১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল বিশ্বের ইতিহাসে 'সাম্রাজ্যবাদের যুগ' হিসেবে পরিচিত কেন?

সূচনা: উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশগুলি উপনিবেশের বাজার দখলের জন্য তীব্র প্রতিযােগিতায় মেতে ওঠে। মূলত ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়। ঐতিহাসিক ডেভিড থমসন তাঁর ইউরােপ সিনস নেপােলিয়ন গ্রন্থে তাই লিখেছেন—“সাম্রাজ্যবাদ’শব্দটি উনিশ শতকের মধ্যভাগের আবিষ্কার এবং তারপর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল সাম্রাজ্যবাদের যুগ নামে পরিচিত। এই সময়কালে সাম্রাজ্যবাদীর শক্তিগুলির মধ্যে নানা সংঘাত ঘটায় সময়কালটি সাম্রাজ্যবাদের যুগ নামে পরিচিতি পায়।


সাম্রাজ্যবাদের যুগ ১৮৭০-১৯১৪

[1] সেডানের যুদ্ধ: ফ্রান্স ও প্রাশিয়ার মধ্যে সেডানের যুদ্ধ (১ সেপ্টেম্বর, ১৮৭০ খ্রি.) বেধেছিল। এই যুদ্ধের ফলে ভিয়েনা ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটে, ফ্রান্স ও জার্মানির সাম্রাজ্য সীমানা সংশােধন করা হয়। ফ্রান্সে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয় এবং সেডানের যুদ্ধের পর ইউরােপীয় রাজনীতির ভারকেন্দ্র প্যারিস থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়। এই যুদ্ধের পর জার্মানির উত্থান ইউরােপের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদের প্রসার ঘটায়।


[2] বলকান সংকট: তুর্কি সাম্রাজ্যভুক্ত বলকান অঞ্চল জুড়ে মিশরীয়, বালগেরিয়য়া, রােমেনিয়াে, আলবেনিয়াে, গ্রিক, সার্ব প্রভৃতি নানা জাতিগােষ্ঠির বসবাস ছিল। ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি আলাদা হওয়ায় এদের মধ্যে তেমন মিল ছিল না। তাই এরা তুরস্কের অধীনতা পাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই শুরু করে। বলকান সংকটে রাশিয়া সর্বপ্রথম হস্তক্ষেপ করে এবং নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এদিকে বলকান অঞ্চলে রুশ প্রভাব বাড়লে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্স বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।


[3] রুশ-তুরস্ক যুদ্ধ: রুশ মদতে শ্লাভরা স্বাধীনতার লক্ষ্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলে যা প্যান শ্লাভ আন্দোলন (Pan-Slav Movement) বা সর্বশ্লাভবাদ নামে পরিচিত। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (অক্টোবর, ১৮৫৩ খ্রি. ফেব্রুয়ারি, ১৮৫৬ খ্রি.) রুশ প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষ্যে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সর্বশ্লাভবাদ আন্দোলন সমর্থন করেন। রাশিয়ার এই ভূমিকায় এবং তুরস্কের সুলতানের অপদার্থতায় বলকান অঞ্চল জুড়ে তীব্র বিদ্রোহ শুরু হয়। তুরস্কের সুলতান ইউরােপীয় শক্তিবর্গের শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি অমান্য করলে রুশ-তুরস্ক যুদ্ধ শুরু হয়। (১৮২৮-১৮২৯) খ্রি.। এই যুদ্ধে কোণঠাসা তুরস্ক বাধ্য হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে অ্যাড্রিয়ানােপল-এর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে (১৮২৯ খ্রি.)। অ্যাড্রিয়ানােপলের চুক্তির শর্তানুযায়ী তুরস্ক-রােমেনিয়া, সার্বিয়া ও মন্টিনেগ্রো—এই তিন দেশের সম্প্রসারণে এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বালগেরিয়া গঠনে রাজি হয়। পরবর্তীকালে সান স্টিফানাের সন্ধি (৩ মার্চ, ১৮৭৮ খ্রি.) ও বার্লিন সন্ধির (১৩ জুলাই, ১৮৭৮ খ্রি.) দ্বারা বলকান সংকটের সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সংকটের রেশ থেকে যায়।


[4] গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধ: গ্রিস তুরস্কের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও গ্রিক ভাষাভাষী কয়েকটি অঞ্চল তুরস্কের শাসনাধীনে বয়ে গিয়েছিল। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ভূমধ্যসাগরস্থ ক্রিট দ্বীপের বাসিন্দারা স্বেচ্ছায় গ্রিসের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করার কথা ঘােষণা করে। এই ঘােষণার পর গ্রিক সেনারা ক্রিট দ্বীপে প্রবেশ করে। তুর্কি সেনারা তাদের বাধা দিতে গেলে শুরু হয় গ্রিস-তুরস্ক যুদ্ধ যাতে গ্রিস হেরে যায়।


[5] তরুণ তুর্কি আন্দোলন: তুরস্কে এনভার পাশার নেতৃত্বে তরুণ তুর্কি আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল (১৯০৮ খ্রি.)। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল বিদেশি শক্তির প্রভাব থেকে তুরস্ককে মুক্ত রাখা। গোঁড়া মােল্লাতন্ত্রের বিরােধিতায় তরুণ তুর্কি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে বালগেরিয়া স্বাধীনতা ঘােষণা করে। অস্ট্রিয়া শ্লাভ অধ্যুষিত বসনিয়া ও হারজেগােভিনা প্রদেশ দুটি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নেয়।


[6] বলকান যুদ্ধ: ম্যাসিডােনিয়া আলবেনিয়ার খ্রিস্টান প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করলে তুরস্ক সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওটে। বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ানাের জন্য সার্বিয়া, গ্রিস, বালগেরিয়া ও মন্টিনেগ্রো—এই চারটি রাজ্য একজোট হয়ে বলকান লিগ গঠন করে। বলকান লিগ খ্রিস্টান প্রজাদের ওপর তুর্কি অত্যাচার বন্ধের দাবি জানায়। কিন্তু তুরস্ক বলকান লিগের এই দাবি অগ্রাহ্য করলে শুরু হয় প্রথম বলকান যুদ্ধ (৮ অক্টোবর, ১৯১২ খ্রি. - ৩০ মে, ১৯১৩ খ্রি.)। লন্ডন চুক্তির দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এদিকে ম্যাসিডােনিয়া অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে সার্বিয়া ও বালগেরিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধলে শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ (২৯ জুন - ১০ আগস্ট, ১৯১৩ খ্রি.)। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়া ও সার্বিয়ার মধ্যে চরম উত্তেজনামূলক সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীকালে সেরাজেভাে হত্যাকাণ্ড (২৮ জুন, ১৯১৪ খ্রি.) ঘটলে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (২৮ জুলাই, ১৯১৪ খ্রি. - ১১ নভেম্বর, ১৯১৮ খ্রি.)