ভারতের সংসদীয় কার্যপদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক বিস্তারিতভাবে আলােচনা করাে।

ভূমিকা : ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লোকসভা ও রাজ্যসভা এই দুটি কক্ষ নিয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠিত হয়েছে। এই সংসদের কার্যাবলি যাতে যথাযথভাবে সম্পাদিত হতে পারে তারজন্য বিভিন্ন নিয়মকানুন ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এইসকল নিয়মকানুন ও পদ্ধতিকে সংসদীয় কার্যপদ্ধতি বা Parliamentary Procedure হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একে বলা হয়, 'Rules of the game of Democracy' অন্যভাবে বলা যায়, গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের আইনগুলি একটি সংগঠনের মুষ্টিমেয় সদস্যদের দ্বারা সরকারিভাবে আরোপিত হয় ("Which is formally adopted by a group of people or by an organisation.")


সংসদীয় কার্যপদ্ধতির কয়েকটি দিক

[1] সংসদের অধিবেশন সূচনা: ভারতের রাষ্ট্রপতি সংসদের অধিবেশন আহ্বান করে থাকেন। রাষ্ট্রপতি সর্বদা সতর্ক থাকেন যে, দুটি অধিবেশনের মধ্যে ৬ মাসের ব্যবধান যেন না থাকে। যেমন রাষ্ট্রপতি ৪ মাসের মধ্যেই দুটি অধিবেশন আহ্বান করেন। যথা—গ্রীষ্মকালীন বা দল অধিবেশন এবং শীতকালীন বা বিশেষ অধিবেশন।


[2] রাষ্ট্রপতির প্রারম্ভিক ভাষণ: সাধারণ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি সংসদের উভয় কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। উক্ত যৌথ সভায় তিনি প্রারম্ভিক ভাষণ দেন। এই ভাষণকে বলা হয় রাষ্ট্রপতির ভাষণ। এ ছাড়া তিনি বাজেট অধিবেশনে ভাষণ প্রদান করে থাকেন।


[3] স্পিকার বা অধ্যক্ষ: সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় নবগঠিত লোকসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। এ ছাড়া অধ্যক্ষকে সহায়তা করার জন্য একজন ডেপুটি স্পিকারও সদস্যদের দ্বারা নিযুক্ত হয়ে থাকেন। মনে রাখা দরকার, প্রথম অধিবেশনে সভার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি স্পিকারপ্রতিম বা Protem Speaker হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি নির্বাচিত সদস্যদের এবং স্পিকার কে শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে থাকেন।


[4] ধন্যবাদজ্ঞাপন: রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর ধন্যবাদজ্ঞাপন প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। রাষ্ট্রপতি সরকারি দলের পক্ষ থেকে যে ভাষণ দেন সেই ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং সেই প্রস্তাবটি সকলের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করে। বহু বিতর্কের পর শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়।


[5] প্রশ্নোত্তর পর্ব: সাধারণত প্রশ্ন দু-রকম হতে পারে- (a) তারকাচিহ্নিত, (b) তারকাবিহীন। তারকাচিহ্নিত প্রশ্নের উত্তর মৌখিকভাবে দেওয়া হয়ে থাকে, আর তারকাবিহীন প্রশ্নের উত্তর সভার টেবিলে জমা দেওয়া হয়। সংসদের প্রতিদিনের অধিবেশনে প্রথম ঘণ্টায় প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের জবাব মন্ত্রীরা দিয়ে থাকেন।


[6] জিরো আওয়ার: বিশেষ একটি সংসদীয় কার্যপদ্ধতি রয়েছে, যাকে বলা হয় 'জিরো আওয়ার। জিরাে আওয়ারের নির্দিষ্ট কোনাে প্রকরণ বিধির বিশেষ কোনাে নির্দেশ নেই। দীর্ঘকাল ধরে অনুসৃত একটি সংসদীয় প্রথার প্রথম পর্বে বেসরকারি কর্মসূচি শেষ হয় এবং দ্বিতীয় পর্বে সরকারি কর্মসূচি শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে যখন কোনাে অবকাশ থাকে না, তখন তার নামকরণ করা হয় 'জিরো আওয়ার'। জিরাে আওয়ারে সংসদ সদস্যগণ সদ্য ঘটে যাওয়া জনস্বার্থজড়িত কোনাে বিষয় সভায় তােলেন এবং ঘটনাটি এতটাই আকস্মিক যে, পূর্বে নােটিশ না দিয়ে সভায় প্রস্তাব উত্থাপনের কোনােরকম সুযােগ থাকে না। সুতরাং স্পিকারের অনুমতি নিয়ে বিষয়টি সভায় সকলের সামনে পেশ করা হয়।


[7] অনাস্থা প্রস্তাব: ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভা কাছে যাবতীয় কাজের জন্য দায়িত্বশীল থাকেন। যতদিন সরকার লোকসভার আস্থাভাজন থাকবে, ততদিন পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকতে পারবে। কিন্তু লোকসভার আস্থা হারালেই ওই সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভার আস্থা হারিয়েছে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার কারণে লোকসভায় যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, তাকে অনাস্থা প্রস্তাব বলা হয়। অনাস্থা প্রস্তাবে পরাজিত হলে সরকার পক্ষ অর্থাৎ মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়।


[8] ছাঁটাই প্রস্তাব: লোকসভায় বাজেট পাসের সময় ব্যয় বরাদ্দের দাবি নিয়ে আলােচনায় কোনাে বিরােধী সদস্য কোনাে দপ্তরের বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার জন্য যে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, তাকে সাধারণভাবে ছাঁটাই প্রস্তাব বলা হয়। বাজেট সম্পর্কে সদস্যদের অসন্তোষ এই ছাঁটাই প্রস্তাবের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। বিরােধীদল সরকার পক্ষের অযৌক্তিক ব্যয় বরাদ্দের দাবি বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য অনেক সময় প্রতীকী ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকে।


[9] মুলতুবি প্রস্তাব: সাধারণত কোনাে বিষয় সংসদের কাজের তালিকায় উল্লেখ না থাকলে তা গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হচ্ছে মুলতুবি প্রস্তাব। যদি এমন কোনাে বিষয় অত্যন্ত জরুরি বলে বিবেচিত হয়, যার ফলস্বরূপ দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তার স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে, তাহলে মুলতুবি প্রস্তাবের মাধ্যমে স্পিকারের অনুমতির দ্বারা সভায় সেই প্রস্তাব তােলা যেতে পারে এবং স্পিকার সেই অনুমতি দিলেই সেই বিষয়টি নিয়ে সভায় পরবর্তী আলােচনা শুরু হয়।


[10] দৃষ্টি আকর্ষণী প্রস্তাব: আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাবের দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের আগে দৃষ্টি-আকর্ষণ বিজ্ঞপ্তি পেশের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। এই ধরনের প্রস্তাবে জরুরি ও জনস্বার্থ সম্পর্কিত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সদস্যরা সরকারের দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেন। দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাব যে-কোনাে সময়ে সংসদে উত্থাপন করা যেতেই পারে, তবে তা সম্পূর্ণরূপে অনুমতিসাপেক্ষ বিষয়।


মূল্যায়ন: ভারতের মতাে গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হিসেবে সংসদীয় কার্যপদ্ধতির বিষয় গুলো খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে। প্রশ্ন করা, ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করা, মুলতুবি প্রস্তাব পেশের মাধ্যমে সংসদ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। ফলে মন্ত্রীসভা নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদের আয়ত্তাধীন থাকে।