মার্কসীয় তত্ত্বের ধারণায় সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত লেনিনের ভাবধারা আলােচনা করাে।

সাম্রাজ্যবাদের মার্কসীয় তত্ত্ব সম্পর্কিত লেনিনের মত

উৎস: ভি. আই. লেনিন তার সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় (Imperialism: the Highest Stage of Capitalism) গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃতি এবং পরিণতি আলােচনা করেছেন (১৯১৬ খ্রি.)। এই গ্রন্থে লেনিন বলেন, “সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের চরম পর্যায়।”


বক্তব্য: লেনিনের ধারণায় ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের ভিতরেই সাম্রাজ্যবাদের বীজ লুকিয়ে রয়েছে। তার মতে পুঁজিবাদের জঠরে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম পুঁজিবাদী দেশগুলির বিদেশনীতি পুঁজিবাদী শ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত হয়। অধিক মুনাফার লােভে শিল্প মালিকরা দেশবাসীর চাহিদা অপেক্ষা অনেক বেশি পণ্য উৎপাদন করে। ধনী বুর্জোয়ারা। উপনিবেশের দরিদ্র শ্রমিকদের ওপর শাসন চালায় এবং শােষণ করে। এই শােষিত সম্পদ সাম্রাজ্যবাদী দেশের জনগণ ভােগ করেন।


মতের ব্যাখ্যা: সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত লেনিনের মতকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়一 [i] নতুন বাজার ও নতুন উপনিবেশ দখল উভয়ই সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত পুঁজির বিনিয়ােগ ঘটিয়ে অতিরিক্ত মুনাফার লােভে উপনিবেশ দখল অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। [ii] পুঁজিবাদী দেশগুলি অন্যান্য স্বার্থ ভুলে আরও বেশি মুনাফার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর পরিণাম হিসেবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়। [iii] নতুন উপনিবেশ দখলের পর ঔপনিবেশিক শক্তি নিজের দেশের শ্রমিক অপেক্ষা দখলকারী দেশের শ্রমিকদের শােষণ করা অনেক বেশি সুবিধাজনক ও লাভজনক বলে মনে করে। [iv] দখলকারী দেশে। পুঁজির বিনিয়ােগ ঘটিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অনেক বেশি মুনাফা অর্জন করে এবং সেখানকার নতুন শ্রমিকশ্রেণির ওপর সীমাহীন শােষণ চালায়। এই উদ্বৃত্ত মুনাফার একাংশ পুঁজিবাদী দেশের শ্রমিকদের মধ্যেও বণ্টিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে শ্রমিকশ্রেণি অভিজাত ও শােষিত—এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই অভিজাত শ্রমিকশ্রেণি শ্রমিক বিপ্লবের কথা ভুলে গিয়ে বুর্জোয়াদের সমর্থন করে।


প্রকৃতি: লেনিন সাম্রাজ্যবাদের তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল


  • একচেটিয়া পুঁজিবাদ: লেনিন এক্ষেত্রে ৫টি আর্থিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল[a] একচেটিয়া পুঁজিবাদ অবাধ প্রতিযােগিতার অবসান ঘটায় এবং একক কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা করে। [b] পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বৃহৎ শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় যেমনভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যায় ঠিক তেমনভাবেই বৃহৎ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাংকগুলিও ধ্বংস হয় ও ব্যাংক পুঁজির কেন্দ্রীকরণ ঘটে। [c] উদ্বৃত্ত পুঁজিকে নিজের অধীনস্থ দেশগুলিতে দু-ভাগে ভাগ করা যায়, যথা উৎপাদনশীল পুঁজি (Productive Capital) হিসেবে এবং ঋণ পুঁজি (Loan Capital) হিসেবে। [d] পুঁজিবাদী দেশগুলি প্রকৃত অর্থে বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়।


  • ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ: পুঁজিপতিরা যখন দেখেন যে বাজারের ওপর তাদের একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন তারা অধিক মুনাফার জন্য অর্থ খরচ করেন না। পুঁজিবাদের এই পর্যায় হল ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ।


  • মৃতপ্রায় পুঁজিবাদ: ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের যখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটে তখন পুঁজিবাদ মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে পুঁজিবাদের সম্পূর্ণ পতন ঘটে এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়।


সমালােচনা


  • লেনিনের ধারণায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির উদ্ভব ও বিকাশের ফলে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে যা যথার্থ নয়।


  • সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে লেনিনের ব্যাখ্যা মূলত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশের বিদেশনীতির আলােচনার মাধ্যমে লেনিন তার এই ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেননি।


  • লেনিন বলেছেন পুঁজিপতি শ্রেণি নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সাম্রাজ্যস্থাপন করেন বা সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেন। কিন্তু লেনিনের এই যুক্তি ঠিক নয় কেননা বিশ্বের সমস্ত পুঁজিবাদী দেশ সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করেছে এমন উদাহরণ নেই।


  • লেনিনের ধারণায় পুঁজিবাদীরা সরকারকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে ব্যবহার করে থাকে।


উপসংহার: পরিবর্তিত বিশ্বে এই নীতি এখন আর কার্যকরী নয়। বর্তমানে একটিমাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।


সাম্রাজ্যবাদ বিকাশের বিভিন্ন স্তরগুলি সম্পর্কে লেখাে। ইউরােপের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের ঔপনিবেশিক নীতি পর্যালােচনা করাে।


১৮৭০ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বিশ্বের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদের যুগ হিসেবে উল্লেখ করা কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আলােচনা করাে।


দূরপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের বিবরণ দাও।