঘকাল কলকাতা থেকে দূরবর্তী প্রদেশে তার কর্মজীবন কেটেছে। ফলে বনফুল প্রচারের আলােয় আলােচিত কথাকার হয়ে উঠতে পারেন নি। এছাড়াও তার সাহিত্য সম্পর্কে বিরূপ সমালােচনা তাঁর খ্যাতির অন্তরায় হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগ অগভীরতার এবং গভীর জীবনদর্শনের অনুপস্থিতির। আসলে কল্লোল-কালিকলম- প্রগতি যে আধুনিক ধারার সূচনা ঘটিয়েছিল, সেখানে জীবনের জটিলতা ও তার বূপায়ণের জটিলতা এত বেশি যে, সে তুলনায় বনফুলের গল্পের সহজ-সারল্য ও জটিলতাহীন রীতিপ্রযুক্তি এবং বিষয়ের স্পষ্টতা তাকে অগভীর বলে চিহ্নিত করেছিল বলে সন্দেহ হয়।


ব্যক্তিজীবনে বনফুল ছিলেন খেয়ালী, পরােপকারী, প্রকৃতিপ্রেমী, অপ্রাকৃতে বিশ্বাসী, স্পষ্টবাদী এবং সর্বোপরি মানবতাবাদী। এই অকুণ্ঠ মানবতাবাদই তাঁর কথাসাহিত্যের প্রাণবস্তু। সরল মানবতার প্রকাশেই তার গল্প এবং উপন্যাসগুলি সার্থক হয়ে উঠেছে। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার গল্পে প্রতিফলিত। সে কারণে তার গল্পের বিষয়ও বহু বিচিত্র। বিভিন্ন বিষয়বস্তু অবলম্বন করে তার উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ষাট। বিষয়বস্তু অনুসরণে তাঁর উপন্যাসগুলিকে কয়েকটি শ্রেণীতে স্থলভাবে ভাগ করা চলে-


  • ইতিহাসমিশ্রিত রােমান্স, যেমন 'সন্ধিপূজা', 'মহারানী' ইত্যাদি।

  • সামাজিক উপন্যাস, যেমন ‘পক্ষীমিথুন’, 'প্রচ্ছন্ন মহিমা' ইত্যাদি।

  • রাজনৈতিক উপন্যাস, যেমন 'সপ্তর্ষি, 'অগ্নি' ইত্যাদি।

  • মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, যেমন ‘ভুবনসােম’, ‘দ্বৈরথ' ইত্যাদি।

  • আদর্শপ্রধান উপন্যাস, যেমন ‘স্বপ্নসম্ভব’, 'আশাবরী' ইত্যাদি।

  • উদ্বাস্তুসমস্যামূলক উপন্যাস 'ক্রিবর্ণ', 'পঞ্চপর্ব' ইত্যাদি।

  • কাব্যধর্মী উপন্যাস, যেমন 'রূপকথা' এবং 'তারপর', 'লক্ষ্মীর আগমন' ইত্যাদি।


এছাড়াও রয়েছে তার মহাকাব্যোচিত উপন্যাস-


  • 'স্থাবর', 'জঙ্গম' এবং 'ডানা'। তবে বনফুলের সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাসগুলি মূলত তার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে রচিত। এর মধ্যে রয়েছে- 'হাটেবাজারে', 'অগ্নীশ্বর', 'উদয়-অস্ত', 'নির্মোক' ইত্যাদি।


'হাটে বাজারে'র ডাক্তার সদাশিব এবং অগ্নীশ্বর এ ডাক্তার 'অগ্নীশ্বর' আদর্শবান মানবতাবাদী চরিত্র হিসাবেই উপস্থাপিত। শুধু আদর্শবাদ নয়, সেই আদর্শ রক্ষার জন্য অন্যায়, দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকেও ভাষা দিয়েছেন এই ডাক্তার চরিত্রগুলি। 'হাটে বাজারে’র সদাশিব ডাক্তার বলেছেন—'অন্যায়, অসত্য, অসুন্দরের প্রতি প্রতিবাদ করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।' বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ডাক্তারের মানবতাবাদী চরিত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। আপাত গম্ভীর ও বুক্ষ প্রকৃতির ডাক্তার সদাশিবের হৃদয়ের অন্তরালের কোমল মনটিকে ধীরে ধীরে মেলে ধরা হয়েছে ‘হাটে বাজারে’ উপন্যার্সে।


বনফুলের রাজনৈতিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযােগ্য 'সপ্তর্ষি' এবং 'অগ্নি'। 'সপ্তর্ষি'-তে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ের ইতিহাস এবং 'অগ্নি'তে ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ব্যবহৃত। বনফুল সক্রিয় রাজনীতি করেননি। তবু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে আদর্শবান নির্ভীক মৃত্যুঞ্জয় চরিত্রগুলি তার লেখক সত্তাকে আলােড়িত করেছিল সন্দেহ নেই।


বনফুলের এপিকধর্মী তিনটি উপন্যাস 'স্থাবর', 'জঙ্গম' ও 'ডানা'। অতীত মানবজীবনের ইতিহাস স্থাবর। 'জঙ্গমে' বিংশ শতকের চলমান জীবন বর্ণিত। 'ডানা' উপন্যাস কিছুটা ভিন্নধর্মী। এখানে বিচিত্র পক্ষীজগতের কথা মহাকাব্যাচিত বিশাল আয়তনে ধরা হয়েছে। 'স্থাবর' উপন্যাসে প্রাচীন অসভ্য নরগােষ্ঠীর অলৌকিক অসম্ভবে মিশ্রিত ক্ষুধা-কাম-ত্ত্র-মন্ত্র শক্তি-ভীতি ঘেরা জীবনালেখ্য চিত্রিত। বাংলা সাহিত্যে বৃহৎ আয়তনের উপন্যাসের সূচনা জঙ্গম' উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। বিংশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের চলমান জীবন এখানে প্রতিফলিত। একদিকে কলকাতার নাগরিক জীবন, অন্যদিকে বিহারের গ্রামজীবনের দারিদ্র্য-দুঃখ এখানে ফুটে উঠেছে। কবিস্বভাব উদাসীন প্রকৃতি শঙ্কর নাগরিক সভ্যতার সংস্পর্শে যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছে ও শেষ পর্যন্ত বিষাক্ত নাগরিক পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বন্ধু উৎপলের জমিদারীর ম্যানেজার হিসেবে বিহারের দরিদ্র অসহায় নিরন্ন অধিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে চলে গেছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও শতাব্দী সঞ্চিত দারিদ্র-অশিক্ষা-কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও প্রচেষ্টাই 'জঙ্গম' উপন্যাসের মূল কথা।


'ডানা' বনফুলের অভিনব সৃষ্টি। পক্ষীজীবন নিয়ে এমন রূপক সাহিত্য অন্যরহিত। ভাগলপুরে বন্ধু প্রত্যোৎ কুমার সেনগুপ্ত বনফুলকে পক্ষীত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সাহায্য করেছিলেন। পাখিদের আকাশজীবন এখানে প্রায় বাস্তব মানবজীবনেরই রূপক। উপন্যাসের মূলতত্ত্ব প্রথম খণ্ডের শেষ বাক্যে উচ্চারিত—'সবাই নিজের নিজের আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়।' সুকুমার সেন বলেছেন যে, ঔপন্যাসিক বিজ্ঞানকে উপন্যাস ও কাব্যের ক্ষেত্রে টানিয়া আনিয়াছেন ডানায়।


স্বাধীনতা লাভের এক বৎসর পূর্বে ১৯৪৬ এ রচিত 'স্বপ্নসম্ভব'। দীর্ঘদিনের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের পটভূমিতে অবশেষে যখন স্বাধীনতা আসন্ন, তখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লজ্জাজনক অধ্যায়টি সেই গৌরবময় ইতিহাসকে মসীলিপ্ত করেছে। এই পটভূমিতেই ‘স্বপ্নসম্ভব’ রচিত। 'নবদিগন্ত' শ্রমবিমুখ ও নৈরাশ্যপীড়িত বাঙালী জীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত। এই বক্তব্যই প্রসারিত 'আশাবরী'তে।


'পক্ষীমিথুন' উপন্যাসও ‘ডানা'র মতােই অভিনব। ঔপন্যাসিকের সমাজচেতনা প্রখরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে একটি কুকুরের মাধ্যমে এই উপন্যাসে। কুকুরটি রূপক। আসলে সে উপন্যাসের নায়কের বিবেকেরই প্রতিচ্ছবি। 'নবীন দত্ত' উপন্যাসে সমাজের উগ্র আধুনিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক নবীন দত্ত। কিন্তু সমাজের ভাঙনকে তিনি রােধ করতে পারেন নি।


'ভুবন সােম' বনফুলের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। শিকার প্রিয় ভুবন সােমের মধ্য দিয়ে শিকারের নানা পদ্ধতি এই উপন্যাসের এক আকর্ষণ। কিন্তু বাইরের ঘটনার আড়ালে এখানে চলেছে মানবমনের রহস্যময় খেলা। ভুবন সােম আদর্শবাদী, প্রাচীন ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী, ন্যায়নিষ্ঠ। অবক্ষয় ও শঠতার সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠা ও কর্তব্যবােধের দ্বন্দ্ব এই উপন্যাসে বর্ণিত।


উপন্যাসে যেমন, ছােটো গল্পের ক্ষেত্রেও তেমনি বনফুল বিচিত্র জীবনকে ফুটিয়ে তুলেছেন। বনফুলের প্রথম ছােটো গল্পের সংকলন 'বনফুলের গল্প' ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয়।


বনফুল তার কিছু কিছু ছােটো গল্পে মানুষের বাহ্য পরিচয়ের পরিবর্তে আন্তর পরিচয়কেই উদঘাটিত করতে চেয়েছেন। যেমন ‘অনুবীক্ষণ’ গল্পে দর্শন-বিজ্ঞান-ইতিহাসে সুপণ্ডিত অনিন্দ্যশক্তির রক্ত পরীক্ষায় যৌন রােগের বীজ পাওয়া যায়। 'শ্রীপতি সামন্ত’ গল্পে ইংরাজি পােষাক আচরণে চটকদার বাঙালী যুবকটি বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে ধরা পড়ে। 'বীরেন্দ্রনারায়ণ' গল্পে জমিদার খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েন। এর বিপরীত দৃষ্টান্তও বনফুলের গল্পে আছে। যেমন 'নীলকণ্ঠ' গল্পের নামচরিত্রটি সাহিত্যসভায় সভাপতিত্বের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সভারম্ভের আধঘণ্টা পূর্বে তাঁর একমাত্র পুত্রের মৃত্যু সত্ত্বেও তিনি সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন।


বনফুল তার 'মানুষ' প্রবন্ধে বলেছিলেন— 'অদ্ভুত জীব এই মানুষ।...কোনাে একটা অঙ্কের ফরমূলায় তার স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না।' 'সুরবালা' গল্পের বিপিন চরিত্র তার প্রমাণ। মদ্যপায়ী বিপিন মন্তাবস্থায় স্ত্রীকে প্রহার করত। কিন্তু গান্ধীজীর অসহযােগ আন্দোলনে সত্যাগ্রহী হিসাবে তাকেই মদের দোকানে পিকেটিং করতে দেখা গেছে। 'ছুড়িটা' গল্পে দেশনেতাকে দেখি চরিত্রবান ইতে আহ্বান জানাতে। সেই বক্তৃতা শুনতে গেছে তারই অবৈধ সন্তান সেই ছুড়িটা।


বনফুলের মনস্তাত্বিক গল্পের মধ্যে উল্লেখযােগ্য 'যুগল স্বপ্ন', 'অনির্বচনীয়', 'ভিতর ও বাহির', 'ঐরাবত' ইত্যাদি। 'যুগল স্বপ্ন' গল্পে স্বামী-স্ত্রী হাসি ও অজয় পাশাপাশি শুয়ে স্বপ্ন দেখে প্রাক- বিবাহ পর্বের প্রেমিক প্রেমিকাকে। অথচ বাস্তবে তারা সুখী দাম্পত্য জীবন উপভােগ করে। ‘চুনােপুটি’ গল্পে অভিনেত্রী পুঁটি বহু অর্থের অধিকারিণী হলেও এক অদ্ভুত শূন্যতার হাহাকার বুকে বহন করে। 'ছেলেমেয়ে' গল্পে আন্নাকালী ও নমিতা আসন্নপ্রসবা অবস্থায় হাসপাতালে শুয়ে পুরুষজাতির নিন্দা করে। কিন্তু প্রসবের পর আন্নার কন্যা ও নমিতার পুত্রসন্তান হলে আন্না আর্তনাদ করে পুত্রের জন্য। আর নমিতা সভয়ে নিজ পুত্রসন্তানটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে।


ডাক্তারী জীবনের অভিজ্ঞতা অনেকগুলি উপন্যাসের মতাে বনফুলের অনেকগুলি ছােটো গল্পেরও বিষয় ডঃ সুকুমার সেন 'বনফুলের গল্প সংগ্রহের'র ভূমিকায় লিখেছেন- 'বাংলা গল্পে বনফুল যে নব নব রস জমিয়ে তুলেছেন তার মধ্যে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, যাকে নাম দিতে পারি ডাক্তারী রস।' 'নাথুনীর মা’, ‘দণ্ডকৌমুদি’, ‘ত্রিফলা’, ‘সুরবালা’, ‘গণেশ জননী' ইত্যাদি গল্পে সেই ডাক্তারী রসের প্রকাশ দেখি।


'বনফুল' হাস্যরসিক। তিনি অনেকগুলি ব্যঙ্গ কবিতাও রচনা করেছেন। 'অদ্বিতীয়া' গল্পে বহু পুত্রকন্যার পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করতে গিয়ে কি পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন তার বিবরণ আছে। 'পূজোর গল্প'তে ইন্সিওরেন্স দালাল বিষ্ণুচরণ ট্রেনের মধ্যে বক্তৃতা করে সপুত্রকন্যা যাত্রী দুর্গাকে পর্যন্ত পূজা ইন্সিওরেন্সের জন্য সম্মত করিয়ে ফেলেছে। 'ক্যানভাসার' গল্পের হীরালাল গ্রামে গ্রামে দাঁতের মাজন বিক্রী করলেও তার নিজের দাঁত বাঁধানাে।


বনফুলের সমাজ-সমস্যামূলক গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'সনাতনপুরের অধিবাসীবৃন্দ’, ‘ঝুলন পূর্ণিমা', 'মাধব মুখুজ্জ্যে' ইত্যাদি। পল্লীসমাজের সংকীর্ণতা, পণপ্রথা, পাত্রী নির্বাচন, অসবর্ণ বিবাহ ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক বিষয় গল্পগুলিতে প্রকাশিত।


‘ডানা’ ও ‘পক্ষীমিথুন’ উপন্যাসের মতাে কয়েকটি ছােটোগল্পেও বনফুলের পশু-পক্ষীর প্রতি প্রীতি প্রকাশিত। 'পারুল' গল্পে বিড়ালের প্রতি প্রীতি, ‘গণেশজননী' গল্পে গণেশ নামক হাতির প্রতি সন্তানস্নেহ, 'সর্বণ গােয়ালা' গল্পে শুকুমণি নামক গাভীটির প্রতি সর্বণের কন্যাস্নেহ উল্লেখযােগ্য।


অলৌকিক ও ভৌতিক রসের প্রতিও বনফুলের অদম্য আকর্ষণ ছিল। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী মানুষ হলেও জীবন ও পৃথিবীর অপার রহস্যের প্রতি বিশ্বাসই বনফুলকে অলৌকিক রস-সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছে। তার ভূতের গল্পগুলির মধ্যে অবর্তমান', 'শেষ কিস্তি’, ‘কেন' ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। অলৌকিক রসের গল্প 'নন্দী ক্ষ্যাপা', 'স্বপ্ন' ইত্যাদি।


বনফুল শিশুসাহিত্য রচনাতেও উৎকর্ষ দেখিয়েছেন। তার বিভিন্ন গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য—'বনফুলের গল্প', 'বনফুলের আরাে গল্প', 'বিন্দু বিসর্গ'; 'আরও কয়েকটি', 'নবমঞ্জরী’ ইত্যাদি। কবিতা, ব্যঙ্গকবিতা ও নাটকের ক্ষেত্রেও বনফুলের প্রতিভা প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে 'বনফুলের কবিতা', 'করকমলেষু' ইত্যাদি। ব্যঙ্গকবিতার বই— 'বনফুলের ব্যঙ্গকবিতা'। এছাড়া তার অনেকগুলি সার্থক নাটকের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ‘শ্রীমধুসূদন', ‘মন্ত্রমুগ্ধ’, ‘বিদ্যাসাগর’ ইত্যাদি। তবে কথাসাহিত্যেই বনফুলের সাহিত্য-প্রতিভা যথার্থ প্রকাশিত। জীবন ও চরিত্রের বিচিত্ররূপ বনফুলের গল্পে যেভাবে প্রতিফলিত তা সত্যই অনন্য।