চন্দ্রশেখর - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ছোটো প্রশ্ন - ৫)

“একটি ক্ষুদ্র বালিকা নীরবে তাহার মুখপানে চাহিয়াছিল...।”

বালিকা বলতে শৈবালিনীকে বোঝানো হয়েছে। সে নবদুর্বাদল শয্যায় শয়ন করে প্রতাপের দিকে তাকিয়েছিল। ভাগীরথীর তীরে আম্রকাননে তার প্রায়ই দুজনে জলকল্লোলের মধুময় সঙ্গীত শ্রবণ করতে আসে। তাঁরা সাত-আট বছরের বালক বালিকা। একসাথে খেলাধুলা করে বেড়ায়, এক গাঁয়েই বসবাস করে। শৈবালিনী বন থেকে বন্য-কুসুম চয়ন করে মালা গেঁথে প্রতাপের গলায় পরায়, আবার সে মালা খুলে নিজের চুলে বাঁধে, আবার চুল থেকে খুলে ছেলেটির গলায় পরায়। ঠিক করতে পারেনা, মালাটা কে পরবে। কাছেই একটা হৃষ্টপুষ্ট গাইগোরু চরছে দেখে শৈবালিনী সে মালাটি গিয়ে গাইগোরুকে পরিয়ে দেয়। এমনটি তাদের প্রায়ই হত। প্রতাপ মালার বিনিময়ে নীড় থেকে পাখির বাচ্ছা পেড়ে দিত, আবার কখনো পাকা আম পেড়ে এনে দিত। সদ্য আকাশে তারা উঠলে দুজনে মিলে তারা গুণতে বসতো। কে আগে দেখেছে এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে বিবাদ বাধত। নদীতে যখন সার বেঁধে নৌকা ভেসে যেত, তারা বাজি ধরে নৌকা গোণার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। —“এইরূপে ভালোবাসা জন্মিল। প্রণয় বলিতে হয় বল, না বলিতে হয়, না বল। যোলো বৎসরের নায়ক–আট বৎসরের নায়িকা। বালকের ন্যায় কেহ ভালোবাসিতে জানে না।" এইজন্যেই বালিকা শৈবালিনী বালক প্রতাপের দিকে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকে।


"বাল্যকালের ভালোবাসায় বুঝি কিছু অভিশম্পাত আছে।"

প্রতাপ ও শৈবালিনী বাল্যকাল হতে প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু সে প্রণয় দীর্ঘকাল টেকেনি। পরবর্তীকালে উভয়ের বিচ্ছেদ অবসম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। শৈবালিনীর বিবাহ হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রশেখরের সঙ্গে আর প্রতাপের অন্য নারীর সঙ্গে। কিন্তু বিবাহোত্তর জীবনেও কেউ কাউকে কখনো ভুলতে পারেনি। আকর্ষণ বিকর্ষণ লীলায় উন্মত্ত উভয়ের জীবন আবর্তিত হয়েছিল। সুধী গৃহকোণ কেউ পায়নি। শৈবালিনী ও প্রতাপের এই প্রণয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাই লেখক মন্তব্য করেছেন– “যাহাদের বাল্যকালে ভালোবাসিয়াছো, তাহাদের কয়জনের সঙ্গে যৌবনে দেখাসাক্ষাৎ হয়? কয়জন বাঁচিয়া থাকে? কয়জন ভালোবাসার যোগ্য থাকে? বার্দ্ধক্যে বাল্যপ্রণয়ের স্মৃতিমাত্র থাকে, আর সকল বিলুপ্ত হয়।” এ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান, প্রতাপ শৈবালিনীর বাল্যপ্রেম ছিল অভিশম্পাতে ভরা। তাই এমনভাবে উপরিউক্ত মন্তব্যটি করা হয়েছে।


“কেন মরিব? প্রতাপ আমার কে? আমার ভয় করে, আমি মরিতে পারিব না।”

এ অভিমত শৈবালিনীর। সে অন্তকরণে জানত প্রতাপের সঙ্গে তার বিবাহ হবে। কিন্তু প্রতাপ জানত বিবাহ হবে না। কারণ, শৈবালিনী প্রতাপের জ্ঞাতিকন্যা, এটা কিন্তু শৈবালিনী বুঝতে চাইতো না। তাছাড়া শৈবালিনী দরিদ্রের কন্যা, কেউ ছিল না, কেবল ছিল অনন্ত সৌন্দর্য্যের অধিকারী। প্রতাপও দরিদ্র কিন্তু উভয়ের বিবাহ সম্ভব নয়। শৈবালিনীর যৌবন ক্রমশ ষোলোকলায় পূর্ণ হতে থাকে। সে জানত প্রতাপ ভিন্ন অন্য কোনো সুখ নেই কিন্তু বুঝল এ জন্মে প্রতাপকে পাবার সম্ভাবনা নেই। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে উভয়ে ডুবে আত্মহত্যা করার জন্য গঙ্গাতে স্নান করতে গেল। গঙ্গাবক্ষে সাঁতার দিতে দিতে পূর্বপ্রতিশ্রুতিমতো প্রতাপ ডুবল, কিন্তু “শৈবালিনী ডুবিল না—ফিরিল। সন্তরণ করিয়া কূলে ফিরিয়া আসিল।” শৈবালিনীর এই কর্মে তার মধ্যেকার দ্বিচারিতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রতাপ শৈবালিনীকে যেমন নিখুঁতভাবে ভালোবেসেছিল শৈবালিনী ভালোবাসার বড়াই করলেও প্রতাপকে সে ততখানি নিখুঁত ভালোবাসেনি।


“সৌন্দর্যের মোহে কে না মুগ্ধ হয়।”

চন্দ্রশেখর গৃহস্থ বটে, কিন্তু সংসারী নয়। বিবাহ করেনি পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে। বয়স বত্রিশ উত্তীর্ণ। দীর্ঘ একবছর পূর্বে তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়েছে বটে, কিন্তু তথাপি চন্দ্রশেখর বিবাহে অসম্মত। তবে পরে তিনি বুঝতে লাগলেন স্ত্রী ছাড়া বুঝি তাঁর আর চলে না। কেনা নিজের রান্না করে খেতে হয়, দেবসেবা আছে, তাও নিজ হস্তে করতে হয়। মাঝেমধ্যে নানা ব্যবহার্য জিনিসপত্র হারিয়ে যায়, খুঁজে পান না। “প্রাপ্ত অর্থ কোথায় রাখেন কাহাকে দেন, মনে থাকে না। খরচ নাই অথচ অর্থে কুলায় না। চন্দ্রশেখর ভাবিলেন, বিবাহ করিলে কোনো কোনো দিকে সুবিধা হইতে পারে।” তবে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ে যদি করতে হয় সুন্দরীকে নয়। সুন্দরীকে বিবাহ করলে মোহমুগ্ধ হয়ে পড়তে পারেন। সংসারবন্ধনে মুগ্ধ হতে তিনি চান না। তিনি যখন এইরূপ ভাবছিলেন, হঠাৎ শৈবালিনীর সঙ্গে চন্দ্রশেখরের সাক্ষাৎ হয়ে গেল। শৈবালিনীকে দেখামাত্র চন্দ্রশেখরের সংযমীর ব্রত ভঙ্গ হল। কালবিলম্ব না করে চন্দ্রশেখর নিজেই ঘটক লাগিয়ে শৈবালিনীকে বিবাহ করলেন। অর্থাৎ শৈবালিনীর সৌন্দর্যের মোহে চন্দ্রশেখর অতি অল্পেই মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন।


“ঈশ্বর কেন এমন করেন? একজন কেন আর একজনের পথ চেয়ে পড়ে থাকে? যদি তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা, তবে যে যাকে পায়, সে তাকেই চায় না কেন? যাকে না পায়, তাকে চায় কেন?”

দলনীর বেগমের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলি অভিব্যক্ত হয়েছে। সুবে বাংলা, বিহার, ওড়িষার অধিপতি নবাব আলিজা মীরকাসেম খা মুঙ্গেরের দূর্গে বাস করেন। দূর্গমধ্যে অন্তঃপুরে সপ্তদশবর্ষীয়া যুবতী দলনী বেগম নবাবের আগমনের পথ চেয়ে বসে থাকেন। কিন্তু নবাব আসেন না। অভিমানে তিনি বলতে থাকেন– “কেন আমি কেন? হাজার দাসীর মধ্যে আমি একজন দাসীমাত্র, আমার জন্য এতদূর আসিবেন কেন?” কোনো কাজে মনঃসংযোগ করতে পারেন না। অস্থিরতা আর অস্থিরতা, গুলেস্তা পড়তে শুরু করে কিন্তু ভালো না লাগায় তা সরিয়ে রাখে। উৎকণ্ঠা আর নিবাশ্বাস দলনীকে কুরে কুরে খেতে থাকে। নিজের বিরহদশাকে প্রকট করতে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। এতে তাঁর চরিত্রের একনিষ্ঠতাকেই প্রমাণ করে।


“জলেরও হিল্লোলে যুবতীর হৃদয় নৃত্য করে। দুই সমান, জল চঞ্চল; এই ভুমে চাঞ্চল্যবিধায়িনীদিগের হৃদয়ও চঞ্চল। জলে দাগ বসে না, যুবতীর হৃদয়ে বসেকি।”

শৈবালিনীর জলক্রীড়া সম্পর্কে উপরিউক্ত মন্তব্য করা হয়েছে। ভীমা পুষ্করিণীর চারধারে তাল গাছের সারি, পুষ্করিণীর জল কালো, চারিদিকের গজিয়ে ওঠা লতা গুল্ম বৃক্ষের শোভায় পুষ্করিণীটি শোভাময় হয়ে উঠেছে। “সেই আবৃত অল্পান্ধকার মধ্যে শৈবালিনী এবং সুন্দরী ধাতু কলসী হস্তে জলের সঙ্গে ক্রীড়া করিতেছিল।” শৈবালিনীকে বেড় দিয়ে তার বাহুতে, কণ্ঠে, কাঁধে, হৃদয়ে জলতরঙ্গ তুলে তালে তালে নাচতে থাকে, আবার শৈবালিনী জলে কলসী ভাসিয়ে দেয়, চিবুক পর্যন্ত জলে ডুবে থাকে, বিম্বাধরে জল স্পর্শ করে, বক্ষমধ্যে তাকে প্রেরণ করে, সূর্যে দিয়ে ছিটিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে শৈবালিনীর হস্তপদ সঞ্চালনে জ্বল ফোয়ারা কেটে নেচে উঠতে থাকে। এই জলক্রীড়ার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে লেখক উপরিউক্ত মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ জলকল্লোলের মতো উচ্ছল, চঞ্চল শৈবালিনীর যৌবন। সেখানে কোনো রূপ দাগ বা ছায়া পড়ে না। তা রূপকার্থে প্রকাশ করতে উপরিউক্ত মন্তব্য করা হয়েছে।


হায়! কেন আমি ইহাকে বিবাহ করিয়াছি। এ কুসুম, রাজমুকুটে শোভা পাইত। শাস্ত্রানুশীলনে ব্যস্ত ব্রাক্ষ্মণ পণ্ডিতের কুটীরে এ রত্ন আনিলাম কেন?

শৈবালিনী সম্পর্কে চন্দ্রশেখর এই অভিমত পোষণ করেছেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রহ্মচর্যে ব্রতী ছিলেন, মাতৃবিয়োগের পর বিপদে পড়ে বিবাহে সম্মত হয়েছিলেন। সুন্দরী নারী থেকে দূরে অবস্থান করতেন। যাতে অতি সহজেই মোহগ্রস্থ হয়ে না পড়েন। কিন্তু বিধির নির্মম পরিহাসে তিনি শৈবালিনীর রূপ দেখে মোহমুগ্ধ হন। এবং তাকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর শৈবালিনীর প্রতি আরও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু যুবতী সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি যতখানি কর্তব্য সম্পাদন করা আবশ্যক তিনি করেন না। এর জন্য তিনি অনুশোচনায় ভুগতে থাকেন। নিজের পড়াশুনা, দেবাচনা, সাধনা প্রভৃতিতে সারাক্ষণ নিজেকে নিরত রাখায় শৈবালিনী একপ্রকার অবহেলিতা হতে থাকে। একদিন শয্যাপরি শৈবালিনীকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তার অকুল রূপরাশি দেখে চন্দ্রশেখর মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন এবং শৈবালিনীর সুষুপ্তিসুস্থির মুখমণ্ডলের সুন্দর কান্তিতে অশ্রুমোচন করতে করতে তিনি উপরিউক্ত কথাগুলি ভাবতে থাকেন।


“যিনি তীরে উঠিয়াছেন, তাঁহার চরণপ্রান্তে আছাড়িয়া পড়িতেছে-মাথা কুটিতেছে-বুঝি বলিতেছে-দেহি পদপল্লব মুদারম।”

ভীমা পুষ্করিণীতে স্নানরতা শৈবালিনীকে দেখার পর লরেন্স ফষ্টর কুঠিতে ফিরে স্থির ছিলেন না। শৈবালিনীকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় তিনি উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। ইতিমধ্যে ওপর মহল হতে ফষ্টরের ওপর নির্দেশ জারি হল অবিলম্বে পুরন্দর পুরের পাট চুকিয়ে কোলকাতায় ফিরে আসতে। পুরন্দর পুরে অন্য লোক নিযুক্ত হবে, ফক্টরের হাতে এলো উত্তর সুযোগ। কোলকাতায় ফেরার পথে তিনি শৈবালিনীকে সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করলেন। তিনি একদল লেঠেল ঠিক করলেন, তারা রাতের অন্ধকারে চন্দ্রশেখরের বাড়িতে ডাকাতি ফেলে শৈবালিনীকে অপহরণ করে নিয়ে আসবে। ফক্টরের নির্দেশমতো যথাযথভাবে তা সম্পাদিত হল। চন্দ্রশেখরের অনুপস্থিতিতে শৈবালিনী অপহ্তা হয়ে মুঙ্গের গামী নৌকাতে উঠে যে নদীর শোভা দেখতে দেখতে বিমোহিত হয়ে পড়ে। শৈবালিনী দেখছে নদীর জলের তরঙ্গের ওপরে রাজহংসগণ নেচে নেচে খেলা করছে, সুন্দরী নারীরা হেসে খেলে স্নানে নিমগ্না, তাদের মাটীর কলসীগুলি জলের ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। “কখন কখন ঢেউগুলো স্পর্দ্ধা করিয়া সুন্দরীদিগের কাঁধে চড়িয়া বসিতেছে।” লেখক এইরূপ অপরূপ কল্পনার দ্বারা সমুদ্রের জলতরঙ্গকে বর্ণনাদিতে গিয়ে গীতগোবিন্দমের শ্লোক আওড়ালেন। সব মিলিয়ে সমুদ্রের নিসর্গ প্রকৃতিটি এখানে সুন্দরভাবে উদ্‌ঘাটিত হয়েছে।


“আমি যাইব-আমার স্বামীও আমায় গ্রহণ করিবেন, কিন্তু আমার কলঙ্ক কি কখন ঘুচিবে?”

রাতের আকাশে ফষ্টরের লোকজন এসে চন্দ্রশেখরের বাড়িতে এসে ডাকাতি ফেলে শৈবালিনীকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। নিরূপায় অসহায়া শৈবালিনী অগত্যা কোন পথ না পেয়ে ফষ্টরের মুঙ্গের গামী নৌকাতে উঠে মুঙ্গেরে যাত্রা করতে থাকে। চন্দ্রশেখরের প্রতিবেশী ভগিনী সুন্দরী কিন্তু শৈবালিনীর পিছু ছাড়েনি। শৈবালিনীকে রাতের আধারে অপহূতা হতে দেখে সেও ঘর ছাড়ে। শৈবালিনীকে নিয়ে নৌকা নদীর জলের ওপর থেকে যত দ্রুত এগিয়ে চলতে থাকে সুন্দরী নদীর তীর দিয়ে ততই তাদের অনুসরণ করতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর পরদিন প্রাতে ভদ্রহাটির ঘাটে যখন রক্ষকেরা নৌকা নোঙর করলো স্নান খাওয়ার জন্য তখন সুন্দরী নাপিতিনীর ছদ্মবেশ ধারণ করে আলতা বিক্রীর অছিলায় সবাইকে ধোকা দিয়ে নৌকামধ্যে শৈবালিনীর নিকট গিয়ে হাজির হয় এবং শৈবালিনীকে নিজের নাপিতিনীর ছদ্মবেশে পালিয়ে যেতে নির্দেশ দিলে, শৈবালিনী পালাতে অসমর্থ হয় এবং সুন্দরীর গভীর আন্তরিকতা ও অনুরোধ এড়াতে সে উপরিউক্ত কথাগুলি বলে। অবশেষে সে একথাও জানায়– “যাই, দেখি মুঙ্গের কেমন। দেখি, রাজধানীতে ভিক্ষা মেলে কিনা। মরিতে হয়, না হয় মরিব। মরণ তো হাতেই আছে। এখন আমার মরণ বই আর উপায় কী?” অর্থাৎ সে ফিরতে নারাজ। তবে আলোচ্য অংশে এটুকুই স্পষ্ট– সুন্দরর মহানুভবতা অসীম, সে শৈবালিনীর জন্য কতনা বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে, কিন্তু শৈবালিনী সে তুলনায় অতীব দুর্বল স্বভাবের, হয়তো ফষ্টরের প্রতি সে মৃদু দুর্বলতা অনুভব করেছিল। সেজন্যে সে ফিরতে রাজি হয়নি।


“অগ্নি জ্বলিল। পুরাণ, ইতিহাস, কাব্য, অলঙ্কার, ব্যাকরণ ক্রমে ক্রমে সকলই ধরিয়া উঠিল; মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ... একে একে সকলই অগ্নিপৃষ্ট হইয়া জ্বলিতে লাগিল।”

লরেন্স ফষ্টরের লোকজন কর্তৃক রাতের আঁধারে শৈবালিনী অপহূতা হয়েছে। চন্দ্রশেখর তখন মুর্শিদাবাদে। নবাবের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে চন্দ্রশেখর বাড়িতে ফিরতে ফিরতে শৈবালিনীর স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি আত্মগ্লানীতে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন শৈবালিনীর মতো সুন্দরী যুবতীর যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে না পারায়। তিনি এবার মনেপ্রাণে সিদ্ধান্ত নিলেন– “যদি অনন্ত কাল বাঁচি, তবে অনন্তকাল এই মোহে আচ্ছন্ন থাকিতে বাসনা করিব। কতক্ষণে আবার শৈবালিনীকে দেখিব?” তাঁর মনে ভয় হতে থাকে। যদি বাড়িতে ফিরে শৈবালিনীকে না দেখতে পান। যদি তার অসুখ হয়, তিনি কী করবেন। চন্দ্রশেখরের ভয় সত্যে পরিণত হল, বাড়িতে ফিরে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন। এবং উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকেন। চন্দ্রশেখরের সযত্নে প্রতিষ্ঠিত শালগ্রাম শিলা সুন্দরীর পিতৃগৃহে রেখে এলেন। সমস্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্তর একে একে বিতরণ করে দিলেন এবং তাঁর সতি পুস্তকগুলিকে একে একে জড়ো করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন এবং “রাত্রি একপ্রহরে গ্রন্থ দাহ সমাপন করিয়া, চন্দ্রশেখর উত্তরীয় মাত্র গ্রহণ করিয়া, ভদ্রাসন ত্যাগ করিয়া গেলেন। কোথায় গেলেন কেহ জানিল না, কেহ জানিল না, কেহ জিজ্ঞাসা করিল না।” চন্দ্রশেখরের এই আচরণেই প্রমাণ দেয় তিনি একাই শৈবালিনীকে ভালোবেসেছিলেন।


“তুমি নবাবের বেগম হইয়া রাত্রে গোপনে একাকিনী চুরি করিয়া আমার নিকট আসিয়াছ। ইহা নবাব জানিতে পারিলে তোমাকে আমাকে দুইজনকেই বধ করিবেন।”

নবাব মীরকাসেম আলির সেনাপতি গুরগন খাঁ এ কথাগুলি বলেছিলেন নবাবপত্নী দলনী বেগমকে। গুরগন খাঁ জাতিতে আবমানি, ইস্পাহাস তাঁর জন্মস্থান, তিনি একসময় কাপড় বিক্রেতা ছিলেন, অসাধারণ গুণবিশিষ্ট, প্রতিভাশালী ব্যক্তি ছিলেন। আপন প্রতিভার গুণে তিনি সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ইংরাজের দুটি নৌকা মুঙ্গেরের ঘাটে এসে হাজির হলে গুরগন খাঁ নৌকা দুটিকে আটক করে, এবং এর জন্যেই ইংরাজদের সঙ্গে নবাবের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী এই আশঙ্কায় কুলসনের নিকট এ সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে দলনী বেগম অস্থির হয়ে পড়েন এবং এ বিপদ থেকে নিরত থাকতে তিনি নবাবকে না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে তিনি গুরগন খাঁর ডেরাতে আসেন। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে নবাবপত্নীকে এভাবে অতর্কিতে নিজের কাজে আসতে দেখে গুরগন খাঁ উপরিউক্ত কথাগুলি বলেছিলেন। তবে এই পর্বে এটুকু ইঙ্গিত মেলে বিবাহের পূর্বে দলনীর সঙ্গে গুরগন খাঁর একটা গোপন প্রণয় সম্পর্ক ছিল। দলনী নিজেই গুরগন খাঁর উত্তক্ত কথায় বলেছেন– “যদি তিনি জানতেই পারেন, তখন আপনাতে আমাতে যে সম্বন্ধ, তাহা প্রকাশ করিব, তাহা হইলে রাগ করিবার আর কোনো কারণ থাকিবে না।” তবে গুরুগন খাঁ যে সত্যকার সৎচরিত্রবান যুবক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


“স্বামী কাহারও চিরকাল থাকে না। এক স্বামী গেলে আর এক স্বামী হইতে পারে। আমার ভরসা আছে তুমি একদিন ভারতবর্ষের দ্বিতীয় নূরজাহান হইবে।”

গুরগন খাঁ এ কথাগুলি বলেছিলেন দলনী বেগমকে। ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধে বিরত থাকতে দলনী বেগম রাতের অন্ধকারে গুরগন খাঁকে অনুরোধ করতে এলে, গুরগন খাঁ এভাবে নবাবপত্নীকে আসতে দেখে আশাঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তবে আগামী বিপদের সম্ভাবনায় দলনী বেগম রোদন করতে থাকলে গুরগন খাঁ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন– “তুমি কাঁদ কেন? না হয় মীরকাসেম সিংহাসনচ্যুত হইলেন। আমি তোমাকে সঙ্গে করিয়া দেশে লইয়া যাইব।” অবশ্য বিবাহের পূর্বে দলনীর সঙ্গে গুরগন খাঁর গোপন সম্পর্ক ছিল, সেই সুবাদে বোধ করি তিনি একথা বলে থাকবেন। দলনী কিন্তু ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গুরগন খাঁকে বলে ওঠেন “তুমি কী বিস্মৃত হইতেছ যে, মীরকাসেম আমার স্বামী?” দলনী বেগমের এই কথার প্রত্যুত্তরে গুরগন খাঁ উক্ত কথাগুলি বলেছিলেন। অর্থাৎ মহামান্য সেলিম যেমন শের খাঁকে হত্যা করে তাঁর স্ত্রী মেহেরুন্নেসাকে নূরজান বানিয়ে দিল্লির সাম্রাজ্ঞী বানিয়েছিলেন ঠিক অমনটি হয়তো দলনীর ভাগ্যে জুটে যেতে পারে।


“অতি সামান্য ব্যক্তি কর্তৃক লোকের উপকার হইয়া থাকে, তোমরা যদি বিপদগ্রস্থ হইয়া থাকো—সাধ্যানুসারে আমি তোমাদের উপকার করিব।”

ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধে বিরত থাকতে গুরগন খাঁর নিকট রাতের অন্ধকারে গিয়ে অনুরোধ করেও যখন কোনো ফল হল না, উপরন্ত্তু অপমানিতা হয়ে দলনীর ফিরতে হল, তখন ক্ষোভে দুঃখে তিনি কেঁদে ফেলেন। মধ্যরাতে দাসী কুলসমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মুঙ্গের দূর্গে ফিরতে লাগলেন। অকস্মাৎ পথিমধ্যে তাঁরা দেখতে পেলেন– “অন্ধকারে এক দীর্ঘাকার পুরুষমূর্তি গঙ্গাতীরাভিমুখে যাইতেছে।” তখন তারা এক গাছের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন। কিন্তু দীর্ঘাকার পুরুষটি তাঁদের দেখতে পেয়েছিলেন। তাই পুরুষটি তাঁদের কাছে এসে পরিচয় জানতে চাইলেন এবং বললেন– “আমার মতো পথে পথে নিশা জাগরণ করে, এমন হতভাগা কে আছে?” দলনী বেগম জানিয়ে দিলেন– তাঁরা হতভাগিনী, তাঁদের দুঃখের কথা ব্যক্ত করে কী ফল পাবেন। দলনীর এই কথার প্রত্যুত্তরে আগন্তুক উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। এই আগভুক ব্যক্তিটি হলেন– দরিদ্র ব্রাহ্মণ ব্রহ্মচারী, এঁর নাম– রমানন্দ স্বামী। চন্দ্রশেখরের গুরুদেব।


“অনেক দিনের কথা তাঁহার মনে পড়িল— অকস্মাৎ স্মৃতিসাগর মথিত হইয়া তরঙ্গের ওপর তরঙ্গ প্রস্তুত হইতে লাগিল।”

চন্দ্রশেখরের গৃহ হতে লরেন্স ফষ্টরের লোকজন রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে শৈবালিনীকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেলে প্রতিবেশিনী ননদ সুন্দরী তার পিছু নিতে ভোলেনি। কঠোর পরিশ্রমে নাপিতিনীর ছদ্মবেশে সে শৈবালিনীর নিকট পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু শৈবালিনী ইংরাজ নৌকা থেকে অবতরণ করতে অসম্মত হয়। সুন্দরী উপায়ান্তর না দেখে ফিরে এসেছিল বটে, কিন্তু তার ভগিনীপতি প্রতাপের স্মরণাপন্ন হতে পেছপা হয়নি। প্রতাপ সুন্দরীর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে নৌকা যোগে লরেন্স ফষ্টরের পশ্চাতে ধাবিত হয়। পরম কৌশলে খণ্ডযুদ্ধের দ্বারা মুঙ্গেরের নিকট কসাড় বনের ধারে ইংরাজ নৌকা থেকে প্রতাপ শৈবালিনীকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। প্রতাপ আশ্রয় নিয়েছিলেন রমানন্দ স্বামীর গৃহে। প্রতাপের শয্যায় শৈবালিনী শায়িতা হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রতাপ নিজের বিছানার ওপর তাঁর বাল্যপ্রণয়িনীকে এভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তিনি শৈবালিনীর– "সৌন্দর্যে মুগ্ধ হইয়া, বা ইন্দ্রিয় বশ্যতা প্রযুক্ত যে, তাঁহার চক্ষু ফিরিল না এমত নহে—কেবল অন্যমনবশত তিনি বিমুগ্ধের ন্যায় চাহিয়া রহিলেন। এই অবস্থায় প্রতাপের মনে উপরিউক্ত কথাগুলি মনে পড়ে যায়।" অর্থাৎ তিনি এখনো শৈবালিনীকে ভালোবাসেন।


“তাও করিতাম—কেবল স্ত্রীহত্যার ভয় করি নাই; কিন্তু তোমার মরণই ভালো।”

লরেন্স ফষ্টরের নৌকা হতে অপহূতা শৈবালিনীকে উদ্ধার করার পর রমানন্দের গৃহে আপন শয্যায় অধিষ্ঠাতা ঘুমন্ত শৈবালিনীকে দেখে প্রতাপের মনে অতীতের কথা, শৈবালিনীর সঙ্গে তাঁর প্রেম-প্রণয়ের দিনগুলির কথা। প্রতাপ জেনেছিল শৈবালিনী নিদ্রিতা, তাই তিনি শৈবালিনীকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে ব্যাপৃত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু “শৈবালিনী নিদ্রা যান নাই—চক্ষু মুদিয়া আপনার অবস্থা চিন্তা করিতেছিলেন।” যখন তিনি চক্ষু খুলিলেন তখন প্রতাপকে দেখে– 'এ কী এ? কে তুমি' বলে আর্তচিৎকারে মূর্ছা গিয়েছিলেন। পরক্ষণেই শৈবালিনী অজ্ঞান অবস্থায় জিজ্ঞাসা করতে থাকেন— “কে তুমি? প্রতাপ? না, কোনো দেবতা ছলনা করিতে আসিয়াছো।” অর্থাৎ শৈবালিনী জেনেছিলেন– প্রতাপ জলে ডুবে মরেছে, তিনি এভাবে তাঁর সম্মুখে আসতে পারেন না। অতঃপর তাঁর এখানে আগমনের সম্পর্কে প্রতাপ সবিস্তারে বর্ণনা দিলে, শৈবালিনী অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন– “যদি ম্লেচ্ছের ঘরে থাকা, আমার দুর্ভাগ্য মনে করিয়াছিলে তবে আমাকে সেইখানে মারিয়া ফেলিলে না কেন? তোমাদের হাতে তো বন্দুক ছিল।” শৈবালিনীর এই কথার প্রত্যুত্তরে প্রতাপ উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। অর্থাৎ শৈবালিনীকে পাপীষ্ঠারূপে কল্পনা করেছিলেন প্রতাপ।


“প্রতাপ আমার কে? আমি তাহার চক্ষে পাপিষ্ঠা –সে আমার কে? কে তাহা জানি না...।”

ফষ্টরের নৌকায় সিপাহীদের মেরে শৈবালিনীকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে প্রতাপ, এই সংবাদ এক আহত সৈনিক ইংরাজদের নিকট প্রেরণ করেছে এবং শৈবালিনীকে নিয়ে তিনি অরণ্যমধ্যে কোন ঘরে আত্মগোপন করবেন তাও তাঁর পিছু নিয়ে আহত সৈনিকটি জেনে সে তথ্যও ইংরাজদের নিকট পেশ করেছে। ইংরাজ সেই রাতে আর বিলম্ব না করে অতর্কিতে ব্রহ্মচারীর আশ্রম আক্রমণ করে। সেই রাতে ব্রহ্মচারী কর্তৃক দলনী ও কুলসম আরেকটি গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইংরাজ সৈন্যরা শৈবালিনীকে নিতে এসে দলনীকে শৈবালিনী ভেবে তাকে ও প্রতাপকে বেঁধে নিয়ে যায়। অন্য ঘর থেকে শৈবালিনী জানালা দিয়ে এসকল স্বচক্ষে দেখেছেন। শৈবালিনী আর বাঁচতে চান না। তিনি মরতে চান। তবে তাঁর আশা প্রতাপের কী হয় তা না জেনে তিনি মরবেন না। এমন একটা পরিস্থিতিতে শৈবালিনী উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। এবং প্রতাপ সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেছিলেন– “সে শৈবালিনী পতঙ্গের জ্বলন্ত বহ্নি – সে এই সংসার প্রান্তরে আমার পক্ষে নিদাঘের প্রথম বিদ্যুৎ - সে আমার মৃত্যু।” অর্থাৎ প্রতাপ তাঁর জীবনের সর্বনাশের মূলে।


“তাঁহাকে আমি কখনো ভালোবাসি নাই—কখনো ভালোবাসিতে পারিব না।”

স্বামী চন্দ্রশেখর সম্পর্কে শৈবালিনীর এই অভিমত। ইংরাজরা প্রতাপকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দেখে শৈবালিনী অতীতের কথা রোমন্থন করতে করতে কেঁদে ফেলেছিলেন। এবং নিজেকে নিঃশেষ করার জন্য তিনি তাঁর একখানা লুকানো ছুরিকা বুকে ধারণ করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু মরা তার হয় না। শৈবালিনী ভাবতে থাকেন— “মরিব? না—আজ নহে৷ মরিতো সেই বেদগ্রামে গিয়া মরিব। সুন্দরীকে বলিব যে, আমার জাতি নাই, কুল নাই, কিন্তু এক পাপে আমি পাপিষ্ঠা নহি। তারপর মরিব।” তাঁর মনে পড়ে গেল স্বামী চন্দ্রশেখরের কথা। স্বামীর কথায় তাঁর শিরায় শিরায় আগুন জ্বলে উঠল। “আমি তাঁহার যোগ্য নহি বলিয়া আমি তাঁহাকে ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি।” শৈবালিনী মনেপ্রাণে জেনেছেন তিনি চন্দ্রশেখরের কেউ নয়, পুঁথিই চন্দ্রশেখরের সব। এইরূপ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উপরিউক্ত কথাগুলি শৈবালিনী অস্ফুটে বলে ফেলেন। এই কথাগুলির মধ্য দিয়ে স্পষ্টই প্রতীয়োমান- চন্দ্রশেখরকে স্বামীরূপে পেয়ে শৈবালিনী অতৃপ্ত হৃদয়া।


“দুঃখ বলিয়া একটা স্বতন্ত্র পদার্থ নাই। সুখ-দুঃখতুল্য বা বিত্তের কাছে একই। সব যদি প্রভেদ করো, তবে মা হারা পুন্যাত্মা বা সুখী বলিয়া খ্যাত, তাহাদের চিরদুঃখী বলিতে হয়।”

এ উক্তি বা উপদেশ স্বামী রমানন্দের। তিনি কথাগুলো বলেছেন শিষ্য চন্দ্রশেখরকে। নবাব কাসেম খাঁর নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়িতে ফিরে চন্দ্রশেখর যখন জানলেন ইংরাজ কর্তৃক শৈবালিনী অপহ্তা হয়েছে তখন তাঁর দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য জিনিষপত্র সমস্তই প্রতিবেশীদের বিলিয়ে দিয়ে, সারাজীবন ধরে সঞ্চিত শাস্ত্রগ্রন্থাদি অগ্নিতে ভষ্মীভূত করে রাতের অন্ধকারে কাউকে না জানিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এসে হাজির হয়েছিলেন মুঙ্গেরে গুরুদেব রমানন্দ স্বামীর আশ্রমে। তিনি তাঁর সাংসারিক বিপর্যয়ের কথা গুরুদেবকে জানিয়ে দুঃখে শোকে ভেঙে পড়লে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে রমানন্দ স্বামী উক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। এবং রমানন্দ স্বামী উদাহরণস্বরূপ সযাতি, হরিশ্চন্দ্র, দশরথ রামচন্দ্র, নলরাজা, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পৌরাণিক রাজার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে চন্দ্রশেখরকে শান্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চন্দ্রশেখর গুরুদেবের উপদেশ মতো মনে মনে প্রশাস্তি উপলব্ধি করে ঈশ্বর সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।


“কবিগণ আশার প্রশংসায় মুগ্ধ হন। আশা, সংসারের অনেক দুঃখের কারণ বটে, কিন্তু আশাই দুঃখের মূল। যত পাপ হতে হয়, সকলই লাভের আশায়।”

শৈবালিনী সম্পর্কে এই অভিমত অভিব্যক্ত হয়েছে। ইংরাজদের সঙ্গে যুদ্ধে বিরত থাকতে দলনী বেগম গুরগন খাঁর নিকট আবেদন জানাতে এসে ব্যর্থ হয়ে মধ্যরাতের আধারে কুলসম সহ তিনি যখন মুঙ্গেরের রাজপথে বিচরণ করছিলেন, তখন রমানন্দের সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। রমানন্দ স্বামী রাতটুকুর জন্যে তাঁর আশ্রমে স্ত্রীলোক দুটিকে আশ্রয় দিলেন এবং পরদিন তাঁদেরকে নিয়ে যাবার জন্যে রমানন্দ স্বামী নবাবকে পত্র লেখেন। নবাব বুঝলেন কুলসম সহ দলনী বেগম প্রতাপ রায়ের বাসায় আছেন, তাই তিনি দলনী বেগমকে নিয়ে যেতে শিবিকা পাঠালেন। শিবিকা এলো বটে, কিন্তু দলনীকে পাওয়া গেল না। মধ্যরাতে তাকে ও প্রতাপকে ইংরাজ বন্দি করে নিয়ে গেছেন। শৈবালিনী সমস্তই বুঝলেন জানলে এবং নীরবে শিবিকাতে গিয়ে আরোহণ করলেন দলনী হয়ে। কারণ আশা নামক মোহ তাঁকে আশ্রয় করেছে। আশায় আশায় তিনি বিপথে পা বাড়ালেন। তিনি নবাবের সান্নিধ্য লাভ করবেন এই প্রত্যাশায় বিনা বাধায় তিনি শিবিকাকে আরোহণ করে সোজা কেল্লায় চলে এলেন। শৈবালিনীর এই কৃতকর্ম সম্পর্কে উক্ত মন্তব্য করা হয়েছে।


“সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। বিশেষ সুন্দর মুখের অধিকারী যদি যুবতী স্ত্রী হয়, তবে সে মুখ অমোঘ অস্ত্র।"

শৈবালিনী রূপের প্রশংসায় এই অভিমত করা হয়েছে। নবাবের প্রেরিত শিবিকায় দলনীর পরিবর্তে শৈবালিনী এক অনির্দিষ্ট আশা মোহাবিষ্ট হয়ে নবাবের নিকট হাজির হন। নিজের পরিচয় দেন রূপসী নামে, এবং প্রতাপ তাঁর স্বামী তাও ছলনার দ্বারা ব্যাখ্যা করেন। প্রতাপকে উদ্ধারের নিমিত্তে শৈবালিনী নবাবকে রাজি করিয়ে গোপনে কয়েক সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে তিনি পথে নামেন, এবং কোলকাতাগামী ইংরাজ নৌকার পিছু ধাওয়া করতে থাকেন। যে নৌকা করে প্রতাপকে নিয়ে কোলকাতায় যাওয়া হচ্ছিল বিচারের জন্য। ইংরাজ-এর নৌকা দেখতে পেয়ে শৈবালিনী ছলনার আশ্রয় নিলেন, তীরে বসে কাঁদতে থাকেন। শৈবালিনীর উচ্চৈস্বরে কান্না শুনে ইংরাজ সায়েব অমিয়ট নৌকা থামিয়ে শৈবালিনীকে নৌকায় তুলে নেন, এবং তাঁর কান্নার আসল পথ অনুধাবন করতে না পেরে ইংরাজ সায়েব বা বাঙালি খানসামার ওপর শৈবালিনীর দায়ভার নস্ত করলেন। তারা শৈবালিনীরূপে প্রমুগ্ধ হলেন এবং বুঝলেন– শৈবালিনী ক্ষুধিতা কিছু খেতে চান, কিন্তু ব্রাহ্মণের অন্ন ছাড়া তিনি খাবেন না। শৈবালিনীকে অন্নদানের দায়ভার পড়ল প্রতাপের ওপর। খানসামারা ইংরাজ সায়েবের নিকট অনুমতি নিয়ে শৈবালিনীর যাবতীয় সাহায্য করতে লাগলো। তাদের উদ্দেশ্য শৈবালিনী রূপে তারা মুগ্ধ, খাওয়াদাওয়ার পর খানসামা মহলে তাঁকে নিয়ে গিয়ে বসাবে এবং একটু স্ফূর্তি করবে। শৈবালিনীর এই যে দুর্জয় সাধনা প্রসঙ্গে উপরিউক্ত মন্তব্য করা হয়েছে।


“এ জলের ত তল আছে, – আমি যে অতল জলে ভাসিতেছি।”

শৈবালিনীর ভাবনায় এই কথাগুলি ধরা পড়েছে। নিজের রূপের মোহ বিস্তার করে ইংরাজ নৌকার বাঙালি খানসামারদের বশীভূত করে শৈবালিনীর বাদী প্রতাপের নিকট হাজির হয়েছিলেন। এবং ব্রাহ্মণের ভাত খাবার মিথ্যা অজুহাতে প্রতাপের বন্দিত্ব মোচন করে উভয়ে একসাথে ইংরাজ নৌকা থেকে পালাতে জ্বলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। বহুদূর পর্যন্ত ইংরাজ নৌকা তাঁদেরকে পুনঃ ধরতে পিছু ধাওয়া করলেও তাঁদের আর ধরা গেল না। দুজনে সন্তরণে পটু। তাঁরা সাঁতরে অনেকদূর গেল। এ সাঁতার যে তাঁদের বড়ো সুখের। নদীর জলে ভাসতে ভাসতে প্রতাপের মনে হল– “সাঁতার? কী হবে ক্ষুদ্র পার্থিব নদীতে সাঁতার? জন্মিয়া অবধি, এই দূরস্ত কাল সমুদ্রে সাঁতার দিতেছি, তরঙ্গ ঠেলিয়া তরঙ্গের ওপর ফেলিতেছি– তৃণবত্তরঙ্গে তরঙ্গে বেড়াইতেছি—আবার সাঁতার কী?” তথাপি, জীবনের প্রতি তাঁর একপ্রকার বিদ্বেষ এসে গেছে, শৈবালিনীকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে প্রতাপ এমনভাবে সাঁতার দিয়েছিলেন। আজ বাঁচতে তিনি যে শৈবালিনীর সঙ্গে সাঁতার দিচ্ছেন, কিন্তু শৈবালিনী ভাবতে থাকতে উপরিউক্ত কথাগুলি, অর্থাৎ তিনি অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়েছেন।


“তুমি যদি আবার সেই নাম ধরিয়া আজ না ডাকিতে, তবে আজ তার শোধ দিতাম। কেন ডাকিলে?”

এ উক্তি শৈবালিনীর। প্রতাপকে তিনি একথা বলেছিলেন। ইংরাজ নৌকা থেকে উভয়ে পালানোর জন্য নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার দিতে দিতে ইংরাজদের নাগালের বাইরে এসে অকস্মাৎ কী ভেবে প্রতাপ উচ্চৈস্বরে ডাক দিল—'শৈবালিনী শৈ'। সন্তরণরত শৈবালিনীর সে ডাকে হৃদয় প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। বাল্যকালে প্রতাপ তাঁকে 'শৈ' বা 'সই' বলে ডাকত। আজ এতদিন পর এই বিপদের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রতাপের কণ্ঠের সেই প্রিয় সম্বোধনে শৈবালিনী আত্মহারা হয়ে উঠলেন। কতকাল পরে। “শৈবালিনী কত বৎসর সই শব্দ শুনে নাই, শৈবালিনীর সেই এক মন্বন্তর। এখন শুনিয়া শৈবালিনী সেই অনন্ত জলরাশির মধ্যে চক্ষু মুদিল।” প্রতাপ স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি। তাঁরা এমনি করে আর একদিন এমনভাবে সাঁতার দিয়েছিলেন মৃত্যুর জন্য। প্রতাপ বললেন “মনে পড়ে? তুমি ডুবিতে পারিলে না—আমি ডুবিলাম?” প্রতাপের এই কথার প্রত্যুত্তরে শৈবালিনী উক্ত কথা কটি বলেছিলেন, এবং বোঝাতে চাইলেন এখনো তাঁরা সমভাবেই আসক্ত।


“আজি হইতে তোমাকে ভুলিব। আজি হইতে আমার সর্বসুখে জলাঞ্জলি। আজি হইতে আমি মনকে দমন করিব। আজি হইতে শৈবালিনী মরিল।"

শৈবালিনী এই কথাগুলি প্রতাপকে বলেছিলেন। ইংরাজ নৌকা থেকে পালাতে তাঁরা নদীর জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁরা একসাথে নদীতে সাঁতার দিয়েছিলেন একটা বড়ো কাঠের গুঁড়িকে অবলম্বন করে। এমনি করে পূর্বে তাঁরা একদিন নদীতে সাঁতার দিয়েছিলেন আত্মহত্যার তাগিদে। আজ তাঁদের এ সাঁতার বাঁচার তাগিদে। দীর্ঘক্ষণ গঙ্গাবক্ষে সাঁতার দিতে দিতে তাদের মধ্যে নানান কথা হয়েছিল। একসময় প্রতাপ শৈবালিনীকে শপথ করতে বলে তাঁকে ভুলবার জন্য। শৈবালিনী রাজি হয় না। তাঁর উক্তি— “তোমার ঐশ্বর্য আছে-বল আছে-কীর্তি আছে বন্ধু আছে-ভরসা আছে-রূপসী আছে-আমার কে আছে প্রতাপ?” প্রতাপ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন দুজনেই একসাথে জলে ডুবে মরবেন তখন শৈবালিনীর মনে এক শুভবুদ্ধির উদয় হল—আমি মরি তাহাতে ক্ষতি কী? কিন্তু আমার জন্য প্রতাপ মরিবে কেন? এইরূপ ভেবে শৈবালিনী প্রতাপকে নিয়ে আর কোনোদিন ভাববেনা শপথ করে উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। এই পর্বে উভয় চরিত্রের অবচেতন মন বিশেষভাবে আলোড়িত হয়েছে।


“মরুভূমে থাকিলে কোনো তৃষিত পথিক সুশীতল স্বচ্ছ সুবাসিত বারি দেখিয়া পান না করিয়া থাকিতে পারে?”

শৈবালিনীর সাময়িক অবস্থার বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখকের এই অভিমত। ইংরাজ নৌকা থেকে পালিয়ে শৈবালিনী ও প্রতাপ দীর্ঘক্ষণ জলে সন্তরণ কালে পারস্পরিক আলোচনায় এটুকুই স্থির হল—শৈবালিনী প্রতাপের চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলবে। পরে তাঁরা তীরে উঠে পূর্বে প্রস্তুত করা ছিপে উঠে দ্রুত ইংরাজ অনুচরদের নাগালের বাইরে চলে এসেছিলেন। বিশ্রামের প্রত্যাশায় নদীতীরের এক নিভৃত স্থানে প্রতাপ ছিপখানা নোঙর করেছিলেন। “সেইসময়ে, শৈবালিনী, অলক্ষে ছিপ হইতে পালাইয়াছিল। এবার শৈবালিনী অসভিপ্রায়ে পলায়ন করে নাই। যে ভয়ে দহামান অরণ্য হইতে অরণ্যচর জীব পলায়ন করে শৈবালিনী সেই ভয়ে প্রতাপের সংসর্গ হইতে পলায়ন করিয়াছিল।” প্রাণের ভয়ে শৈবালিনী সুখ, সৌন্দর্য, প্রণয় পরিপূর্ণ সংসার হতে পালালেন। কারণ, সুখ, সৌন্দর্য, প্রণয়, প্রতাপ এ সবে শৈবালিনীর আর কোনো অধিকার নেই। আর কোনো আশা নেই। কিন্তু নিকটে থাকতে কি আকাঙ্ক্ষা পরিহার করে? এই পরিস্থিতিতে উক্ত মন্তব্য করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতাপকে নিষ্কলঙ্ক করতে প্রতাপ সবার অলক্ষ্যে পালি পর্বতে আরোহণ করতে থাকলো।


“তুমি কে? দেবতা না মনুষ্য? মনুষ্য হইতে শৈবালিনীর ভয় নাই—কিন্তু দেবতা হইতে ভয় আছে; কেননা, দেবতা দণ্ড বিধাতা।”

ইংরজের নৌকা থেকে পালিয়ে প্রতাপ শৈবালিনী যখন দীর্ঘক্ষণ গঙ্গাবক্ষে সাঁতার দেন তখন দূর থেকে তীরে দাঁড়িয়ে রমানন্দ স্বামী তাঁদেরকে নিরীক্ষণ করতে শুরু করেছিলেন। তারপর যখন প্রতাপ শৈবালিনী তীরে উঠে ছিপে আরোহণ করে যাত্রা করেছিলেন তখনও রমানন্দ তাঁদের পিছু নিতে ভোলেন নি। নদীর নির্জন তীরে প্রতাপ ছিপখানা নোঙর করলে প্রতাপের সংস্পর্শ ত্যাগ করতে শৈবালিনী সবার অজান্তে ছিপ থেকে পালিয়ে পর্বত আরোহণে প্রমত্ত হলেও রমানন্দ স্বামীর দৃষ্টিকে তিনি ফাঁকি দিতে পারেন নি। পর্বতের বন্ধুর পাদদেশে ঘন অরণ্য শ্রেণির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শৈবালিনী ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে সেই শ্বাপদসঙ্কুল দুর্গম স্থানে শৈবালিনী ভয়ে জড়সড় হয়ে মৃত্যুকে কামনা করতে থাকেন। এমনি সময়ে প্রচণ্ড রূপে ঝড় জল শুরু হলে শৈবালিনীর দশা আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এমত সময়ে সেই মনুষ্যশূন্য পর্বতে, সেই অগম্য বনমধ্যে, সেই মহাঘোর অন্ধকারে, কোনো মনুষ্য শৈবালিনীর গায়ে হাত দিল। এই মনুষ্যের স্পর্শে সচকিত শৈবালিনী উপরিউক্ত মন্তব্য করেছিলেন।


“আমিই শৈবালিনীর মৃত্যুর কারণ।”

এ উক্তি প্রতাপের। প্রতাপ ইংরাজ সায়েবদের চোখে ধুলো দিয়ে শৈবালিনীকে নিয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে নিরাপদ স্থানে চলে আসেন। পরে পূর্বনির্ধারিত ছিপে উঠে তাঁরা একেবারে ইংরাজদের নাগালের বাইরে চলে আসেন। নদীর তীরবর্তী এক নির্জন স্থানে এসে প্রতাপ বিশ্রামের তাগিদে ছিপখানা নোঙর করেন। এবং অতি অল্প মধ্যে প্রতাপ ছিপমধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। রাত্রি প্রভাত হলে প্রতাপ ঘুম ভেঙে তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিলেন। গঙ্গাতীরে অনুসন্ধান করিলেন, পাইলেন না। অনেক বেলা হইল। প্রতাপ নিরাশ হইয়া সিদ্ধান্ত করিলেন যে, “শৈবালিনী ডুবিয়া মরিয়াছে, প্রতাপ জানিতেন, এখন তাহার ডুবিয়া মরা অসম্ভব নহে।” এইরূপ সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শৈবালিনীর মৃত্যুর জন্য প্রতাপ নিজেকেই দোষারোপ করতে উপরিউক্ত মন্তব্য করেন।


“আমার কী হবে! আমার উদ্ধারের কী উপায় নাই?”

এ উক্তি শৈবালিনীর। ইংরজের নৌকা হতে পলায়নের পর প্রতাপের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে বহুক্ষণ সাঁতার দিয়ে শৈবালিনী অবশেষে তীরে উঠে পূর্বনির্দিষ্ট ছিপে উঠে পালিয়ে এসেছিলেন। বিশ্রামের তাগিদে নদীর কোনো এক নির্জন স্থানে ছিপ থামিয়ে প্রতাপ গভীর নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়লে শৈবালিনী ইহজীবনে প্রতাপকে ভুলতে সবার অলক্ষ্যে ছিপ থেকে নেমে এসে শ্বাপদসংকুল পর্বতারণ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু দুর্গম স্থানের করাল বিভৎস চিত্রে তিনি যখন প্রায় মুহ্যমান, তখন দূর থেকে নিরীক্ষণকারী রমানন্দ স্বামী শৈবালিনীকে নিয়ে এক পর্বতগুহায় রেখে আসেন। একাকিনী শৈবালিনী সেই দুর্গম পর্বতগুহায় যখন মৃতকল্পপ্রায়, তখন শৈবালিনী বাঁচার তাগিদে শেষ চেষ্টাস্বরূপ আতচীৎকার করে ওঠেন— “রক্ষা করো! এ নরক! এখান হইতে উদ্ধারের কি উপায় নাই?” মহাকায় পুরুষ শৈবালিনীকে আশ্বস্ত করতে বলে ওঠেন—আছে। আশার বাণী শুনে শৈবালিনী উপরিউক্ত কথাগুলি বলেন।


“সরোবরে কদম, মৃণালে কণ্টক, পবনে ধূলি, অনলে পতঙ্গ। আমি মজিলাম—মরিলাম না কেন?”

গৃহামধ্যে শৈবালিনী এ উক্তি মনে মনে পোষণ করেছেন। প্রতাপের সঙ্গ ইহজীবনে ত্যাগ করতে শৈবালিনী নদীতীরের ছিপ হতে পালিয়ে পর্বতের দুর্গম স্থানে আত্মগোপন করতে গিয়ে বিষম বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। রমানন্দ স্বামীর তৎপরতায় তিনি এক গুহামধ্যে আনীতা হয়েছিলেন। নির্জন গুহায় তাঁর অবস্থানের হেতু স্বরূপ রমানন্দ স্বামী জানালেন শৈবালিনী এখন পাপিষ্ঠা। তাঁর পাপস্খলনের নিমিত্তে বহু সাধনার প্রয়োজন। এ কার্যে গৃহামধ্যে প্রায় দীর্ঘ দু বছর সন্ন্যাসিনীর জীবন গ্রহণ করতে হবে। তারপর পরিশুদ্ধা হয়ে তিনি তাঁর স্বামী সংসারকে ফিরে পাবেন, তাঁকে হতে হবে ভিক্ষান্ন জীবি। কঠোর তপস্যায় প্রায়শ্চিত্য সমাপন হলে পর তিনি তাঁর স্বামীর দর্শন পাবেন। শৈবালিনী সম্মত হয়ে নিজেকে কঠোর তপস্যায় নিরত করলেন। তিনি রমানন্দ স্বামীর নির্দেশমতো সপ্তদিবানিশি গুহা হতে বার হলেন না। সামান্য ফলমূল আহার করেছিলেন। কিন্তু প্রায় অনশনে সেই অন্ধকারে অনন্যেন্দ্রিয়বৃত্তি হইয়া স্বামীর চিন্তা করিতে লাগিলেন। এই স্বামীর চিন্তামগ্ন থেকে তিনি তাঁর অতীতের অপকর্মের জন্য মনে মনে অনুশোচনা করতে করতে উক্ত কথাগুলি ভাবতে শুরু করেছিলেন।


“আমি ইচ্ছাপূর্বক ফষ্টরের সঙ্গে চলিয়া আসিয়াছিলাম। ডাকাইতির পূর্বে ফষ্টর আমার নিকট লোক প্রেরণ করিয়াছিল।”

শৈবালিনী এ কথাগুলি বলেছিলেন স্বামী চন্দ্রশেখরকে। রমানন্দ স্বামী কর্তৃক দুর্গম গুহামধ্যে সংস্থাপিত হয়ে শৈবালিনী কঠোর তপশ্চর্যার মধ্যে স্বামীকে অনুধ্যান করতে থাকেন। একসময় আহারক্লিষ্টা হয়ে তিনি মূর্ছা যান। স্বপ্নে তিনি নরকদর্শন করতে থাকেন, নানান বিভৎস দৃশ্য একের পর এক দেখতে থাকেন। পরে চক্ষুরুন্মিলন করে তিনি দেখতে পান স্বামী চন্দ্রশেখরের সঙ্গে তিনি শুয়ে আছেন। চন্দ্রশেখর জানতে চাইলেন শৈবালিনী তাঁকে দেখতে চেয়েছিল কেন। উত্তরে শৈবালিনী জানিয়েছিলেন অল্পদিন বাঁচিব-মরিবার আগে তোমাকে একবার দেখিতে সাধ হইয়াছিল। এ কথায় কে বিশ্বাস করিবে? কেন বিশ্বাস করিবে? যে ভ্রষ্টা হইয়া স্বামী ত্যাগ করিয়া আসিয়াছে, তাহার আবার স্বামী দেখিতে সাধ কী?” চন্দ্রশেখর শৈবালিনীর এ কথা মানতে চাইলেন না। তিনি বললেন— “তোমাকে বলপূর্বক ধরিয়া আনিয়াছিল।” প্রত্যুত্তরে শৈবালিনী উক্ত কথাগুলি বলেছিলেন। এই বক্তব্যে তাঁর দ্বিচারিতাকেই স্পষ্ট করে তোলে।


“যে যাহার জন্য ব্যাকুল হয়, সে তাহার নামেই মুগ্ধ হয়, আশায় অন্ধ হইয়া বিচারে পরান্মুখ হয়।”

নবাব মীরকাসেমের নিকট যখন শৈবালিনী কর্তৃক সংবাদ পৌঁছল দলনীকে ইংরাজরা বন্দিনী করে নিয়ে গেছে, তখন তিনি এর উপযুক্ত প্রতিবিধানার্থে একটা সন্ধি স্থাপনের অছিলায় তকি খাঁকে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। সন্ধি স্থাপন তো হল না, উপরন্তু উভয়ের খণ্ডযুদ্ধে ইংরাজ সায়েব গলষ্টন ও জনসন প্রাণ হারালেন। ইংরাজদের অপর এক নৌকাতে ছিলেন। ফষ্টর। তিনি কোনোক্রমে প্রতাপ কর্তৃক আঘাতপ্রাপ্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে দ্রুত নৌকা চালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সেই নৌকাতে ছিলেন বন্দিনীদ্বয় দলনী ও কুলসম। তাঁরা শুনেছিলেন, নবাব আসছেন তাঁদের উদ্ধার করতে। ফষ্টর প্রাণভয়ে নৌকাযোগে দ্রুত পলায়নের সময় দেখতে পেলেন একটি ক্ষুদ্র নৌকা তাঁদের পিছু নিয়েছে। দলনীকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হলেন—“উহা তোমাদের লোকের নৌকা, তোমাকে কাড়িয়া লইবার জন্য আসিতেছে।” দলনী ফক্টরের কথায় উৎকণ্ঠিত হয়ে তীরে নেমে যেতে চাইলেন। কোনো গণ্ডগোল হবার পূর্বেই তিনি মুক্তি নিতে চাইলেন। ফক্টরও আর বিবেচনার অবকাশ না রেখে বিপদকে এড়াতে দলনীকে নামিয়ে দিলে নদীর তীরে। অর্থাৎ নবাবের জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠে এমন একটা অবিবেচক কাজ করে বসলেন। কার্যত তিনি নির্জনে বিসর্জিতা হলেন।


“আমাকে ছাড়িয়া দাও। আমি কোলকাতায় গিয়া অমিয়ট সাহেবের সুহৃদগণের নিকট বাস করিব। যদি না ছাড়িয়া দাও, তবে আমি পলাইয়া যাইব। যদি মুঙ্গেরে পাঠাও, তবে আত্মহত্যা করিব।”

নবাব মীরকাসেম যখন জানলেন দলনী বেগম ইংরাজদের নিকট বন্দিনী হয়ে আছেন, তিনি ক্রোধান্ধ হয়ে তকি খাঁকে গুপ্ত আদেশ দেন– অতর্কিতে ইংরাজদের আক্রমণ করে তাঁদের নৌকা হতে দলনী বেগমকে উদ্ধার করে যেন মুঙ্গেরে পাঠানো হয়। দলনীর বেগমের প্রতি তকি খাঁর ছিল প্রবল আসক্তি। তিনি সুযোগটা কাজে লাগাতে ইংরাজদের সংগে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হন এবং যুদ্ধে অমিয়ট ও জনসন সাহেবদ্বয়কে হত্যা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় নৌকাতে দলনী বেগমকে তিনি পেলেন না। মহা বিপদ! তকি খাঁ মিথ্যা সংবাদ প্রেরণ করে নবাবকে প্ররোচিত করতে সচেষ্ট হলেন। পত্র লিখলেন নবাবকে– অমিয়টের নৌকায় দলনীকে পাওয়া গেছে এবং তাঁকে যথা সম্মানপূর্বক কেল্লার মধ্যে রাখা হয়েছে। কিন্তু নবাবের আদেশ ব্যতীত তাঁকে এখনই নবাবের নিকট পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ ইংরাজদের খানসামা, নাবিক, সিপাহী যাঁরা জীবিত আছেন তাদের কাছে শোনা গেছে। “বেগম অমিয়টের উপপত্নীস্বরূপ নৌকায় বাস করিতেন। উভয়ে একশয্যায় শয়ন করিতেন।” এবং দলনী বেগমের জবানবন্দিতে উপরিউক্ত কথাগুলি লিখে তকি খাঁ কার্যত নবাবকে বিভ্রান্ত করেন। পরবর্তীকালে ভুল বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে নবাব চরম সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন।


“আমি এতকাল সর্বশাস্ত্র অধ্যয়ন করিলাম, সর্বপ্রকার মনুষ্যের সহিত আলাপ করিলাম, কিন্তু সকলই বৃথা। এই বালিকার মনের কথা বুঝিতে পারিলাম না। এ সমুদ্রের কী তল নাই?”

এ উক্তি রমানন্দ স্বামীর, শৈবালিনী সম্পর্কে তাঁর এই অভিমত। যে রাত্রে প্রতাপ ও শৈবালিনী পলায়নের নিমিত্তে গঙ্গাবক্ষে নৌকা থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন, সে রাত্রে চন্দ্রশেখর তাঁদের অনুসরণ করেছিলেন। নদীতীরের সেইসময় চন্দ্রশেখরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল গুরুদেব রমানন্দ স্বামীর। উভয়েই আলাপ আলোচনায় স্থির করলেন—শৈবালিনীর গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখা জরুরী। তাঁরা প্রতাপের নৌকাকে অনুসরণ করতে থাকেন, তারপর দেখলেন নদীতীরের এক নির্জন স্থানে বিশ্রামের জন্য প্রতাপ নৌকা নোঙর করেছেন, অতঃপর শেষ রাত্রে লক্ষ্য করলেন– “শৈবালিনী নৌকা হইতে উঠিয়া গেল। ক্রমে তীরবনমধ্যে প্রবেশ করিয়া অদৃশ্য হইল। তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকলেন কোন উদ্দেশ্যে শৈবালিনী এমনভাবে পলায়ন করলেন তা জানতে। পরে অরণ্যমধ্য হতে মূর্ছিতা শৈবালিনীকে নিয়ে রমানন্দ স্বামীর নির্দেশে গুহামধ্যে প্রবেশ করলে শৈবালিনীর এই অবস্থাস্তর দেখে রমানন্দ স্বামী উপরিউক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। এতে শৈবালিনীর দোলাচল চিত্রবৃত্তিকেই নির্দেশ করা হয়েছে।


“যে তোমার মতো পাপিষ্ঠের কাছে প্রাণদান গ্রহণ করে, সে তোমার অপেক্ষাও অধম - বিষ আন।”

দলনী বেগম এই কথাগুলি বলেছিলেন মহম্মদ তকি খাঁকে। দলনীর প্রতি ছিল তকি খাঁর গোপন আসক্তি। নবাবের নিকট নির্দেশ পেয়ে তিনি ইংরাজ সায়েবদের নৌকা আক্রমণ করে অমিয়ট ও জনসনকে হত্যা করলেও দলনীর কোন সন্ধান পাননি। নবাবের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেন। পত্র লিখে নবাবকে জানান দলনী নৌকামধ্যে অমিয়টের সঙ্গে এক শয্যাতে শয়ন করতেন। তিনি এখন অমিয়টের উপপত্নীস্বরূপ। মুঙ্গেরে দলনীকে নিয়ে রাখা হলেও তিনি আবার অমিয়টের নিকট ফিরে যেতে কান্নাকাটি শুরু করেছেন। দলনীর প্রতি নবাবের ছিল গভীর বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বেগমের এই দ্বিচারিতার সংবাদে নবাব দলনীকে বিষপানে আত্মহত্যার দণ্ডাদেশ প্রদান করেন। তকি খাঁ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে নিজের কৃতকর্মে লজ্জিত হলেন। দলনীকে বাঁচাতে তিনি উপায় খুঁজতে শুরু করলে প্রতিবাদ জেনে দলনী উক্ত কথাগুলি বলেছিলেন।


“আমি তোমার মতো নিমকহারাম নহি-প্রভুর আজ্ঞা পালন করিয়া থাকি৷ তোমার উচিত অবশিষ্ট পান করিয়া আমার সঙ্গে আইস।”

দলনী বেগম এ কথাগুলি বলেছিলেন তকি খাঁকে। নবাব মীরকাসেম তকি খাঁর মিথ্যা সংবাদে আত্মহারা হয়ে প্রিয় বেগম দলনীকে বিষপানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। তকি খাঁ ভাবতে পারেনি বিষয়টি এতদূর গড়াবে। নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হলেন তিনি। দলনীকে বাঁচাতে তিনি একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। দলনীকে বললেন- "শুন সুন্দরী—আমাকে ভজ–বিষ খাইতে হইবে না।" দলনীর প্রতি তকি খাঁর ছিল গোপন আসক্তি। তা এই মুহূর্তে তিনি কাজে লাগাতে চান। দলনী তকি খাঁর কথায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্যা হয়ে তকি খাঁকে পদাঘাত করে তাড়িয়ে দেন। এবং করিমন নামের একজন পরিচারিকাকে অলংকার উপহার দিয়ে হেকিমের নিকট হতে বিষ আনালেন গোপনে। প্রিয়তম নবাবের আজ্ঞা পালন করতে তিনি বিষ পান করলেন। তকি খাঁ এরপর এলেন দলনীর বেগমের বিষপানের সংবাদ পেয়ে। এবং তাঁকে নিকটে পেয়ে মৃত্যুর প্রাকমুহূর্তে দলনী উক্ত কথাগুলি বলেছিলেন।


“এক বোঁটায় আমরা দুইটি ফুল, এক বনমধ্যে ফুটিয়াছিলাম—ছিঁড়িয়া পৃথক করিয়াছিলেন কেন?”

এ উক্তি শৈবালিনীর। স্বামী চন্দ্রশেখরকে তিনি এই কথাগুলি বলেছিলেন। দুটি ফুল বলতে প্রতাপ ও শৈবালিনীকে বোঝানো হয়েছে। রমানন্দ স্বামীর কথামতো চন্দ্রশেখর গুহা হতে শৈবালিনীকে নিয়ে স্বভূমি বেদগ্রামে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু শৈবালিনী তখন বন্ধ উন্মাদগ্ৰস্তা, বাহ্য সংজ্ঞাবিহীন। চন্দ্রশেখর ঔষধ প্রয়োগে শৈবালিনীকে সারিয়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। ঔষধ সেবনের পর শৈবালিনী ক্রমশ পূর্বের স্মৃতি ফিরে পেতে থাকেন। তবে ঔষধ বলতে কমণ্ডুলুর জলমাত্র। রমানন্দ স্বামী বলেছিলেন- “কন্যা ইহাতে যোগবল পাইবে।” তাই– “শৈবালিনীর চক্ষু বুজিয়া আসিল, অচিরাৎ শৈবালিনী দুলিয়া পড়িল—ঘোর নিদ্রাবিভূত হইল।” শৈবালিনীর ঘুমের মধ্যেই চন্দ্রশেখর নানা প্রশ্ন করে জানতে পারেন শৈবালিনী পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়েছেন। অবশেষে জানলেন, শৈবালিনী প্রতাপের জন্যেই ফষ্টরের সঙ্গে গৃহত্যাগিনী হয়েছিলেন। এবং ঘুমের মধ্যেই চন্দ্রশেখরকে দোষারোপ করে শৈবালিনী উপরিউক্ত কথাগুলি বলেছিলেন। এই বাক্যে শৈবালিনীর অবচেতন মনের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে।


“হায়! হায়! কী কুকর্ম করিয়াছি-স্ত্রী হত্যা করিতে বসিয়াছিলাম।”

এ উক্তি চন্দ্রশেখরের। শৈবালিনীকে লক্ষ্য করে তিনি এই কথাগুলি উচ্চারণ করেছেন। পর্বতগুহা হতে শৈবালিনীকে নিয়ে চন্দ্রশেখর বেদগ্রামে আসার পর, শৈবালিনীর উন্মাদগ্রস্ততাকে কাটাতে তিনি বিশেষ সচেষ্ট হন। একদা ঘুমের মধ্যে দিয়ে শৈবালিনী একে একে চন্দ্রশেখরের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে তাতে চন্দ্রশেখর বুঝতে পারেন প্রতাপের জন্যই শৈবালিনী ফষ্টরের সঙ্গে গৃহত্যাগিনী হয়েছিলেন। চন্দ্রশেখর যখন জানতে চাইলেন শৈবালিনী এখনও স্বাধ্বী কিনা, উত্তরে শৈবালিনী জানান– “প্রতাপকে মনে মনে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলাম এজন্য আমি স্বাধ্বী নহি—মহাপাপিষ্ঠা।” নতুবা তিনি সম্পূর্ণ সতী এবং তা কায়মনোবাক্যে। কারণ, শৈবালিনী ফষ্টরের জল পর্যন্ত স্পর্শ করেননি। নিজহস্তে রান্না করে খেতেন। তাঁর হিন্দু পরিচারিকা ছিল। শৈবালিনীর এ সকল কথায় চন্দ্রশেখর বিস্ময়বোধ করতে থাকলেন এবং শৈবালিনীর প্রতি পূর্বে তিনি যে অবিচার করেছেন তার জন্য অনুশোচনা করতে থাকেন উপরিউক্ত কথাগুলি বলে।


“আমি সুখী হইব না। তুমি থাকিতে আমার সুখ নাই।" 

বা, “যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার ; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।”

শৈবালিনী এ কথা কটি বলেছিলেন প্রতাপকে। তকি খাঁর মিথ্যা প্ররোচনায় দলনীর প্রতি বিষপানে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দান, ফষ্টর কর্তৃক শৈবালিনীর অপহরণ, প্রভৃতি অপরাধের বিচার করতে বাঙ্গালার শেষ রাজা মীরকাসেম প্রস্তুত। বেদগ্রাম হতে সাক্ষ্মীস্বরূপ চন্দ্রশেখর, শৈবালিনী, রমানন্দ স্বামী এসেছেন, কুলসম বেগমও উপস্থিত। নবাব বিচারে তকি খাঁ ও ফক্টরকে অপরাধের যথাযথ দণ্ড প্রদান করেছেন। বিচারকার্য প্রায় শেষ পর্ব, হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এলো ইংরাজদের গোলাবারুদের শব্দ। ইংরাজরা অতর্কিতে নবাবকে আক্রমণ করেছে। প্রাণভয়ে শৈবালিনীসহ চন্দ্রশেখর রমানন্দ স্বামী পলায়ণে মনস্থ করেন। এইসময় তাঁরা দেখতে পান প্রতাপ একদল হিন্দু সৈন্য নিয়ে তাঁদের উদ্ধারকার্যে এসেছেন। প্রতাপের তৎপরতায় তাঁরা নিরাপদ স্থানে এলে একান্তে শৈবালিনী প্রতাপকে কাছে ডেকে অনুমতি চাইলেন, তিনি যে প্রতাপ ভিন্ন অন্য কিছু বোঝেন না তা স্বামীর নিকট প্রকাশ করবেন। এবং ক্ষমা চাইবেন। প্রতাপ শৈবালিনীর এই কথায় বলেছিলেন– “আশীর্বাদ করি, তুমি এবার সুখী হও।” প্রতাপের কথার প্রত্যুত্তরে শৈবালিনী উপরিউক্ত কথাগুলি বলেছিলেন। একথায় শৈবালিনী চরিত্রের আসল রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।


“যে অধম, সেই শত্রুর প্রতিহিংসা করে; যে উত্তম, সে শত্রুকে ক্ষমা করে।”

একথা চন্দ্রশেখর প্রতাপকে বলেছিলেন। ইংরাজদের আক্রমণ থেকে প্রতাপ যখন প্রবল বিক্রমে চন্দ্রশেখর ও শৈবালিনীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে চলে এলেন, তখন একাস্তে শৈবালিনী প্রতাপকে কাছে ডেকে জানিয়েছিলেন “যতদিন তুমি এ পৃথিবীতে থাকিবে, আমার সঙ্গে আর সাক্ষাৎ করিও না। স্ত্রীলোকের চিত্ত অতি অসার; কতদিন বশে থাকিবে জানি না। এ জন্মে তুমি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও না।” প্রতাপ বুঝলেন যাঁর জন্য তিনি তাঁর জীবনকে নিঃশেষ করতে বসেছিলেন আজ সেই-ই তার সান্নিধ্য লাভ থেকে বঞ্ছিত করতে চায়, এবং শৈবালিনী নিজের আত্ম সুখের জন্য প্রতাপকে দূরে সরিয়ে দিতে চান প্রতাপ জানলেন। ইহজীবনে তাঁর আর বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জনের জন্য তিনি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করলে চন্দ্রশেখর জানতে চেয়েছিলেন তিনি কোথায় চলেছেন। প্রতাপ জানিয়ে দেন, ফক্টরকে বধ করতে। চন্দ্রশেখর তখন তাঁকে বাধা দিয়ে উপরিউক্ত উপদেশ দান করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।


“এ সংসারে তুমিই যথার্থ পরহিতব্রতধারী। আমরা ভণ্ডমাত্র। তুমি পরলোকে অনন্ত অক্ষয় স্বর্গভোগ করিবে সন্দেহ নাই।”

এ উক্তি রমানন্দ স্বামীর যুদ্ধে আহত প্রতাপকে তিনি এই কথা কটি বলেছিলেন। শৈবালিনীর নিকট মানসিক আঘাত পেয়ে প্রতাপ যখন অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে ঝড়ের বেগে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জনের জন্য যাত্রা করেন, তার পরিণতি কী তা বোধ করি রমানন্দ স্বামীর বুঝেছিলেন। তাই তিনি কালবিলম্ব না করে চন্দ্রশেখর ও শৈবালিনীকে গৃহাভিমুখে পাঠিয়ে দিয়ে প্রতাপের সন্ধানে রণাঙ্গণে এসে হাজির হন। রাশি রাশি নিহত সৈন্যের মধ্যে থেকে আহত প্রতাপকে খুঁজে নিতে তাঁর বিলম্ব হয়নি। তাঁর এমন করে রণক্ষেত্রে আসার কারণস্বরূপ জানালেন— “আমি জীবিত থাকিলে শৈবালিনী বা চন্দ্রশেখরের সুখের সম্ভাবনা না। যাহারা আমার পরমপ্রীতির পাত্র, যাহারা আমার পরমোপকারী, তাহাদিগের সুখের কণ্টকস্বরূপ এ জীবন আমার রাখা অকর্তব্য বিবেচনা করিলাম। তাই আপনাদিগের নিষেধ সত্ত্বেও এ সমরক্ষেত্রে, প্রাণত্যাগ করিতে আসিয়াছিলাম। আমি থাকিলে শৈবালিনীর চিত্ত কখনো না কখনো বিচলিত হইবার সম্ভাবনা। অতএব আমি চলিলাম।” প্রতাপের এই উক্তিতে আপ্লুত হয়ে চন্দ্রস্বামী উক্ত কথা কটি বলেছিলেন।


“আমার ভালোবাসার নাম – আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা।”

এ উক্তি প্রতাপের। শৈবালিনীর সুখের জন্য রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জনকারী আহত প্রতাপকে রমানন্দ স্বামী জিজ্ঞাসা করেছিলেন— “শুন বৎস! আমি তোমার অস্তকরণ বুঝিয়াছি। ব্ৰষ্মাণ্ড জয় তোমার এই ইন্দ্রিয় জয়ের তুল্য হইতে পারে না-তুমি শৈবালিনীকে ভালোবাসিতে?" মৃত্যুপথযাত্রী প্রতাপ রমানন্দ স্বামীর এ প্রশ্নে উচ্চকিত হয়ে জানালেন—“কী বুঝিবে তুমি সন্ন্যাসী। এ জগতে মনুষ্য কে আছে যে, আমার এ ভালোবাসা বুঝিবে ?” তিনি জানালেন, দীর্ঘ ষোলো বছর ধরে শৈবালিনীকে ভালোবেসে আসছেন, তবু কখনো পাপচিত্তে তিনি শৈবালিনীর প্রতি অনুরক্ত হননি। কারণ তাঁর ভালোবাসার নাম– আত্মবিসর্জনের আকাঙ্ক্ষা, যা শিরায় শিরায়, অস্থিতে অস্থিতে, শোণিতে শোণিতে বিরাজ করে। কখনো সাধারণ মানুষ তার সন্ধান পায় না। কেবল শৈবালিনীর মঙ্গলার্থে আজ তাঁর এমনভাবে মৃত্যুকে কামনা করতে হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রতাপের এই উক্তিতে তাঁর চরিত্রের মহত্বই প্রকট হয়েছে। বোঝা গেল কোনো রূপকলঙ্কের দাগ তাঁর স্বচ্ছ চরিত্রে লাগেনি।


“ইন্দ্রিয়জয়ে যদি পুণ্য থাকে, তবে অনন্ত সর্গ তোমারই.... ”

প্রতাপের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর মৃত্যুর প্রাকমুহূর্তে শিয়রদেশে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলি রমানন্দ স্বামী বলেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন প্রতাপ যেভাবে শৈবালিনীর সুখের জন্য আত্মবিসর্জন দিলেন তা স্বর্গলাভেরই সামিল। যদি চিত্ত সংযমে পুণ্য থাকে তবে তিনি দেবতাদের চেয়েও পুণ্যবান। যদি পরোপকারে স্বর্গ থাকে তবে তা দধীচির চেয়েও তিনি অগ্রাধিকারী। রমানন্দ স্বামী বলেন- “প্রার্থনা করি, জন্মান্তরে যেন তোমার মতো ইন্দ্ৰিয়জয়ী হই।” অতঃপর প্রতাপের মৃত্যু হলে রমানন্দ স্বামী প্রত্যক্ষ করলেন– তৃণশয্যায় যেন অনিন্দ্যজ্যোতির স্বর্ণতরু পড়ে আছে। তিনি মনে মনে বলতে থাকেন- “তবে যাও প্রতাপ, অনন্তধামে, যাও, যেখানে ইন্দ্রিয়জয়ে কষ্ট নাই, রূপে মোহ নাই, প্রণয়ে পাপ নাই, সেইখানে যাও! যেখানে রূপ অনন্ত, প্রণয় অনন্ত, সুখ অনস্ত, সুখে অনন্ত পুণ্য, সেইখানে যাও। যেখানে পরের দুঃখ পরে জানে, পরের ধর্ম পরে রাখে, পরের জয় পরে গায়, পরের জন্য পরকে মরিতে হয় না, সেই ঐশ্বর্য্যময়লোকে যাও! লক্ষ শৈবালিনী পদপ্রান্তে পাইলেও, ভালোবাসিতে চাহিবে না।” এ বক্তব্যে প্রতাপ সত্যকার মহৎ চরিত্রে রূপান্তরিত হল।