বাঙলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যার পরিচয় দাও। চণ্ডীদাসের একটি সম্ভাব্য সমাধানসূত্র উল্লেখ কর।

চণ্ডীদাসের সমস্যা সমাধান

সমস্যার সূত্রপাত: চণ্ডীদাসের কবিত্ব-খ্যাতি যে চৈতন্যদেবের কালেও বর্তমান ছিল, চৈতন্য জীবনীকারগণ তার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সনাতন গােস্বামীর ‘বৈষ্ণব-তােষণী’তেও চণ্ডীদাসের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান শতকের গােড়ার দিক পর্যন্ত চণ্ডীদাস একজন বিখ্যাত মহাজন পদকর্তা-রূপেই পরিচিত ছিলেন। নীলরতন মুখােপাধ্যায়-সঙ্কলিত চণ্ডীদাস পদাবলী' প্রকাশিত হবার পরই গ্রন্থধৃত পদগুলির বিষয়বস্তু এবং রচনারীতির মধ্যে বিরাট বৈষম্য লক্ষ্য করে কোন সনিষ্ঠ পাঠক চণ্ডীদাসের একত্ব বিষয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিলেন। এরপর বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভকর্তৃক বড়ু চণ্ডীদাস-রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' প্রকাশিত হবার পরই অনেকের মনে এই সন্দেহ দানা বাঁধে এবং চণ্ডীদাস-সমস্যা যেন মীমাংসাতীত হয়ে দাঁড়ায়। চণ্ডীদাস কয়জন ছিলেন, কোন কালে কে বর্তমান ছিলেন এবং কে কি রচনা করেছিলেন এ সমস্ত বিষয় নিয়ে পণ্ডিত মহলে বিস্তর বাদানুবাদ দেখা দেয়। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন একজন চণ্ডীদাসে বিশ্বাসী; তিনি মনে করেন যে, একজন চণ্ডীদাসই প্রথম জীবনে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' রচনা করেন এবং পরিণত বয়সে পদাবলী রচনা করেন। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন যে অষ্টাদশ শতকের গােড়ার দিকে সঙ্কলিত পদাবলী গ্রন্থ 'ক্ষণদাগীতচিন্তামণি'তে চণ্ডীদাসের কোন পদ উদ্ধৃত না হওয়াতে বড়ু চণ্ডীদাস ব্যতীত অপর কোন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বই সংশয়জনক। তান্ত্রিক নিবন্ধক এবং কীর্তনীয়াদের দৌলতেই চণ্ডীদাস' নামটি ব্যাপক প্রচার লাভ করে বলে তিনি মনে করেন। সতীশচন্দ্র রায়ও মনে করেন যে অপর সকল লেখকের রচনাই চণ্ডীদাসের ভণিতায় প্রচার লাভ করে। বিমানবিহারী মজুমদার আবার বড়ু চণ্ডীদাসের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। মণীন্দ্রমােহন বসু এবং শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বড়ু চণ্ডীদাস ব্যতীত একজন মাত্র চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। এই মতারণ্যের মধ্যে ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেবের অভিমত এবং যুক্তিপরম্পরা অতিশয় যুক্তিসিদ্ধ বলে মনে হয়। তিনি 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এবং পদাবলীর তুলনা করে দেখিয়েছেন-


  • (১) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কোন স্থানে (পদাবলীতে উক্ত) দ্বিজ চণ্ডীদাস বা দীন চণ্ডীদাস নাই; আছে বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতা। 

  • (২) [শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে] সর্বত্র 'গাএ' বা 'গাইল' আছে, কোথাও 'ভণে', 'কহে প্রভৃতি ক্রিয়াপদ নাই। 

  • (৩) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ভণিতা কখনও উপান্ত চরণে হয় না। হয় শেষ চরণে, কিন্তু পদাবলীতে কবির নাম উপান্ত চরণেই উল্লিখিত হয়। 

  • (৪) বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীমতী রাধিকার পিতামাতার নাম সাগর ও পদুমা বলিয়াছেন (পদাবলীতে শ্রীমতী-রাধার পিতা বৃষভানু ও মাতা যমুনা)। 

  • (৫) বড়ু চণ্ডীদাস রাধার কোনও সখী বা শ্বাশুড়ী-ননদের নাম উল্লেখ করেন নাই (পদাবলীতে জটিলা-কুটিলা রয়েছে)। তিনি বড়ই ভিন্ন কোনও সখীকে সম্বােধন করেন নাই। 

  • (৬) ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ রাধার নামান্তর চন্দ্রাবলী, প্রতিনায়িকা নহেন। 

  • (৭) বড়ু চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণের কোন সখার নাম উল্লেখ করেন নাই (পদাবলীতে শ্রীদাম, সুদাম প্রভৃতি রয়েছে)। 

  • (৮) বড়ু চণ্ডীদাস সর্বত্র প্রেম-অর্থে নেহ বা নেহা' ব্যবহার করিয়াছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কেবল চারিস্থলে 'পিরীতি' শব্দের প্রয়ােগ আছে, কিন্তু তাহার অর্থ প্রীতি বা সন্তোষ। 

  • (৯) বড় চণ্ডীদাস কুত্রাপি শ্রীমতী রাধিকার বিশেষণে 'বিনােদিনী' এবং শ্রীকৃষ্ণ অর্থ শ্যাম ব্যবহার করেন নাই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধিকা গােয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নহেন। 

  • (১০) অধিকন্তু বড়ু চণ্ডীদাসের নিকটে ব্রজবুলি অপরিচিত।


এইগুলির কষ্টি পরীক্ষায় চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত অনেক পদ যে বড়ু চণ্ডীদাস ভিন্ন অন্য চণ্ডীদাসের তাহাতে সন্দেহ থাকে না। ডঃ শহীদুল্লাহ প্রদর্শিত এই পার্থক্যগুলি ছাড়াও একাধিক চণ্ডীদাসের পক্ষে কতকগুলি সূত্র রয়েছে। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ লৌকিক প্রেমের চিত্র অঙ্কিত রয়েছে এবং এটি ঐশ্বর্যরসের কাব্য, পক্ষান্তরে পদাবলীর প্রেমে আছে আধ্যাত্মিকতা এবং এর রস একান্তভাবেই মধুর। 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শ্রীমতী রাধিকাকে অবতার-রূপে দেখানাে হয়েছে, কিন্তু পদকর্তাগণ শ্ৰীমতীকে লক্ষ্মীর মতই শ্রীকৃষ্ণের অন্যতমা এবং প্রিয়তমা প্রণয়িনী মনে করেন। সর্বোপরি পদাবলীতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজ-স্বীকৃত রাধাকৃষ্ণের সম্পর্কটিই রূপায়িত হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তার কোন পরিচয় নেই। অতএব সব মিলিয়ে একাধিক চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব স্বীকার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।


এবার প্রশ্ন, চণ্ডীদাস যদি একাধিক হয়ে থাকেন, তবে সেই সংখ্যা কত এবং কে কী রচনা করেছেন? এ বিষয়ে ডঃ শহীদুল্লাহ যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, তা শিরােধার্য করে নিলে অনেক অসঙ্গতির হাত এড়ানাে যায়। তিনি বলেন, দীন চণ্ডীদাস একটি ধারাবাহিক কৃষ্ণযাত্রা রচনা করিয়াছেন, যেমন বড়ু চণ্ডীদাস একটি ধারাবাহিক কৃষ্ণধামালী রচনা করিয়াছেন। কিন্তু দ্বিজ চণ্ডীদাস বিক্ষিপ্ত রচনা ভিন্ন কোন ধারাবাহিক কৃষ্ণলীলার বই রচনা করেন নাই। ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেবের মতানুযায়ী তিনজন চণ্ডীদাস বর্তমান ছিলেন- (১) একজন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামক ধারাবাহিক কৃষ্ণধামালী রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথির লিপি এবং ভাষার প্রাচীনত্ব, এতে 'দান- খণ্ড-নৌকাখণ্ডাদি'র উল্লেখ, চৈতন্যপ্রভাব-বর্জিত বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতির বিচারে এটিকে চৈতন্য-পূর্ববর্তী কালেই স্থাপন করতে হয়। (২) অপর একজন চণ্ডীদাস 'দ্বিজ' উপধিধারী বিচ্ছিন্ন পদাবলীর লেখক। এঁর পদগুলিই চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং খুব সম্ভবতঃ চৈতন্যদেব এই দ্বিজ চণ্ডীদাসের পদেরই রস আস্বাদন করতেন। তাহলে দ্বিজ চণ্ডীদাসও চৈতন্য-পূর্ববর্তীকালে অথবা চৈতন্যদেবের সমকালেই বর্তমান ছিলেন। বড়ু চণ্ডীদাস ছাড়াও যে অপর একজন চণ্ডীদাস চৈতন্য-পূর্বকালে বর্তমান ছিলেন, তার প্রমাণচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে উদ্ধৃত একটি পদের বিশ্লেষণে পাওয়া সম্ভব। চৈতন্যদেব চণ্ডীদাস-রচিত নিম্নোক্ত পদটির রস আস্বাদন করতেন-


হায় হায় প্রাণসখি কিনা হৈল মােরে।

কাহ্নপ্রেম বিষে মাের তনু মন জারে।।

রাত্রিদিন পােড়ে প্রাণ সােয়াস্থ্য না পা। 

যাহা গেল কাহ্ পা তাহা উড়ি যা।।


পদটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে নেই। এছাড়া উক্ত গ্রন্থে 'প্রাণসখি' শব্দের প্রযােগ সম্ভব নয় অতএব পদটি বড়ু চণ্ডীদাস-ব্যতীত অপর কোন চণ্ডীদাসের রচনা এবং তনি অবশ্যই চৈতন্য পূর্ববর্তীকালে বর্তমান ছিলেন। (৩) তৃতীয় চণ্ডীদাস ‘দীন'-পদবীযুক্ত, যিনি পালাগান রচনা করেছেন। চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলির মধ্যে এর পদগুলিই নিকৃষ্ট বিবেচিত হয়ে থাকে। ইনি অবশ্যই চৈতন্যোত্তর যুগে বর্তমান ছিলেন। ডঃ শহীদুল্লাহর মতানুযায়ী তিনজন চণ্ডীদাসকে মেনে নিলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান হয়ে থাকে, কিন্তু সব সমস্যা মেটে না। এই তিন জাতীয় পদের বাইরেও অন্ততঃ একজাতীয় পদকে অবশ্যই পৃথক করা চলে—এগুলি অধিকাংশই রূপকাশ্রিত সহজিয়াদের পারিভাষিক ভাষাসমন্বিত পদ। (৪) অতএব ‘তরুণীরমণ চণ্ডীদাস’ নামাঙ্কিত সহজিয়াপন্থী একজন চতুর্থ চণ্ডীদাসকে কল্পনা করে নিলে সমস্যার আরাে কিছুটা সমাধান হয়। ফলতঃ অন্ততঃ এই চারজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে উপযুক্ত সমস্যাগুলি ছাড়াও আরাে কিছু সমস্যার নিরসন ঘটে। যেমন, চণ্ডীদাসের জন্মভূমির দাবিদার নানুর এবং ছাতনা—এক চণ্ডীদাসের দুই জন্মস্থান হতে পারে না; চণ্ডীদাস তাই একজন নন। লােকশ্রুতি এই বিদ্যাপতির সঙ্গে চণ্ডীদাসের সাক্ষাৎকার হয়েছিল। চৈতন্যোক্তর কালে ‘ছােট বিদ্যাপতি'র সঙ্গে ‘দীন’ বা সহজিয়া' চণ্ডদাসেরই এই সাক্ষাৎকার ঘটতে পারে।


চারজন চণ্ডীদাসের কল্পনাতেই যে চণ্ডীদাস-সমস্যার পূর্ণ সমাধান ঘটে, এমন বিশ্বাস যুক্তি- সঙ্গত নয়। হয়তাে বা আরাে অনেক চণ্ডীদাস থেকে থাকতে পারেন, হয়তাে অনেক কবি ‘চণ্ডীদাস’ নামও গ্রহণ করে থাকতে পারেন। আবার এর বিপরীত ক্রমটিও অসম্ভব নয়। অপর কোন কোন কবির রচনাও যে চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত রয়েছে, তা তাে প্রমাণিত সত্য। এমন ঘটনা আরাে অনেক হয়ে থাকতে পারে যেগুলি এখনাে ধরা পড়েনি। ডঃ সুকুমার সেনের অনুমান এ বিষয়ে যথার্থ হওয়াই সম্ভব। তিনি বলেন। “চণ্ডীদাস-ফ্যাশান প্রবর্তিত হওয়ায় শুধু যে চণ্ডীদাস-ভণিতায় নূতন পদ রচিত হইতে লাগিত এমন নহে, পুরাতন কবিদের উৎকৃষ্ট পদগুলি চণ্ডীদাস ভণিতায় রূপান্তরিত হইতে লাগিল। ইহার জন্য দায়ী অবশ্য কীর্তনীয়ারাই বেশী। এই কারণেই নরহরি সরকার, লােচনদাস, জ্ঞানদাস, বলরামদাস, নিত্যানন্দদাস, রামগােপাল ইত্যাদি কবির ভাল ভাল পদ পরবর্তীকালে পুঁথিতে ও কীর্তনীয়াদের মুখে চণ্ডীদাসের ভণিতায় পাওয়া যাইতেছে।"


শেষ কথা—চণ্ডীদাস সম্বন্ধে আরাে তথ্য আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত চণ্ডীদাস সমস্যার পূর্ণ সমাধান সম্ভবপর নয়। আপাতত চারজনকে নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।