বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে জসীমউদ্দিনের স্থান ও বিশেষত্ব সম্পর্কে অলােচনা কর।

বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, বিভিন্ন যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বিংশ শতকে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি, তার মন ও মূল্যবােধকে যে বিপুল পরিবর্তনের মুখােমুখি করেছিল, তারই ফলশ্রুতিতে আধুনিক কবিতা হয়ে উঠে জটিল, গৃঢ়চারী এবং দুর্বোধ্য। এক ধরনের হতাশা, ক্লান্তি, কখনাে বা নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যেন আধুনিক কবিদের এক সাধারণ লক্ষণ। সহজ দৃষ্টি, ঋজু প্রত্যয়, প্রকৃতিকে অপার মুগ্ধতায় দেখার সরল চোখ যেন আধুনিক কবিদের মধ্যে একান্তই অনুপস্থিত। বিশেষত ভাব ও ভাবনায় এক ধরনের তীব্র নাগরিকতা এই আধুনিক কবিদের পল্লী-প্রধান বাংলার রূপ ও রস সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে। বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতে আধুনিক যুগপর্বে যে কজন ব্যক্তিত্ব বঙ্গ-প্রকৃতির রূপমুগ্ধতাকে অকুষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য যামিনী রায়, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ এবং জসীমউদ্দিন। একথা বলা অসঙ্গত নয় যে বরং অন্য তিন কবি-শিল্পীর মধ্যে যদি বা নাগরিকতার স্পর্শ পাওয়া যাবে, জসীমউদ্দিনের গ্রাম বাংলার প্রকৃতি-প্রেম একেবারে সরলভাবেই অকৃত্রিম।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বের দ্রুত পরিবর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলার কাব্য-জগতে জসীমউদ্দিনের (১৯০৩-৭১) পদার্পণ। শুধু গ্রামের কথা বলা, গ্রামের চিত্র আঁকা, গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখকথাই কারাে কাব্যে এযুগে সামগ্রিকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় না। গ্রামের পটচিত্রকে যামিনী রায় সাঙ্গিক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন তার নাগরিক মন নিয়ে, অথবা জীবনানন্দের পল্লী-প্রিয়তার পিছনে যেমন ছিল জটিল বিদগ্ধ এক মননশীল আধুনিক মন—তেমন মননশীলতা নিয়েও পল্লী প্রকৃতিকে ছুঁতে পেরেছেন কজনই বা। এই নগর-কেন্দ্রিক আধুনিক জটিল মানস-সৃষ্টি বাংলা কবিতার জগতে জসীমউদ্দিন নিয়ে এলেন নিখাদ মেঠো সুরের রাখালিয়া গান। একদিকে রাবীন্দ্রিক ভাবগম্ভীর কাব্যচ্যুতি, অন্যদিকে আধুনিক কবিদের দুর্বোধ্য জটিল কাব্য-প্রকরণের মাঝখানে রাখালিয়া সুরের আন্তরিক ও অকৃত্রিমতায় স্বভাবতই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন জসীমউদ্দিন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জসীমউদ্দিনের কবিতার রসাস্বাদনে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন 'জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে।' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেনও লিখেছিলেন- 'নক্সী কাঁথার মাঠ' কাব্যখানি পড়িয়া মুগ্ধ হইয়াছি। এখন সেই পুরাতন পল্লীকে ফিরিয়া পাইলাম...এই হারানাে জিনিস নূতন করিয়া পাওয়ার যে আনন্দ, কবি জসীমউদ্দিন আমাদিগকে তাহা দিয়াছেন।


১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে জসীমউদ্দিনের জন্ম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাশ করেন ১৯৩১-এ। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতাপ্রিয় মানুষের কাছে সমভাবে শ্রদ্ধা লাভ করেছেন জসীমউদ্দিন। তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— 'রাখালী' (১৯২৭), 'নক্সী কাঁথার মাঠ' (১৯২৮), 'সোেজন বাদিয়ার ঘাট' (১৯৩৪), 'বালুচর' (১৯৩২), 'ধানখেত' (১৯৩৯), 'রঙিলা নায়ের মাঝি' (১৯৪৬), 'মা যে জননী কান্দে', 'জলের লিখন', ‘পদ্মাপার’, ‘মাটির কান্না', 'হলুদ বরণী', 'সাকিনা', ‘পল্লীবধু’, ‘এক পয়সার বাঁশী', 'গাঙের পার', 'ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে' (১৯৭২), 'মাগাে জ্বালিয়ে রাখিস্ আলাে' (১৯৭৪)।


গ্রাম বাংলার রূপকল্প জসীমউদ্দিনের কাব্য অপরূপ রূপ নিয়েছে। বাংলা তার কাছে অখণ্ড, ভেদচিহ্ন হীন। তিনি এক বক্তৃতায় বলেছিলেন- 'সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দুই বার সীমান্ত মানি না। দেশের, মনের, ধর্মের, হৃদয়ের সমস্ত সীমান্ত অতিক্রম করে প্রাণের সাহিত্য সকল মানুষের একান্ত আপনার হয়।'


যথার্থই বাংলার প্রাণ অখণ্ড মূর্তি নিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছিল জসীমউদ্দিনের ব্যক্তিত্বে ও কাব্যে। তিনি মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর প্রতীক। তিনি বলেছিলেন- 'পূর্ববঙ্গ থেকে মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীরের ভালােবাসার সুর ও কথার প্রতীক হিসেবে এখানে এসেছি। এসেছি বুক ভরা ভালােবাসা নিয়ে ভায়ে ভায়ে কিছু দেওয়া নেওয়া করে নিতে।'


তাঁর এই ভালােবাসা শুধু কবিতার ভাষায় প্রকাশিত নয়। কর্মজীবনেও তিনি সক্রিয়ভাবে বাংলার প্রতি এই ভালােবাসাকে প্রকাশ করেছেন ময়মনসিংহ গীতিকা, লােকগীতি, নকসী কাথা, হাতে গড়া পুতুল সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। তিনি নিজেই দীনেশচন্দ্র ও অবনীন্দ্রনাথকে গুরু বলে স্বীকার করেছেন। মধুর, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছন্দভাবে গ্রাম-বাংলা তাঁর কবিতায় প্রতিবিম্বিত। আমাদের স্বপ্নময় সবুজ বাংলার শ্যামলী রূপকে খুঁজে পেতে হলে অবগাহন করতে হবে জসীমউদ্দিনের কবিতায়। নক্সী কাঁথার মাঠ বা ‘সােজন বাদিয়ার ঘাট' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ধানের শীষ, টিয়া, ফুলবন, দূর্বাঘাস,লাউলতা, বটগাছ, তেপান্তরের মাঠ যেন আমাদের নাগরিক কৃত্রিমতায় এক মধুর স্বপ্ন রচনা করে দেয়। রূপকথার রাজ্য হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে আমাদের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে মধুমালা। অথবা অন্ত্যজ বেদেবেদেনীর আদিম প্রেম-বিরহ অন্যতর স্বাদ নিয়ে ধরা দেয় আমাদের কাছে। নকসী-কাঁথার সেই মাঠ অথবা সােজন বাদিয়ার সেই ঘাট আমাদের নিয়ত হাতছানি দেয়।


নকসী কাঁথার মাঠ বহু আলােচিত কাব্যগ্রন্থ। কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত। এই কাব্যগ্রন্থের কাহিনীবস্তুর সঙ্গে পূর্ববঙ্গ গীতিকার প্রকৃতিগত ও রসগত সাদৃশ্য সুস্পষ্ট। দিগন্ত প্রসারিত মাঠের দুই প্রান্তে দুটি গ্রাম। দুই গ্রামের নায়ক-নায়িকা সাজু ও সুপুরুষ রূপার পূর্বরাগ, মিলন, তাদের সংসারের উজ্জ্বলরূপ গ্রামবাংলার পটভূমিতে সুন্দরভাবে ফুটেছে। দুই গ্রামের মধ্যে বিরােধ বাধে। পুলিশের থেকে পেতে গৃহত্যাগ করতে হয় রূপাকে। রূপার জন্য সাজুর আক্ষেপ, পীড়া এবং অবশেষে মৃত্যুতে বিষাদকরুণ এক ট্র্যাজেডিতে কাব্যের পরিসমাপ্তি।


কিন্তু সহজ সরল পল্লীবাংলার রাখালী কবি হিসাবে যাঁরা জসীমউদ্দিনকে জানেন,তাঁরা সম্পূর্ণ জানেন না। তার প্রথমদিকের কাব্যগ্রন্থগুলির জন্যই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন রসিক সমাজে। আবার সেই কাব্যগ্রন্থগুলির জন্যই তিনি আধুনিক, ভাবালুতাসর্বস্ব, অতীতচারী ও বাস্তব অসচেতন কবি হিসেবে সমালােচিতও হয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাষা, মেজাজ ও সুরের স্বাভাবিক বিবর্তন ঘটেছে। যৌবনে রচিত রাখালী', 'নকসী কাঁথার মাঠ', 'সােজন বাদিয়ার ঘাট' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ পল্লীবাংলার রােমান্টিক চিত্র যেন ময়মনসিংহ গীতিকার রসরূপের পুনর্নির্মাণ। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত যখন বাংলার পল্লীতে করাল ছায়া ফেলে, যখন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর তাড়নায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়; গ্রামের কৃষক সপরিবারে যখন শহরের ফুটপাতে ভিক্ষে করে অথবা ধুঁকে ধুঁকে মরে, তখন স্বভাবতই জসীমউদ্দিনের পল্নীচিত্রেরও বর্ণবদল ঘটে যায়। অথচ জসীমউদ্দিনের এই বিবর্তন রেখা প্রায় অনালােচিত, সে কারণে অজ্ঞাতপ্রায়।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় গ্রামবাংলার দুর্দশা কবি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন কৃষকের অন্নহীনতা, যন্ত্রণা। 'ধানখেত' কাব্যে এই যন্ত্রণার চিত্র আছে-

ক্ষুধিত মানুষ ছুটিছে উধাও, তৃষ্ণা মেটেনা কারও।

পেটে ভাত নাই, মুখে নাই হাসি, রােগে হাড়খানা সার; 

প্রেতপুরি যেন নামিয়া এসেছে বাহিয়া নরক দ্বার।


এমনকি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতা ও দেশের জন্য বাংলার মানুষের সংগ্রামও তাকে কাব্যপ্রেরণা দিয়েছিল। মুজিবর রহমানের স্তুতি করেও তিনি কবিতা লিখেছেন। ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২) এবং 'মাগাে জ্বালিয়ে রাখিস আলাে (১৯৭৪) কাব্যগ্রন্থদুটিতে সেই যুগসচেতনতার স্পষ্ট ছায়াপাত ঘটেছে।


তবু জসীমউদ্দিন তীব্র সমাজ বাস্তবতা ও রাজনীতির মধ্যে স্বচ্ছন্দ নন। বাস্তবের উত্তাপকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি ঠিকই, কিন্তু এই প্রতিকূল জীবনের মধ্যেও তিনি সন্ধান করেন। পল্লীবাংলার মাঠ বা নদীপাড়ের সেই মায়াময় আলাে, তাই তার শেষ কাব্যগ্রন্থের নামে সেই আকৃতিই ফুটে ওঠে- 'জ্বালিয়ে রাখিস আলাে।'