ঈশ্বর গুপ্তকে বাংলা কাব্যে পূর্বযুগের শেষ কবি এবং নবযুগের প্রথম কবি বলিতে পারি / ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাঙলা সাহিত্য কোন বড় কবি নহেন, তবু তিনি বাঙলা কাব্যে নবযুগের প্রবর্তক- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিকৃতির পরিচয়

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করে তাকে 'যুগসন্ধির কবি' বলা কতখানি সঙ্গত সে বিষয়ে তােমার অভিমত প্রকাশ কর।


ঈশ্বর গুপ্তকে যুগসন্ধির কবি

প্রাচীন বাঙলা কাব্যের প্রাণশক্তি ভারতচন্দ্রেই নিঃশেষিত হয়েছিল। ভারতচন্দ্রের পরবর্তীকাল থেকে ঈশ্বর গুপ্তের আবির্ভাব কাল পর্যন্ত পদ্যাকারে যা কিছু রচিত হয়েছে, সেই কবিগানে বা‌ জনরঞ্জনী অন্যান্য গীতিকবিতায় প্রাচীন ধারারই জের টানা হয়েছে। এইসব রচনায় যেটুকু অভিনবত্ব চোখে পড়ে তা নিতান্তই চটুল ভঙ্গিসরবস্ব, প্রাণশক্তির দৈন্য তার মধ্যে প্রকট। ইতিমধ্যে বাঙলার নতুন সংস্কৃতিকেন্দ্ররূপে কলকাতা নগরী সর্বময় প্রাধান্য অর্জন করেছে। দীর্ঘদিনের ইংরেজ-শাসনজনিত একটা স্পষ্ট পরিবর্তন সমাজের সর্বত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষে নতুন ও পুরনাে ভাবধারার সংঘাত ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে এক বাস্তব জীবনাগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে। এই আগ্রহটা সম্পূর্ণ নতুন এবং এটা আধুনিক মানসিকতার প্রধান লক্ষণ। ঈশ্বর গুপ্তের জন্ম ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দে। জন্মস্থান কলকাতার অদূরবর্তী কাঁচরাপাড়ায়। গ্রামেই তিনি মানুষ হয়েছেন। তখন গ্রাম-জীবনে প্রাচীন সাংস্কৃতিক আবহাওয়া কিছু পরিমাণে জীবন্ত ছিল। সেই পরিবেশের প্রভাবেই ঈশ্বর গুপ্ত লালিত হয়েছেন। খুব অল্প বয়স থেকে তিনি কবির দলের জন্য গান রচনা করতেন। এইভাবেই তার কবিত্বশক্তির উন্মেষ হয় বলা বাহুল্য তার ব্যক্তিত্বের ওপরে পাশ্চাত্ত্য প্রভাব পড়েনি। দেশের সংস্কৃতির মৃত্তিকাই তার প্রধান আশ্রয় ছিল।


ঈশ্বর গুপ্তের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে স্বরচিত কাব্য ছাড়াও রয়েছে সাময়িকপত্র সম্পাদনা ও নব্য সাহিত্যিকদের উৎসাহ দান এবং পূর্ববর্তী সাহিত্যিক জীবনী বা রচনার উদ্ধার সাধন। তিনি ১৮৩১ স্ত্রীঃ সাপ্তাহিক পত্ররূপে যে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনা আরম্ভ করেন, ১৮৩৯ খ্রীস্টাব্দে এটিই বাঙলা ভাষায় রচিত প্রথম দৈনিক পত্রের মর্যাদালাভ করে। ঈশ্বরচন্দ্রের জীবৎকালে প্রকাশিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- (১) কবিবর রামপ্রসাদ সেনের 'কালীকীর্তন' (১৮৩৩ খ্রীঃ), (২) 'কবিবর ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের জীবনবৃত্তান্ত' (১৮৫৫ খ্রীঃ) ও (৩) 'প্রবােধ প্রভাকর' (১৮৫৮ খ্রীঃ)। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘হিতপ্রভাকর' (১৮৬১), ‘বােধেন্দুবিকাশ’ নাটক (১৮৬৩), এবং 'সত্যনারায়ণ পাঁচালী' (১৮১৩)। তিনি 'কলি নাটক' নামে একখানা নাটকও রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়।


এই গ্রামের মানুষ ঈশ্বর গুপ্ত কলকাতার উত্তরঙ্গ এবং বিচিত্র পথে ধাবিত জীবনের মুখরতার মধ্যে যখন এসে দাঁড়ালেন তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণভাবেই মিলিয়ে নিতে পারেন নি। অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার পারিবারিক ও ব্যক্তি জীবনের বেদনা-মিশ্রিত তিক্ত স্মৃতি, তাই আধুনিক জীবনের প্রতি সন্দেহ ও সংশয় এরূপ মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। কোনদিনই ঈশ্বর গুপ্ত সে সংশয় থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। ঈশ্বর গুপ্তের বিদ্রুপপরায়ণতার মূল নিহিত আছে এই সংশয়বােধে। তিনি সতর্ক সমালােচকের দৃষ্টিতেই সমসাময়িক জীবনকে দেখেছেন। অথচ এই ঈশ্বর গুপ্তই 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকার সম্পাদকরূপে দ্রুত রূপান্তরশীল আধুনিক জীবনের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছেন। এই সং প্রভাকরেই বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রঙ্গলাল প্রভৃতি আধুনিক সাহিত্যের ত্রিধারার পতাকাবাহী সাহিত্য-সাধকদের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কলকাতা সমাজের একজন প্রধান পুরুষরূপে শিক্ষা ও সংস্কারমূলক নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাকে জড়িত হতে হয়েছে। তিনি বুঝেছেন, ভাল-মন্দয় মিশ্রিত এই নতুন যুগ একটা বাস্তব সত্য এবং সত্যকে স্বীকার না করে কোন উপায় নেই। এইভাবে একই সঙ্গে প্রাচীনের প্রতি মমত্ববােধ ও প্রাচীন জীবনের মূল্যবােধগুলি অবসিত হয়েছে দেখে ঈশ্বর গুপ্তের মনে বেদনা এবং অন্যদিকে কর্মসূত্রে আধুনিক জীবনের সঙ্গে জড়িত হয়ে এই জীবনের প্রগতিধারাকে বােঝবার চেষ্টা—এই দুই বিপরীত বৃত্তি একত্রে কাজ করতাে। তিনি যে-সমাজে, যে কালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই পটভূমিতে এই দোটানা একান্তই স্বাভাবিক ছিল।


কবিগান ও হাফ-আখড়াই-এর কবিরা কলকাতার অপরিমার্জিতরুচি শ্রোতাদের তৃপ্তির জন্য যে চটুল, শালীনতাহীন কাব্য রচনা করতেন তার পটভূমিতে দেখলে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায় বুদ্ধিদীপ্ত, বস্তুনিষ্ঠ মননভঙ্গি প্রকাশকে অবশ্য নিঃসন্দেহেই নতুন কাব্যরীতির ইঙ্গিতবহ বলে মনে হয়। তিনি খণ্ড খণ্ড গীতিকবিতা রচনা করতেন। এই কবিতা ছিল সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এইসব কবিতায় বিষয় হিসাবে নীতিবাদ, সামাজিক রীতিনীতির সমালােচনা, খাদ্যবস্তুর বর্ণনা এবং সমসাময়িক বহু ঘটনা ব্যবহৃত হয়েছে। বিষয় যাই হােক, সর্বত্র তার বুদ্ধির আলােকে উজ্জ্বল ব্যঙ্গপ্রবণ মনের প্রকাশে কবিতাগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। মহারানী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশ্যে রচিত কবিতাটি তার তীক্ষ্মব্যঙ্গের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখযােগ্য।


"প্রাচীন রীতি পরিত্যাগ করে ঈশ্বর গুপ্ত যে খণ্ড কবিতা রচনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, পরবর্তীকালে ঐ রীতিটি অনুসৃত হলেও তিনি যে রঙ্গ ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছিলেন, তা কিন্তু কার্যতঃ পরিত্যক্ত হয়েছিল। কাজেই ঈশ্বর গুপ্ত যে নবধারার প্রবর্তন করেছিলেন, তিনি তার একক শিল্পী।" (সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়')।


অকৃত্রিম খাঁটি বাঙালা ভাষার ওপরে ঈশ্বর গুপ্তের অপরিসীম অধিকার ছিল। সেই ভাষাকেই তিনি আবশ্যক মতাে পরিমার্জিত করে নিয়েছেন। তাঁর কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য বস্তুনিষ্ঠ জীবন পর্যবেক্ষণ, সুস্থ জীবনাগ্রহ এবং বিদ্রুপাত্মক মনােভঙ্গির প্রকাশ। জীবনের প্রতি তিনি কখনও বিমুখ ছিলেন না। জীবনের তুচ্ছ দিকগুলির প্রতিও তাই তার আগ্রহের অন্ত নেই। 'আনারস', 'তপসে মাছ', 'পাটা প্রশক্তি' প্রভৃতি কবিতায় ঈশ্বর গুপ্তের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং তীব্র কৌতুক প্রবণতার পরিচয় পাওয়া যায়। 'তপসে মাছ' ঈশ্বর গুপ্তের বর্ণনায়


'কষিতকনক কান্তি, কমনীয় কায়।

গালভরা গোঁফ দাড়ি, তপস্বীর প্রায়।'


‘পাটা-প্রশস্তি’ প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,


"রসভরা রসময় রসের ছাগল।

তােমার কারণে আমি, হয়েছি পাগল।।

তুমি যার পেটে যাও, সেই পুণ্যবান।

সাধু সাধু সাধু তুমি ছাগীর সন্তান।।

মজাদাতা অজা তােরা কি লিখিব যশ? 

যত চুষি তত খুসি হাড়ে হাড়ে রস।।"


তার গভীর ও বিস্তৃত সমাজ-চেতনা এবং স্বদেশপ্রীতির (দেশের কুকুর ধরি বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া প্রভৃতি) পরিচয় পাওয়া যায় নীলকর বা মাতৃভাষা রচিত কবিতাগুলিতে। বাঙালি জীবনের তুচ্ছ ও মহৎ সমস্ত কিছুর প্রতিই তার অকৃত্রিম আকর্ষণ ছিল।


এই বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি, বাস্তব জীবনের প্রতি আগ্রহ, ভাবালুতাবর্জিত বুদ্ধির আলােকে জীবনকে বােঝবার চেষ্টা বাঙলা কাব্যে একান্তভাবে নতুন। ঈশ্বর গুপ্তের মানসিকতার এই বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই বাঙলা কাব্যে তিনি একটা নতুন স্বাদ আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এইভাবে তার কবিতায় আধুনিকতার লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। বাঙলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম সচেতন সাহিত্যিক দায়িত্ববােধসম্পন্ন লেখক। আপন কালের গতি-প্রকৃতি অনুধাবন করার সচেতন প্রয়াস এবং সাহিত্যিক দায়িত্ববােধে তার ব্যক্তিত্বের আধুনিকতারই লক্ষণ পরিস্ফুট। ঈশ্বর গুপ্ত প্রথাসিদ্ধ খাদ্য বর্ণনাত্মক কবিতা লিখেছেন, কবিওয়ালাদের অনুপ্রাস-যমকে পূর্ণ কাব্যরীতি অনুসরণ করেছেন, ভাবে-ভাষায় তার অধিকাংশ রচনাতেই প্রাক-আধুনিক যুগের সাহিত্যিক মেজাজটা অনুভব করা যায়।


বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তের এই বিশিষ্টতার প্রতি ইঙ্গিত করে লিখেছিলেন, "যে ভাষায় তিনি পদ্য লিখিয়াছেন এমন খাঁটি বাঙলায়, এমন বাঙালির প্রাণের ভাষায়, আর কেহ পদ্য কি গদ্য কিছুই লেখেন নাই। তাহাতে সংস্কৃতিজনিত কোন বিকার নাই ইংরেজিনবিশীর বিকার নাই। পাণ্ডিত্যের অভিমান নাই বিশুদ্ধির বড়াই নাই। ভাষা হেলে না, ঢলে না, বাঁকেনা সরল সােজা পথে চলিয়া গিয়া পাঠকের প্রাণের ভিতরে প্রবেশ করে।” বঙ্কিমচন্দ্রের এই বিশ্লেষণ যথার্থ। কিন্তু তাঁর কবিতাগুলিতে সমাজবাস্তবতার প্রতি, প্রত্যক্ষ জীবনের প্রতি যে আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে তা একান্তভাবেই আধুনিক মানসিকতার লক্ষণ। এজন্য শেষ বিচারে তাকে একান্তভাবে প্রাচীন কাব্যধারার কবি বা একান্তভাবে আধুনিক কালের কবিকোনটিই বলা যায় না। তাঁকে যুগসন্ধিক্ষণের এক ক্রান্তিকালের সংশয়িত জীবনচেতনার ভাষ্যকার বলাই সঙ্গত। আধুনিকতার লক্ষণগুলি তাঁর কাব্য প্রকাশিত হয়েছে বলেই ঈশ্বর গুপ্ত বড় কবি না হয়েও বাঙলা কাব্যে নবযুগের প্রবর্তক।


অধ্যাপক অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "..কতকগুলি বিষয়ে তাঁর মৌলিক স্বীকার করতেই হবে। প্রায় অশিক্ষিত হয়েও আধুনিক জীবনের ভাবাবেগ-সম্বন্ধে সচেতন থাকা কবিতাতে পুরাতন-পদ্থী হায়েও বাস্তব চিত্র অঙ্কন করা, স্বাদেশিক মনােভাব রঙ্গব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতাসৃষ্টি এবং নূতন পুরাতন যুগপৎ প্রভাব স্বীকার করে নেওয়া তার কবি-প্রতিভা ও মানসিক প্রবণতার একটা বড় বৈশিষ্ট্য। তাই একই সঙ্গে তাঁর রচনায় ভাড়ামি ও গম্ভীর ভাব লক্ষ্য করা যাবে। ঈশ্বর গুপ্ত যুগসন্ধিক্ষণের কবি তাই উচ্চশিক্ষিত তরুণের দল তাকে বিশেষ প্রশংসা করতেন।"