তুর্কী-আক্রমণ কালকে 'বাঙালীর মানস প্রস্তুতির কাল' বিষয়ের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে অভিমত | বাঙলা সাহিত্যের প্রথম 'ক্রান্তিকাল' বা 'যুগান্তর কাল'

তুর্কী-আক্রমণের পরবর্তীকালে গৌড়বঙ্গের সামাজিক অবস্থা

খ্রীঃ ১২০০ অব্দের সন্নিহিত কোন তারিখে ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বক্তিয়ার খিলজি মাত্র সপ্তদশ অশ্বারােহী নিয়ে বঙ্গবিজয় করেছিলেন এই গল্পকথায় আস্থা স্থাপন না করেও বিশ্বাস করা চলে যে এই তুর্কী-আক্রমণ গৌড়বঙ্গে একটা তুমুল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর আগেও ভারতের বুকে বহু বিদেশি বিধর্মী শক্তি প্রবলভাবে আঘাত হেনেছে। ভারতে বহু রাজশক্তির উত্থান-পতন ঘটেছে, কিন্তু সাধারণ বাঙালীর জীবনে এর কোন প্রতিফলন ঘটেনি। কিন্তু তুর্কী-আক্রমণ বাঙালীকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল প্রত্যাঘাতের কথা বাঙালী কল্পনাই করতে পারেনি, এমনকি এরূপ কোন মানসিক প্রস্তুতিও তার ছিল না। আক্রমণের আকস্মিকতা ছাড়া বাঙালীর এই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণবাঙালীর সংহতি শক্তির অভাব।


গুপ্তযুগে গৌড়বঙ্গে আর্য-অভিবাসন প্রায় সম্পূর্ণতা লাভ করলেও তার পাশাপাশি প্রাগ-আর্য জনগােষ্ঠীও সমান্তরাল ধারায় এই দেশে বসবাস করছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারণে পাশাপাশি বসবাস করলেও দেশের আদি জনগােষ্ঠীর সঙ্গে আর্যসংস্কৃতি সম্পূর্ণ একীভূত হতে পারেনি। বরং প্রশাসন এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আর্যরক্তের প্রাধান্য তথা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির একচ্ছত্র স্বেচ্ছাচার অনার্য এবং বর্ণেতর সংস্কৃতির মানুষদের মনে ক্রমশঃ বিরূপতার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে সেন রাজত্বকালে সংকীর্ণ অনুদার ব্রাহ্মণ্য শাসন ও শাস্ত্রীয় অনুশাসন নিম্নবর্ণের মানুষদের রাষ্ট্রীয়, আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা সম্পূর্ণ হরণ করে নিয়েছিল। বহুধাবিভক্ত সমাজকাঠামাে দুর্বল হয়ে পড়ায় রাষ্ট্রশক্তিও অনিবার্যভাবে ভেতরে ভেতরে অবক্ষয়-প্রাপ্ত হয়েছিল। এই দুর্বলতার সুযােগেই ইতিহাসের নিয়মে বাংলার বুকে নেমে এসেছিল তুর্কী আক্রমণ এবং সপ্তদশ অশ্বারােহীর বঙ্গবিজয়-সংক্রান্ত গল্পকথার মর্মগত সত্য এই যে, তুর্কী বাহিনী অতি সহজেই বঙ্গবিজয়ে সমর্থ হয়েছিল।


তুর্কী আক্রমণের প্রতিক্রিয়া: তুর্কী আক্রমণের নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল বাঙালী সমাজে। স্বভাবতঃই প্রথম আকস্মিক আঘাত তাদের বিমূঢ় করে দেওয়াতে অনেকেই আত্মরক্ষার তাগিদে কৃর্মবৃত্তি অবলম্বন করলেন। অনেকেই একই প্রয়ােজনে স্বদেশ ত্যাগ করে পূর্ববঙ্গ নেপাল বা সন্নিহিত অপর কোন হিন্দুরাজ্যে চলে গেলেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে এই আক্রমণের পরও শতাব্দীকাল পূর্ববঙ্গে সেন বংশের রাজত্ব ছিল অব্যাহত। প্রধানতঃ নিম্নশ্রেণীর বহু হিন্দু এবং বৌদ্ধ ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছিল। আবার বৃহত্তর বাঙালী সমাজ হয়তাে বা সংঘশক্তির উপযােগিতা স্বীকার করে নিয়ে সমান্তরাল অনার্য ধারার সঙ্গে একটা বােঝাপড়ায় আসতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে অনার্যরাও পঞ্চমবর্ণের হিন্দু বলে স্বীকৃতি লাভ করলেন "বাইরের এই প্রবল আঘাত তাদের নিকট শাপে বর হয়ে দেখা দিল। দীর্ঘকাল প্রতিবেশিত্বের ফলে তাদের মিলন না ঘটলেও একটা সমান অনুভূতির ভাব নিশ্চয়ই গড়ে উঠছিল, এবার উভয়ের সম্মুখে একই শত্র—বিদেশী বিধর্মী অপরিচিত একটা জাতি-অতএব আর্য-অনার্য জাতির মিলন ত্বরান্বিত হয়ে উঠবার সুযােগ পেল। কালের প্রভাবে স্বাভাবিকভাবেই হয়তাে কখনাে এই মিলন ঘটত, কিন্তু আত্মরক্ষার তাগিদে তাদের অকালেই মােহমুক্তি ঘটল—আর্য-অনার্য জাতির সংমিশ্রণে বিরাট হিন্দুজাতির অভ্যুদয় হলাে। তুর্কী আক্রমণ বাঙালীর জাড্য নাশ করেছিল, তার সুপ্তি ভাঙিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলুল, বাঙলাদেশে তুর্কী-আক্রমণের এই পরােক্ষ সুফলটিকে অস্বীকার করবার কোন উপায় নাই।” (সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়', প্রথম খণ্ড ও পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য)।


মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব: আর্য-অনার্য-সংস্কৃতি সমন্বয়ের ফল দেখা দিল সমাজদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। অনার্যরা আর্য সমাজে গৃহীত হবার ফলে বহু অনার্য দেব-দেবী, ধর্মীয় ভাবনা-কামনা এবং আচার-আচরণও কতকাংশে হিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ লাভ করেছিল তুর্কী আক্রমণের প্রচণ্ড অভিঘাতে সমাজে যখন মহতী বিনষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তখন আর্যরাও দৈবশক্তির অনুগ্রহ কামনায় অনার্য সমাজ থেকে আগত দেবদেবীদের সাদরে বরণ করে নিলেন। নবাগত দেবতাগণ প্রথমতঃ সমাজের নিম্নস্তরে আশ্রয় পেলেও শীঘ্রই উচ্চবর্ণের হিন্দুরাও দেবতাদের জাতে তুলতে সচেষ্ট হলেন। এই সদ্য-উন্নীত দেবতাদের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই বাঙলা সাহিত্যে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করা হলাে—এটি মঙ্গলকাব্য। এগুলি সম্ভবতঃ প্রথমদিকে ক্ষুদ্র পাঁচালী আকারে রচিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে গােটা সাহিত্যের ইতিহাসে এই শাখাটি বিশিষ্টতা অর্জন করে।


তামস যুগ: বক্তিয়ার খিলজি অতি সহজেই নদীয়া (নবদ্বীপ) জয় করে সম্ভবতঃ চতুষ্পর্শ্বে তার অধিকার বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু ১২০৬ খ্রীঃ তার মৃত্যুর পর দেড়শত বৎসর কাল গােটা দেশের উপর দিয়ে যে রাজনৈতিক ঝঞাবাত প্রবাহিত হয়েছিল, তার ফলে এই যুগটাকে বলা হয় ‘ক্রান্তিকাল’—অনেকেই এটিকে তামস যুগ (Dark Age) বলেও অভিহিত করেছেন। তবে আমাদের মনে হয়, এই যুগটিকে ক্রান্তিকাল' বলাই সঙ্গত, কারণ এই যুগে যেমন ভাঙার সমারােহ চলছিলাে, তেমনি এই দুর্যোগের মধ্যেই যে বাঙালীর মনে গড়ার উদ্দীপনাও দেখা দিয়েছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।


মানস প্রস্তুতির কাল: আঘাতে আঘাতে বাঙালী তখন বাঁচবার শক্তি অর্জন করেছে বাইরের আঘাত যত প্রবল হয়েছে, বাঙালীর বাঁচবার চেষ্টা হয়েছে তখন প্রবলতর। অনেক দুঃখ-বেদনা সহ্য করে অনেক আঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে বাঙালী অন্তর্মুখিতার খােলস থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের জগতে মাথা তুলে তখন দাঁড়ানাের সামর্থ্য অর্জন করেছে, তাই এই যুগটাকে যথার্থভাবে নামাঙ্কিত করা চলে বাঙালীর 'মানস প্রস্তুতির কাল' বলে।


পাঠান শাসকগণ: বক্তিয়ার খিলজির মৃত্যুর পর তার আমীর ওমরাহগণ ১২২৭ খ্রঃ পর্যন্ত শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এদের মধ্যে একমাত্র গিয়াসুদ্দিন খিলজিই তাঁর শাসনকালে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেরেছিলেন। এরপর ১২২৭ থেকে ১৩৪১ খ্রীঃ পর্যন্ত দিল্লীর সুলতানরাই দিল্লী থেকে বাঙলার শাসন চালিয়েছেন। কিন্তু যারা শাসক নিযুক্ত হয়ে এদেশে এসেছে, তারা যেমন কেউ স্বস্তিতে ছিলেন না, তেমনি দেশেও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন নি। ১৩৪২ খ্রীঃ সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহই দীর্ঘকাল পর বাঙলার সুদৃঢ়  শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। বস্তুতঃ তার শাসন আরম্ভ হবার পরই ক্রান্তিকালের সমাপ্তি ঘটে বলে মনে করা চলে। এর পরই সম্ভবতঃ বাঙলা সাহিত্যে নবসৃষ্টির প্রেরণা দেখা দিয়েছিল। পূর্ববর্তী দেড়শত বৎসরের মানসপ্রস্তুতি এবার সুফল প্রদান করতে আরম্ভ করে। দেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কিন্তু আরও বিলম্বিত হয়েছিল। ১৪১৪ খ্রীঃ পর্যন্ত ইলিয়াস বংশীয়দের হাতেই রাজদণ্ড ছিল। এরপর হিন্দুরাজা গণেশ ও তার পুত্র যদু বালার সিংহাসন অধিকার করে ১৪৩৩ খ্রীঃ পর্যন্ত সেই অধিকার বজায় রাখেন। এর পর আবার ১৪৩৮ খ্রীঃ থেকে ১৪৮৭ খ্রীঃ পর্যন্ত ইলিয়াস শাহী বংশের শাসন বর্তমান ছিল। ১৪৮৭ খ্রীঃ থেকে ১৪৯৩ খ্রীঃ পর্যন্ত ছয় বৎসর কাল কয়েকজন হাবসী খাজা জোর করে সিংহাসন অধিকার করে রাখলে ১৪৯৩ খ্রীঃ সুলতান হােসেন শাহ বাল্লার শাসনরজ্জ্ব হস্তগত করেন। এই সঙ্গেই দেশে স্থায়ী সুশাসন আরম্ভ হয়।


সুস্থিরতা: ইলিয়াস শাহী শাসন প্রবর্তিত হবার পরই সাধারণভাবে বাঙলার উপর থেকে দুর্যোগের মেঘ অপসারিত হওয়ায় ক্রান্তিকালের সমাপ্তি ঘটে। ইলিয়াস শাহী সুলতানগণ বিদেশি এবং বিধর্মী হলেও সম্ভবতঃ বাঙলাকেই তাদের স্বদেশরূপে গ্রহণ করে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতির সংবর্ধনে। সচেষ্ট হয়েছিলেন। সমসাময়িক কালের কোন কোন বাঙালী কবি সশ্রদ্ধভাবেই তাদের নাম উল্লেখ করে গেছেন। ব্রাহ্মণ্য শাসনাধীন আর্য সমাজ দেশীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা নিষিদ্ধ করলেও এই মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপােষকতায় অনেকেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় যে অগ্রসর হয়েছিলেন, তা প্রমাণিত সত্য। এই তুর্কী আক্রমণ যে পরােক্ষভাবে বাঙলা সাহিত্যের উন্নয়নে যথার্থ সহায়তা দান করেছিল এ সত্য অস্বীকার করবার উপায় নেই।