আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের কারণ । আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ

ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে আইনসভা হল একটি বহুমুখী কার্য সম্পাদনকারী সংস্থা। আইন প্রণয়ন (Rule Making) হল আইনসভার মুখ্য কাজ। আইন প্রণয়ন ছাড়াও আইনসভাকে নানাবিধ ভূমিকা পালন এবং কার্য সম্পাদন করতে হয়। তবে সাম্প্রতিককালে আইনসভার মর্যাদা, প্রভাব এবং ক্ষমতা হ্রাসের কারণ ইত্যাদি সংক্রান্ত আলােচনা সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।


আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস: আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস বলতে তার ক্ষমতা বা নৈপুণ্য হ্রাসের পরিস্থিতিকে বােঝানাে হয়। পূর্বে যে দক্ষতার সঙ্গে আইনসভা ক্ষমতা প্রয়ােগ করে বর্তমানে তার ব্যাপকতা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে শাসন বিভাগের ক্ষমতা এবং প্রভাব যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার তুলনায় আইনসভার ক্ষমতা অনেক কম বৃদ্ধি পেয়েছে। অধ্যাপক কে সি হােয়ার এই অভিমত পােষণ করেন যে, আইনসভার ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এ কথা ঠিক কিন্তু শাসন বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে, সবক্ষেত্রেই আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।


আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের কারণ

(১) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি: জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জটিলতা, জনগণের মনস্তত্ত্বের পরিবর্তন, দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা, আইনসভার সদস্যদের গুণগত যােগ্যতা হ্রাস, অর্থনৈতিক সংকট, আইনসভার সদস্যদের আলােচনার উপর সাংবিধানিক বিধিনিষেধ আরােপ ইত্যাদি আইনসভার ক্ষমতাকে নিষ্প্রভ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের শাসক প্রধান প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে বলেন প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতি কর্ণ ঘটেছে।


(২) জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব: জনসাধারণের মনস্তত্ত্বও শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। বাস্তবে শাসন বিভাগই আধুনিক রাষ্ট্রে সকল বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাই শাসন বিভাগের প্রতি জনগণের আগ্রহ বৃদ্ধি আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাসের একটি কারণ।


(৩) দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা: দলীয় ব্যবস্থার কঠোরতা তথা নিয়মানুবর্তিতা অর্থাৎ দলীয় আদেশ-নির্দেশ, শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক দৃঢ়তা আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ। আইনসভার সদস্যরা দলীয় নির্দেশ অনুসারে আইনসভার অভ্যন্তরে তাদের বক্তব্য পেশ ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করেন। শাসকদলের সদস্যরা আইনসভায় এমন কিছু করেন না যা তাদের সরকারের এবং নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে তােলে। তাই নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের স্বার্থে দলীয় নির্দেশকে পালন করাই তারা শ্রেয় বলে মনে করেন।


(৪) আইন প্রণয়নে আইনসভার শিথিলতা: আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার প্রাধান্য তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ আইন শাসন বিভাগের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়। আইনসভায় শাসকদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার জন্য দলীয় নির্দেশে মন্ত্রীসভার সদস্যরা সরকারের এবং সরকার পক্ষের সদস্যরা কোনাে বিলের পক্ষে ভােট দেন। তাই অনেকে মনে করেন যে, আইন প্রণয়নে আইনসভার ভূমিকা এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।


(৫) অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: সাম্প্রতিককালে সরকারের আর্থিক বিষয়গুলি বেশ জটিল প্রকৃতির ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যা বিশ্লেষণের জন্য বিশেষজ্ঞদের প্রয়ােজন, কিন্তু আইনসভার সকল সদস্য আর্থিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন, সদস্যদের এই অনভিজ্ঞতা ও কাজের প্রতি অনুৎসাহ শাসন বিভাগের হাতকে শক্তিশালী করে তুলেছে। ভারতে ও ব্রিটেনে পাবলিক অ্যাকাউন্ট কমিটি, এস্টিমেট কমিটি, অডিটর ও কম্পট্রোলার জেনারেল থাকলেও তা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।


(৬) আইনসভার সদস্যদের সংসদীয় গুণগত যােগ্যতার মান হ্রাস: আইনসভার সদস্যদের গুণগত মান হ্রাস জনমানসে এবং বাস্তবে আইনসভার প্রভাব ও ক্ষমতা হ্রাসে সাহায্য করেছে বলে অনেকে মনে করেন। তা ছাড়া আইনসভার মধ্যে একঘেয়েমি ও অর্থহীন। বাগাড়ম্বর সাধারণ মানুষের কাছে আইনসভার বিতর্কের আকর্ষণ ও গুরুত্ব হ্রাসের আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে বিবেচিত হয়।


(৭) স্বার্থগোষ্ঠী যােগসূত্র হিসেবে ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা: পূর্বে আইনসভা মূলত শাসন বিভাগ এবং জনগণের মধ্যে সংযােগসাধনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন স্বার্থগােষ্ঠীর উদ্ভব ও পেশাগত গােষ্ঠীর উদ্ভব এবং তাদের সঙ্গে যােগাযােগে ব্যর্থতার কারণেও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।


(৮) অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন: অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের পদ্ধতিকেও আইনসভার প্রভাব হ্রাসের একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সময়ের অভাব, জরুরি অবস্থায় সংকট মােকাবিলা, আইনের নমনীয়তা, আইনসভার সদস্যদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের অভাবের ফলে বাধ্য হয়েই আইনসভার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা শাসন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।


(৯) আলোচনার সুযোগের অভাব: আইনসভার বিরোধী দল অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সরকারের দোষ, ত্রুটিবিচ্যুতি বা ব্যর্থতার সমালােচনা করতে পারে। কিন্তু সরকার যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।


(১০) আইনসভার সদস্যদের স্বার্থপর মানসিকতা: সমালােচকরা মনে করেন, আইনসভার সদস্যদের বেতন, ভাতা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় বলেই তাদের মধ্যে স্বার্থপর মানসিকতার সৃষ্টি হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে আইনসভার সদস্যরা নিজেদের সুযােগসুবিধা সংরক্ষণের কাজে বেশি মনােযােগী হয়ে উঠেছে। এইজন্যই আইনসভার ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, যার ফলস্বরূপ শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।


উপসংহার: উপরোক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সরকারের ক্ষমতার ভারকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটেছে - পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রভাবে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আইন বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, আইনসভা তাদের পূর্ব গৌরব ও প্রতিপত্তি বহুলাংশে হারিয়ে ফেলেছে এবং সকলের কাছে একটি তর্কবিতর্কের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ব্লন্ডেলের ভাষায় বলা যায়, বর্তমানে আইনসভার ক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেলেও সংযােগসাধনের মাধ্যম হিসেবে আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের ধারণাকে কোনােভাবেই সমর্থন করা যায় না।