আধুনিক রাষ্ট্রে আইন বিভাগের কার্যাবলি । আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার প্রধান দুটি কাজ

ভূমিকা: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনসভা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাস্তবে আইনসভা হল একটি বহুমুখী কার্য সম্পাদনকারী সংস্থা। আইন প্রণয়ন (Rule Making) হল আইনসভার মুখ্য কাজ। আইন প্রণয়ন ছাড়াও আইনসভাকে নানাবিধ ভূমিকা পালন এবং কার্যসম্পাদন করতে হয়। অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, আইন সভার কার্যাবলিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা - শাসন বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ক কার্যাবলি, আইন বিষয়ক কার্যাবলি, প্রতিনিধিত্ব মূলক কার্যাবলি।

আধুনিক রাষ্ট্রে আইনসভার কার্যাবলি

(১) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ: আইনসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল আইন প্রণয়ন করা। আইন প্রণয়ন বলতে নতুন আইন প্রণয়ন, প্রচলিত আইন বাতিল অথবা সংশােধনের ক্ষমতাকে বােঝায়। অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, আইনসভার এই আইন সংক্রান্ত কার্যাবলি হল শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত কার্যাবলির সম্প্রসারণ। সাধারণভাবে এবং তত্ত্বগত বিচারে ধরে নেওয়া হয় যে, আইনসভার আইন প্রণয়ন করে, কিন্তু বর্তমান যুগে এই ধারণাটি সম্পূর্ণরূপে সত্য নয় কারণ অনেকের মতে, আইনসভা হল শাসন বিভাগের সম্প্রসারিত রূপ।


(২) অর্থ ও রাজস্ব সংক্রান্ত কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় আইন সভার সম্মতি নিয়েই প্রতি আর্থিক বছরের শুরুতে সরকারের জাতীয় আয় ব্যয় বা বাজেট পেশ করা হয়। শাসন বিভাগ বাজেট উত্থাপন করা সত্ত্বেও তা আইনসভায় আলােচনা করার জন্য পাঠানাে হয়। বলাবাহুল্য, পার্লামেন্ট বা আইনসভা সম্মতি দিলে বা অনুমোদন জানালে সরকার সেই বাজেট পেশ করতে পারে। অর্থাৎ আইন সভার অনুমোদন বা সম্মতি ছাড়া কর ধার্য, কর সংগ্রহ, করের হ্রাসবৃদ্ধি এমনকি কোনো রকম অর্থ ব্যয় করা যায় না। এইভাবে সরকারি আয়-ব্যয়ের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আইনসভার হাতে কুক্ষিগত থাকে।


(৩) শাসন বিভাগ গঠন ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত কাজ: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন বিভাগ গঠন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রীগণ আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্য থেকে আসেন। মন্ত্রীগণ ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে আইনসভার নিকট দায়িত্বশীল থাকেন এবং আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীগণকে পদত্যাগ করতে হয়। আবার আইন বিভাগ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, নিন্দাসূচক প্রস্তাব, মুলতুবি প্রস্তাব, বাজেট আলােচনা প্রভৃতির মাধ্যমে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।


(৪) বিচার বিভাগীয় কাজ: আইন বিভাগ আইনসভার কোনাে সদস্যকে বা সদস্যদের আচরণবিধি লঙ্ঘন, মিথ্যা ভাষণ, শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত কারণে সাময়িকভাবে বরখাস্ত, বহিষ্কার ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারে। এ ছাড়া নিজ সদস্যদের আচার-আচরণের বিচার করে থাকে আইনসভা। কোনাে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যদি কোনাে গুরুতর অভিযােগ আনা হয় তবে তা বিচার করো আইনসভা। ভারত, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতিদের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযােগ আসলে তার বিচার করে আইনসভা।


(৫) সংবিধান রচনা ও সংশােধন সংক্রান্ত কাজ : কোনাে কোনাে দেশের আইনসভা সংবিধান রচনা এবং সংবিধান-সংশােধনের ক্ষমতা ভোগ করে। ভারতীয় সংবিধানের ৩৬৮নং ধারা অনুযায়ী আইনসভা সংবিধান-সংশােধনের মূল ক্ষমতা ভোগ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সুইজারল্যান্ডের আইনসভা হল সেই দেশের সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা কর্তা।


(৬) নির্বাচন মূলক কাজ: আইনসভা প্রশাসনের উচ্চপদাধিকারীদের নির্বাচনের ক্ষমতা ভোগ করে। ভারতের আইন সভার সদস্যবৃন্দ যেমন বিধানসভা, লোকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্য বৃন্দ রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। চিনের আইনসভা জাতীয় গণকংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি ওই দেশের রাষ্ট্রপতি এবং বিচারপতিদের নির্বাচিত করে। সুইজারল্যান্ডের আইনসভা শাসন বিভাগের ৭ জন সদস্যকে নির্বাচনের ক্ষমতা ভােগ করে।


(৭) প্রতিনিধিত্বমূলক কাজ: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনসভা প্রতিনিধি সভা নামে পরিচিত। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সদস্যরাই আইনসভার সদস্য। ব্যাজ এর অভিমত অনুসারে আইন প্রণয়ন আইনসভার কোনাে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। আইনসভার অন্যান্য কাজগুলি প্রতিনিধিত্বমূলক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা সংরক্ষণ আইন সভার অন্যতম গুরু দায়িত্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। আইনসভার এই দায়িত্ব প্রতিনিধিত্বমূলক দায়িত্বের অঙ্গীভূত।


(৮) জনমত গঠন ও জন শিক্ষার প্রসার: গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হল জনমত। কি জনমত গঠনে আইনসভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইন সভায় আলােচিত বিভিন্ন বিল (আইনের খসড়া), বাজেট ইত্যাদি বিষয়ে সদস্যদের মধ্যে যে ডিবেট বা তর্কবিতর্ক হয় তার দ্বারা প্রচারমাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের সাহায্যে জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞান বৃদ্ধি পায় এবং আইন সভায় উত্থাপিত কোনাে বিল সংক্রান্ত বিষয়ের উপর পক্ষে ও বিপক্ষে জনমত তৈরি হয় এবং জনশিক্ষা প্রসারলাভ করে।


(৯) গণসংযোগের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা: দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিবর্গ নিজ নিজ অঞ্চলের জনগণের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সভা-সমিতির মাধ্যমে অবহিত হয়ে তা আইনসভায় উত্থাপন করেন এবং আলােচনা করেন। এইসব আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন সভার মাধ্যমে সেই মােতাবেক আইন প্রণয়ন করে। এইভাবে আইনসভার সদস্যবৃন্দ জনগণ ও শাসন বিভাগের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেন।


(১০) কমিটি ও কমিশন নিয়ােগ: আইনসভা অনেকসময় বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য বিভিন্ন কমিটি বা কমিশন গঠন করতে পারে। তা ছাড়া সরকারি দুর্নীতি তদন্তের জন্যও এরূপ কমিশন গঠন হতে পারে।


(১১) পররাষ্ট্র বা বিদেশ নীতি সংক্রান্ত কাজ: আইনসভা পররাষ্ট্র বা বিদেশ নীতির বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মার্কিন সিনেটের অনুমােদন ছাড়া সে দেশের রাষ্ট্রপতি কোনাে আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারেন না।


উপসংহার: পরিশেষে উল্লেখ্য যে, লর্ড ডাইসি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আইনসভার সার্বভৌমত্ব' তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে যে কথা বলেছিলেন তা আজও সমানভাবে প্রযােজ্য। তা হল সকল বিষয়ে যে-কোনাে দেশের আইনসভা শেষ কথা বলার অধিকারী। কিন্তু আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলির প্রকৃতি ও পরিধি সব দেশে ও সর্বকালে অভিন্ন নয়। এ বিষয়ে দেশ-কাল ভেদে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তা সত্ত্বেও এ কথা ঠিক যে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভার ক্ষমতা ও প্রভাব নির্ধারিত হয়।