পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করাে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সীমাবদ্ধতা

ভূমিকা: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম অঙ্গরাজ্য হল পশ্চিমবঙ্গ। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা এককক্ষবিশিষ্ট, অতীতে এই রাজ্যের আইনসভা ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমানে বিধান পরিষদের বিলুপ্তি ঘটার দরুন বর্তমানে বিধানসভার একক অস্তিত্ব বজায় রয়েছে। সংবিধানের ১৭০ (১) নং ধারা অনুসারে কোনাে অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার সদস্য সংখ্যা সর্বাধিক ৫০০ জন এবং সর্বনিম্ন ৬০ জন হতে পারে। তদনুসারে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার সদস্য সংখ্যা ২৯৪ জন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের কোনাে প্রতিনিধি নির্বাচিত না হয়ে থাকলে রাজ্যপাল উক্ত সম্প্রদায় থেকে ১ জন সদস্যকে মনােনীত করতে পারেন। ফলে বর্তমানে বিধানসভার সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৫ জন।


ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্যগুলির ক্ষমতা বর্তমানে নানাবিধ কারণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এর ব্যতিক্রম নয়। বিধানসভায় আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা যথেষ্ট সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে─


(1) আইন প্রণয়নের ক্ষমতা: রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সুপারিশ ক্রমে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি-শাসন জারি করলে কিংবা বিধানসভার অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলে বা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শাসনভার নিজ হাতে নিলে বা কোনো ঊর্ধ্বতন শাসন কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত করলে, বিধানসভা ভেঙে দিলে, পার্লামেন্ট রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকারী হয়। এক্ষেত্রেও বিধানসভার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।


(2) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা: বিধানসভার অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। কারণ রাজ্যপালের সুপারিশ ছাড়া কোনাে ব্যয় বরাদ্দ বিল বিধানসভায় পেশ করা যায় না, অথচ সরকারি ব্যয় বরাদ্দের প্রস্তাব বিধানসভার অনুমোদন সাপেক্ষে বিষয়। কিন্তু রাজ্যের সঞ্চিত তহবিল থেকেই রাজ্যপাল, বিধানসভার অধ্যক্ষ, হাইকোর্টের বিচারকগণ বেতন ও ভাতা পেয়ে থাকেন, যেটা বিধানসভার অনুমােদনসাপেক্ষ নয়। এইভাবে অর্থ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে বিধানসভার ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।


(3) শাসন বিভাগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা: মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনাে কার্যকরী ভূমিকা বিধানসভা ভােগ করে না। মন্ত্রীসভাকে তত্ত্বগতভাবে বিধানসভাকে নিয়ন্ত্রণ করার যে কথা বলা হয়েছে কার্যত তার বিপরীত অবস্থাই অন্যান্য রাজ্যের ন্যায় পশ্চিমবঙ্গেও দেখা যায়। রাজ্য মন্ত্রীসভার অপ্রতিহত প্রাধান্য সবসময় পরিলক্ষিত হয়। এমনকি রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ রাজ্য বিধানসভার কার্যকালের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই বিধানসভার পরিসমাপ্তি ঘটে। সুতরাং রাজ্যে মন্ত্রিসভাই যে রাজ্য বিধানসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহই নেই— পশ্চিমবঙ্গ এর ব্যতিক্রম নয়।


(4) বিল সংক্রান্ত ক্ষমতা: বিধানসভায় গৃহীত কোনাে বিলে রাজ্যপাল স্বাক্ষর না করে কোনাে বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরণ করলে বা উক্ত বিলে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরদান না করলে উক্ত রাজ্যপাল বাতিল বলে গণ্য হয়।


(5) রাজ্য ও যুগ্ম তালিকা সংক্রান্ত ক্ষমতা: উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যদের ২/৩ অংশ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রাজ্যসভা যদি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, জাতীয় স্বার্থে রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা উচিত এই সিদ্ধান্তের ফলে রাজ্য বিধানসভার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ বা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য আইনসভা যৌথভাবে আইন প্রণয়নের অধিকারী হলেও কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে রাজ্য আইনের বিরােধ উপস্থিত হলে রাজ্য আইন বাতিল হয়ে পড়ে।


আরও কয়েকটি ক্ষেত্রেও বিধানসভার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যেমন─ (a) জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি হলে, (b) ২৯৪ নং ধারা প্রয়ােগ হলে, (c) আন্তর্জাতিক সন্ধি বা চুক্তি কার্যকর হলেও রাজ্য বিধানসভার হাতে তেমন কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। এইরূপ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভা রাজ্যতালিকায় হস্তক্ষেপ করে থাকে।


উপসংহার: উপরােক্ত নানাবিধ কারণে বিধানসভার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেও রাজ্য বিধানসভার নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা ও কার্যপরিচালনার ক্ষমতার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। তবে কেন্দ্র ও রাজ্যে যদি পরস্পরবিরােধী মতাদর্শের সরকার থাকে তাহলে কেন্দ্র-রাজ্যের দ্বৈরথ বা মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণে অনেকক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে তিক্ততার পূর্ণ পরিবেশ রচিত হয়ে থাকে এবং কেন্দ্রের এজেন্ট রাজ্যপাল যদি পদে পদে রাজ্য সরকারের কাজে অহেতুক হস্তক্ষেপ করতে থাকে তাহলেও তা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এককথায় বলা যায়, এর ফলে রাজ্যের উন্নয়নের গতি থমকে যায়।


রাজ্য বিধান পরিষদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করো।


বিধানসভার মূল কাজ | পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি


পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার পর্যালােচনা করো।