'বাংলা কথাসাহিত্যে জগদীশ গুপ্ত এক স্বতন্ত্র ধারার লেখক'- বাংলা কথাসাহিত্যে জগদীশ গুপ্তের এই স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে আলােচনা কর।

বাংলা কথাসাহিত্যে জগদীশ গুপ্তের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য


বাংলা কথাসাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী লেখক জগদীশচন্দ্র গুপ্ত (১৮৮৬-১৯৫৭)। মূল শ্রোতােধারার বহির্বর্তী হওয়ায় সমকালেই তিনি প্রায় বিস্মৃত লেখকের পর্যায়ভুক্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাই লিখেছিলেন— 'তিনি কোনও কালেই সাধারণ পাঠকের হৃদয় জয় করতে পারেন নি। ইদানিং যিনি সমালােচক ও গবেষকদের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ।' আবেগ ও অতিশয়ােক্তির সাম্রাজ্যে স্বভাবতই স্পষ্টভাষী ও নগ্নজীবন দর্শনের কথাকার স্পৃহনীয় হতে পারেন না, এবং এই নির্মম সত্য জগদীশ গুপ্ত জানতেন। তথাপি নিজ জীবনদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধাবশতই তিনি স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে পাঠক-মনােরঞ্জন করে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সচেষ্ট হন নি। কথাসাহিত্যিক হিসাবে এই সততার কারণেই জগদীশ গুপ্ত শতবর্ষ অতিক্রম করে বাংলাসাহিত্যে স্বাতন্ত্র্যে ও স্বমহিমার উপস্থিত।


রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও কথাসাহিত্যের প্রবল প্লাবণ যখন অন্যান্য সাহিত্যিকদের স্বকীয়তাকে গ্রাস করতে উদ্যত, তখন রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল একঝাক তরুণ। রবীন্দ্র দর্শনকে প্রায় অস্বীকার করে বিদ্রোহীর মতাে তাদের আত্মপ্রকাশ। প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার, শৈলজানন্দ, বুদ্ধদেব প্রভৃতি এই নতুন ধারার কথাসাহিত্যিক ও কবিগণের নবসৃষ্টির উন্মাদনাকে ধারণ করার জন্যই তখন আত্মপ্রকাশ করেছিল 'কল্লোল' (১৯২৩), 'কালিকলম' (১৯২৬), 'প্রগতি' (১৯২৭) প্রভৃতি পত্রিকা। রবীন্দ্র-বিরােধী এই সাহিত্য-আন্দোলনের পর্বটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে 'কল্লোল যুগ' নামে চিহ্নিত হয়ে আছে। জগদীশ গুপ্ত এই কল্লোল কালিকলম পর্বেরই তথা 'কল্লোল'-গােষ্ঠীরই কথাকার। যদিও বয়সে কল্লোল-গােষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের তুলনায় জগদীশ গুপ্ত বেশ কিছু প্রবীনই ছিলেন (কল্লোল প্রকাশকালে জগদীশ গুপ্তের বয়স ৩৭, অন্যান্যরা ১৯ থেকে ২৯ এর মধ্যে)। তবু কল্লোলের সঙ্গেই জগদীশ গুপ্তের মানস সাযুজ্য ঘটেছিল। কল্লোল গােষ্ঠীর কাছে তিনি লিখতে পেরেছিলেন—'আমার বয়স আপনাদের প্রায় সমানই, দেহের না হােক, মনের।' সেই মানসিক বয়স ও বৈশিষ্ট্যের সাযুজ্যেই জগদীশ গুপ্ত কল্লোল গােষ্ঠীর লেখক হয়ে উঠেছিলেন। তবু তিনি স্বতন্ত্র। কেননা, কল্লোলের ভাবমূর্তি যথার্থভাবে জগদীশ গুপ্তের মধ্যেই বর্তমান ছিল। কল্লোল-গােষ্ঠীর লেখকরা ছিলেন ভাবের আকাশে ঝড় তােলা বাস্তববাদী। নগ্ন বাস্তবের ছবি তারা এঁকেছেন, কিন্তু সে জীবন-দৃষ্টিকে নির্মোহ বলা চলে না। কিন্তু জগদীশ গুপ্ত ব্যক্তি-জীবনে এবং লেখক জীবনে দারিদ্র্য ও নির্মমতার বাস্তব পরিচয়ে অভিজ্ঞ এবং জীবন সম্পর্কে তিনি ছিলেন যথার্থই নির্মোহ।


প্রথম জীবনে অধিকাংশ বাঙালী লেখকের মতাে কবিতা রচনার মধ্য দিয়েই তার লেখক জীবনের সূচনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রােম্যান্টিকতার প্রভাব এড়িয়ে তিনি প্রথমাবধি গােবিন্দচন্দ্র দাসের দেহবাদকে স্বীকার করেছেন। গল্প রচনার পর্বে আবার তার কাছে দেহবাদ সেভাবে স্বীকৃতি পেল না। কল্লোলীয়দের মতাে কামতত্ত্ব বা মনােবিকার তার গল্পের প্রধান বিষয় নয়। তাঁর গল্পে প্রথমাবধি জীবন সম্পর্কে এক ক্রোধদৃষ্টি বর্তমান। পুরােনাে বিশ্বাসের ভিত্তিটিকে আমূল বিচূর্ণ করার দুর্দম স্পৃহা নিয়েই তার আবির্ভাব। তার দৃষ্টিভঙ্গি যেন কতকটা যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। বিধাতা বিশ্বাস ধর্ম নৈতিকতা সমস্তই তার কাছে ভ্রান্ত এবং বিশেষত বিধাতাকে তিনি 'এক নির্মম ক্রুর-হৃদয় শয়তান' বলেই জেনেছেন। তাঁর সম্পর্কে ভূদেব চৌধুরী লিখেছেন- 'জগদীশ গুপ্তও অবিশ্বাসী; তাহলেও বিশ্বাসহীন নন তিনি।..জীবন-সম্পর্কিত সকল নীতিবােধ ও কল্যাণমূলক মূল্যমানকে কেবল অস্বীকার করেই তিনি তৃপ্ত নন, বিশ্ব-প্রবাহের মূলে এক অমােঘ শক্তির অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেছেন, যা একান্তরূপে বিনাশক, ক্রুর এবং কদর্য।'


জগদীশ গুপ্তর প্রথম গল্প 'পেয়িংগেস্ট' প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩১ বঙ্গাব্দে ‘বিজলী’ পত্রিকায়। ১৩৩৩ থেকে 'কালিকলমে’ পরপর নখানি গল্প লিখে এরপর জগদীশগুপ্তের বাংলা সাহিত্যে যথার্থ প্রতিষ্ঠা। 'কল্লোল' ও 'কালিকলম' পত্রিকায় এ সময় প্রকাশিত গল্পগুলি নিয়েই প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'বিনােদিনী' ১৩৩৪-এ (১৯২৭)।


প্রথম এই গল্পসংকলনেই জগদীশ গুপ্তের স্বাতন্ত্র প্রকাশিত হল। তৎকালীন আধুনিক গল্পধারায় যে দারিদ্র্যের মেকি আস্ফালন এবং আদিরসের অসংযম দেখা যাচ্ছিল, 'বিনােদিনী'র গল্পগুলি তা থেকে মুক্ত। 'প্রলয়ংকরী যষ্ঠী', 'পয়ােমুখম', 'পুরাতন ভৃত্য' প্রভৃতি গল্পগুলি ‘বিনােদিনী’ গল্পগ্রন্থকে সমকালীন যুগে বিশিষ্টরূপে চিহ্নিত করেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘বিনােদিনী’ পাঠ করে এই নতুন ধারার ও নবরসের সন্ধান পেয়ে লিখেছিলেন- 'তােমার গল্পে নূতন রূপ ও রস দেখিয়া খুশী হইলাম।' নির্মম নিরাসক্ত ভঙ্গিতে মানব হৃদয়ের গভীরতম স্বরূপ উদ্ঘাটনের উদাহরণ এর আগে লক্ষণীয় নয়। রবীন্দ্রনাথের 'পুরাতন ভৃত্য' কবিতায় ভৃত্য কেষ্টার আত্মদান পাঠককে এক উদার মানবতার কল্পলােকে মিথ্যা মহিমায় গৌরবান্বিত করে। কিন্তু জগদীশ গুপ্তের 'পুরাতন ভৃত্য' গল্পে ভৃত্য নব-র অন্তরে প্রভুপ্রীতি ও কৃতজ্ঞতাবােধের লেশমাত্র নেই। 'প্রলয়ংকরী ষষ্ঠী’ গল্পে মহাজন সদু খাঁ জসিমের বৌকে ভুলিয়ে নিয়ে গেলে জসিম বহু চেষ্টায় বৌকে উদ্ধার করে। কিন্তু 'জসিম তার বৌকে ফিরিয়া পায় নাই। বৌ নিজেই আসিতে চায় নাই।' এত সংক্ষেপে নিরাসক্তভাবে নগ্ন সত্যকে মেলে ধরার দক্ষতা পরে আমরা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যে লক্ষ্য করেছি।


‘পয়ােমুখম্' গল্পটিও বাংলা সাহিত্যে নির্মম-নির্মোহ দৃষ্টির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত পুত্র ভূতনাথের একাধিকবার বিবাহ দেন শুধু পণ ও অন্যান্য উপায়ে অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে। অর্থের উৎস শুষ্ক হলেই রহস্যজনকভাবে কলেরায় বধু মারা যায় এবং ভূতনাথের পুনর্বিবাহ ঘটে। তৃতীয় বধূটি একইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্রের কাছে কৃঞ্ণকান্ত ধরা পড়ে যান। গল্পের শেষটি নাটকীয়তায় নির্মমতায় এবং সংক্ষিপ্ততায় অনবদ্য- 'ভূতনাথ সেদিকে দৃকপাতও করিল না; একটু হাসিয়া বলিল, এই বৌটার পরমায়ু আছে, তাই কলেরায় মরল না, বাবা।..... পারেন তাে নিজেই খেয়ে ফেলুন।...বলিয়া সে ঔষধসমেত হাতের খল আড়ষ্ট কৃষ্ণকান্তের সম্মুখে নামাইয়া দিল।'


জগদীশ গুপ্তের অন্যান্য গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে 'উদয়লেখা', 'মেঘাবৃত অশনি', 'শ্রীমতী', 'তৃষিত সৃক্কণী', 'রতি ও বিরতি', 'শশাঙ্ক কবিরাজের স্ত্রী' ইত্যাদি। জগদীশ গুপ্ত আধুনিক গল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে 'কালি-কলম'-এর সম্পাদক মুরলীধর বসুকে লিখেছিলেন— 'উন্মুখ প্রবৃত্তি লইয়াই এবং মনােভাবের বিশ্লেষণ লইয়াই এখন গল্প লেখা চলিত হইয়াছে। কাজেই মানুষের বিভিন্ন প্রবৃত্তির সঙ্গে যার যত পরিচয় বা সেই বিষয়ে যার যত অন্তর্দুষ্টি, তার গল্প তত বিচিত্র হইবে।' জগদীশচন্দ্রের বিচিত্র জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কম ছিল না। সেই সঙ্গে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিটির ফলে মানব প্রবৃত্তির নগ্ন বিচিত্র লীলা তার ছােট গল্পগুলিতে তীব্র চাবুকের মতাে প্রকটিত। 'জগদীশ গুপ্তের গল্প' সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক শ্রীসুবীর রায়চৌধুরী বলেছিলেন— 'জগদীশ গুপ্ত আগাগােড়া তিক্ত, রুক্ষ ও নৈরাশ্যবাদী। তার লেখা পড়লে আমাদের মূল্যবােধগুলি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খায় এবং আমরা স্বভাবতই অস্বস্তিবােধ করি।' শ্রী রায়চৌধুরীর বক্তব্যের যথার্থ প্রমাণ হয় তার গল্পগুলি পড়লেই।


জগদীশ গুপ্তের আদি কথার একটি গল্পটিতে এক বিধবা শাশুড়ীর সঙ্গে জামাইয়ের অসামাজিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অসামাজিক সম্পর্কের জন্য তাদের শাস্তিদূশ্যেও সমাজ শাসনের জয় বা স্বস্তির মনােভাব জাগায় না। 'চন্দ্র-সূর্য যতােদিন' গল্পে ছােটো বউয়ের প্রতি লুব্ধ স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে হয়েছে বড়াে বউকে শাশুড়ির আদেশে। তারপর প্রচণ্ড বিতৃষ্ণায় সে পাগল হয়ে গেছে। 'পারাপার' গল্পে সতীত্বগর্বে গর্বিতা স্ত্রী পরিচারিকাকে স্বামীর জুতােটি ধরবার জন্য বকাবকি করেন। কিন্তু পরিহাস এখানেই যে, তিনি জানেন না তার পতিদেবতাটি ঐ পরিচারিকারই পদসেবা করেন গােপনে। 'পৃষ্ঠে শর লেখা' গল্পে পুত্রের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে পিতা স্বয়ং মুগ্ধ হয়ে বিবাহ করেন। আবার 'লােকনাথের তামসিকতা' গল্পে পুত্রের জন্য সুন্দরী পাত্রী নির্বাচন করেও পরে বাতিল করেন, কেননা তার নিজের স্ত্রী সুন্দরী নয়।


প্রবৃত্তির নগ্ন ছায়া ও মনের ভয়ংকর সর্পিল গতির চিত্র পাওয়া যাবে 'শঙ্কিতা অভয়া' গল্পে। স্ত্রী অভয়া দেখে স্বামী কন্যাকে যুক্তমনা হিসাবে গড়ে তুলতে চায়। একদিন স্বামী ও কন্যা সিনেমা দেখে ফিরলে অভয়া কন্যাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে স্বামী তাকে নষ্ট করেছে কিনা। এই প্রশ্ন স্বভাবতই পাঠকের মূল্যবোেধকে সজোরে আঘাত করে। বিস্মিত মেয়েকে মা জানান যে, মেয়েকে নিয়েই এই স্বামীর সঙ্গে সে কুলত্যাগ করেছিল। ফলে বাবার সঙ্গে কন্যার কোনাে রক্তসম্বন্ধ নেই। স্বামী যদি তাকে মুগ্ধ করতে পারে, তবে নবযুবতী কন্যাকেও পারবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝখানে এই অলক্ষ্য দূরত্বটিকে আবিষ্কার করা জগদীশ গুপ্তের জীবনদৃষ্টির এক বিশেষ লক্ষণ।


জগদীশ গুপ্তের জীবনবােধ প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম ছােটো গল্প। ছােটো গল্পই সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তের স্বভূমি। বস্তুত কল্লোল-কালিকলম গােষ্ঠীর কোনাে লেখকই উপন্যাসে স্বাচ্ছন্দ্য দেখাতে পারেন নি। শক্তির এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জগদীশ গুপ্তও সচেতন ছিলেন। তিনি নিজেই লিখেছিলেন- 'উপন্যাস লেখা আমার পক্ষে দুরূহ-অসম্ভবই।' 'রােমস্থন' উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক বলেছেন— 'ইহাতে প্লট নাই-আমার বক্তব্য ব্যক্ত করিয়াছি মাত্র; গল্প তৈরী আমার উদ্দেশ্য নয়।' তবু জগদীশ গুপ্ত ছােটোগল্পের প্রতিভা নিয়েও অনেকগুলি উপন্যাস লিখেছেন।


জগদীশ গুপ্তের প্রথম উপন্যাস সম্ভবত 'অসাধু সিদ্ধার্থ' (১৯২৯)। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সমসাময়িক ঔপন্যাসিক তিনি। অথচ জগদীশ গুপ্তের উপন্যাসের বিষয় ও বাস্তবতা রবীন্দ্রনাথের থেকে বহুদূরবর্তী, এমনকি শরৎচন্দ্রেরও নিকটবর্তী নয়। জগদীশ গুপ্ত ছিলেন এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্বের কথাকার। তার উপন্যাসের চরিত্রগুলিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়তিতাড়িত এবং নিঃসঙ্গ। 'অসাধু সিদ্ধার্থ' নটবরের দুটি সত্তা। সিদ্ধার্থ নাম নিয়ে সুস্থ জীবনকে গ্রহণ করতে চায়। অথচ নটবর আসলে 'ব্রাহ্মণের জারজপুত্র’, 'বৃদ্ধা বেশ্যার শয্যাচর' এবং অর্থলােভী। উভয় সত্তার দ্বন্দ্ব-সংকট নটবরের জীবনে কোনাে সদর্থক পরিণাম সুচিত করে না। নিয়তি লীলাকে শিরােধার্য করে নটবরের যন্ত্রণা ও লালসাই উপন্যাসের শেষ কথা।


'লঘু গুরু' উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৩১। এক নীতিহীন, প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ বিশ্বম্ভর এই উপন্যাসের চরিত্র। এছাড়া পরিতােষ, অচিন্ত্যবাবু প্রভৃতি চরিত্রগুলিও অর্থ ও যৌনবাসনা-সর্বস্ব মানুষ। তিনটি গণিকা চরিত্রও আছে। উপন্যাসটি চরিত্র-ঘটনা-পরিবেশ সমস্তই সাজানাে-গােছানাে সমাজ থেকে উৎকেন্দ্রিক। রবীন্দ্রনাথ এই উপন্যাসের রচনারীতির প্রশংসা করলেও এই তীব্র উৎকেন্দ্রিকতাকে স্বীকার করতে পারেন নি।


'দুলালের দোলা' উপন্যাসে সতীশ ভাগ্যদোষে অসহায় এক চরিত্র। 'যথাক্রমে' উপন্যাসে দেখি মনােবিকারে অস্থিত অভয়কে। তাতল সৈকত' উপন্যাসেও শরৎ ও রণজিৎ উদ্দাম উচ্ছল যৌন প্রবৃত্তি ও নীতিবােধের গভীর দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। অধিকাংশ উপন্যাসেই চরিত্রগুলি নিষ্ঠুর নিয়তির আঘাতে বিপর্যস্ত এক একটি শিকার। তার অন্যান্য উপন্যাসগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য 'রােমস্থন', 'সুতিনী' ইত্যাদি। এই নির্মম লােভাতুর পৃথিবীতে নিয়তির আঘাতে জর্জরিত হতে হতে জগদীশ গুপ্তের চরিত্রগুলি সমাজের ন্যায়-নীতি-সুকুমার বৃত্তি, মূল্যবােধ সম্পর্কে ক্রমশ বিমুখ ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। অসাধু-সিদ্ধার্থর নায়কের আত্মজিজ্ঞাসা—জীবনযুদ্ধে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার চেষ্টা কীট পতঙ্গে আছে, উদ্ভিদে আছে সেটা বিধিদত্ত প্রেরণা। তবে আমি মানুষ হয়ে কেন টিকে থাকতে চাইব না?


জগদীশ গুপ্ত কথাসাহিত্যিক হিসাবে ছিলেন যথার্থই রিয়ালিস্ট। রােমান্টিকতার কোনাে অবশেষ তার মধ্যে লক্ষণীয় নয়। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনদৃষ্টিও সম্ভবত জগদীশ গুপ্তের মতাে নির্মোহ নয়। জীবনের নির্মম সত্য নীতি-মূল্যবোেধ-সংস্কারের সমস্ত আবরণ ভেদ করে তাঁর গল্প এবং উপন্যাসে বারংবার ঝলসে উঠেছে। এবং এখানেই তিনি স্বতন্ত্র। কল্লোল-গােষ্ঠীর লেখক বলে পরিচিত হলেও কার্যত জগদীশ গুপ্ত পরিকল্পিতভাবে কোনাে সাহিত্যিক গােষ্ঠীর কথাকার হতে পারেন নি। এমনকি কথাকার জগদীশগুপ্তের প্রত্যক্ষ উত্তরসুরীও অনুপস্থিত। জগদীশচন্দ্রের কথাসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য কাহিনীর তীব্র উৎকেন্দ্রিকতায়, দুঃখময়তায়, রচনারীতির বিদ্রুপ ইঙ্গিতপূর্ণ সংক্ষিপ্ত স্পষ্টতায়। অদৃষ্টের হাতে নিষ্ঠুরভাবে ঘূর্ণিত জীবনচক্রের তিনি এক নিঃসঙ্গ, অপ্রতিষ্ঠিত, বিস্মৃত রূপকার। আধুনিক বাস্তবতার যথার্থ ধারার সূচনায় তাই তিনি হয়ে ওঠেন 'অন্তরালের সাহিত্যিক'।