‘শেষের কবিতা'র নায়িকা লাবণ্য চরিত্রটি স্বরূপ নির্ণয় করাে।

‘শেষের কবিতা'র নায়িকা লাবণ্য চরিত্র

জ্ঞানতাপস্বী অধ্যাপক অবনীশ দত্তের কন্যা লাবণ্য সম্পর্কে লেখক এইভাবে পরিচয় দান করেছেন— "মাতৃহীন মেয়েকে এমন করে মানুষ করেছেন যে, বহু পরীক্ষা পাশের ঘষাঘষিতেও তার বিদ্যাবুদ্ধিতে লােকসান ঘটাতে পারেনি। এমনকি এখনও তার পাঠানুরাগ প্রবল।" মেয়েকে অত্যন্ত স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন অবনীশ, কিন্তু তাঁর স্নেহের আর একটি পাত্র ছিল সে তার দরিদ্র মেধাবী ছাত্র শােভনলাল। শােভনলালের সঙ্গে লাবণ্যর একটা ঈর্ষার সম্পর্ক ছিল। এই ঈর্ষার ফলেই পিতার অসম্মতি সত্ত্বেও সে একদিন শােভনলালকে বিশ্রীভাবে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল।


লাবণ্য চরিত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল— সে অত্যন্ত জেদী এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকার মেয়ে। সে নিজেই ক্রমাগত জেদ ধরে অবনীশের বিবাহ ঘটিয়েছে এবং বিবাহের পর আত্মনির্ভর হবার বাসনায় পৈতৃক সম্পত্তি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে যােগমায়ার মেয়ে সুরমার শিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। মােটামুটি ভাবে তার চরিত্র সম্পর্কে বলা যায়, অমিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার পূর্বেই অনেক দাহের মধ্যে দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে। সে এক পরিণত মনের আত্মপ্রতিষ্ঠ এবং আত্মগঠিত মেয়ে। তার আপাত শান্ত জীবন পড়াশুনার আবরণে ঢাকা থাকলেও শােভনলালের প্রতি অবিচারের একটি বেদনার স্মৃতি তার মধ্যে চাপা ছিল।


এই সময়েই লাবণ্যর জীবনে আলােড়িত ও আলােকিত করে দেখা দিল অমিত। প্রেমের আলাে মানুষের অন্তর কীভাবে আলােকিত করে, প্রেমের দৃষ্টিতে মানুষ কত সুন্দর হয়ে ওঠে দীর্ঘদেহী, চিকন শ্যামবর্ণের এই মেয়ে তা প্রথম জানতে পারলাে। এর আগে শােভনলালের নীরব প্রণয়ে তার প্রেমের যে মুকুল প্রস্ফুটিত হবার সুযােগ পায়নি, সহসা তা শতদল পুষ্পে বিকশিত হল। অমিতের সােচ্চার প্রেম নিবেদন এবং তার উদ্ভাসিত হৃদয়ের উপযুক্ত প্রকাশ অনবদ্য বাণীবন্দনায়। লাবণ্যর সাধ্য ছিল না নিজের হুদয়কে আবদ্ধ করে রাখবার। তবু একদিন এই প্রেমকে প্রকারান্তরে তাকে অস্বীকার করতে হয়েছে। অথচ এই লাবণ্যকে একদিন যােগমায়ার নিকট বলতে শােনা গেছে- "একসময়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আমি নিতান্তই শুকনাে—কেবল বই পড়ব আর পাশ করব, এমনি করেই আমার জীবন কাটবে। আজ হঠাৎ দেখলুম, আমিও ভালাে করতে পারি। আমার জীবনে এমন অসম্ভব যে সম্ভব হল এই আমার ঢের হয়েছে। মনে হয়, এতদিন ছায়া ছিলুম, এখন সত্যি হয়েছে।" ঠিক হয়েছিল আগামী অঘ্রান মাসে অমিত ও লাবণ্যর বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন হবে।


কিন্তু এই আসন্ন বিবাহ তাদের পন্ড হয়ে যায় কলকাতা থেকে কেটি মিটারের আগমনে। হয়তাে এ নিয়েও লাবণ্য তেমন বিচলিত হতাে না, কিন্তু কেটি যখন স্পষ্টই বলে অমিত ভালােবেসে তার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়েছিল, তখন সিদ্ধান্ত নিতে লাবণ্যর দেরি হয় না। কারণ, উদ্ধত আচরণের চেয়েও অনেক বেশি সত্য হয়ে ওঠে তার চোখের জল। লাবণ্য কেটির জন্য মৃদু অনুযােগও করে অমিতকে। অমিত বলতে চেষ্টা করে সেদিনের কেতকী আর আজকের কেটি এক নয়। লাবণ্য বুঝিয়ে দেয়, সেদিনের কেতকী অমিতের নিস্পৃহতাতেই আজকের কেটি হয়েছে।


আত্মগঠিত এই লাবণ্য যখন প্রেমিকা হিসাবে নবজন্ম লাভ করে তখনই তাে তার পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব—কী অসীম বেদনায় কেতকীকে কেটি মিটার হতে হয়েছে। তখনই তাে সে নিঃশেষে, উপলব্ধি করতে পারে শােভনলালের নীরব প্রেমের সুরভিত মাধুর্য। প্রেমের মূল্য যে বােঝে, অকৃত্রিম প্রেমিকের আহ্বান সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। শােভনলালের সঙ্গে দেখা তাকে তাই করতেই হয়। কিন্তু লক্ষ্য করতে হবে লাবণ্যের প্রত্যাখ্যানের কিছুদিন পরেই অমিতের সম্বন্ধে যেমন শােনা যায়- "সে আজকাল কেটি মিত্তিরের বাইরেকার রংটা ঘােচাতে উঠে পড়ে লেগেছে"। লাবণ্য সম্পর্কে তেমন কোনাে জনশ্রুতি নেই, তাই স্বীকার করতেই হয়, কেতকীর সঙ্গে অমিতের বিবাহ সম্ভাবনার কথা লাবণ্য নিশ্চয়ই জেনেছে। কাজেই তার পূর্ব প্রণয়ী শােভনলালের কাতর মিনতির আহ্বান সে কেমন করে প্রত্যাখ্যান করে?


সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অমিত লাবণ্যর যে মহিমা কল্পনার দ্বারা সৃষ্টি করেছে। লাবণ্য চায় অমিত তাই গ্রহণ করুক। প্রত্যহের তুচ্ছতা তাকে মলিন করতে পারবে না—

"মর্তের মৃত্তিকা মাের, তাই দিয়ে অমৃত মুরতি 

যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি অরতি

হােক তব সন্ধ্যাবেলা

পূজার সে খেলা

ব্যাঘাত পাবে না মাের প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে"


অমিত সেটা করেছে এবং করেছে সে একথা জেনেই যে এইভাবেই সে প্রকৃত প্রেমের যােগ্য হতে পারবে, ধন্য হবে তার জীবন। সেইজন্যই সে বলতে পারে- "গ্রহণ করেছাে যত ঋণী তত করেছাে আমায়।"


শােভনলালের মতাে পুরুষকে প্রতারণার কোনাে কারণ নেই। লাবণ্যকে পাবার জন্য সে দুঃখের তপস্যা করেছে। লাবণ্যর মহত্ব নয় তার ভালাে মন্দ সবই সে গ্রহণ করতে পারে। এইরকম পূজায় আহুতি দিতে নিজেকে তার বাধে না—

"ভালাে মন্দ মিলায়ে সকলি

এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।"


লাবণ্য একদা শােভনলালের প্রেমের যােগ্য ছিল না, অমিত আজ তাকে সে যােগ্যতাে দান করেছেএই ঋণ সে চিরদিন স্মরণ রাখবে। কিন্তু এই ঋণই তাকে শােভনলালের সঙ্গে দাম্পত্য রচনায় শক্তি জোগাবে। কারণ একদিকে যেমন শােভনলালকে ভালোবাসার শক্তি তার মধ্যে জাগিয়েছে অমিত, অন্যদিকে নিজেকে মহিমময়ী করে তােলার কোনাে দায় তার থাকবে না, লাবণ্য চরিত্রের এই অনুভূতির ঐশ্বর্যই তাকে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল করে তুলেছে।