মন্ত্রীপরিষদের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে রাজ্যপালের শাসনতান্ত্রিক পদমর্যাদা আলােচনা করাে।
ভূমিকা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রীতি অনুসারে ভারতের অঙ্গরাজ্যের শাসকপ্রধান হলেন রাজ্যপাল। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। তবে রাজ্যপাল রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান। প্রকৃত শাসকপ্রধান হলেন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত মন্ত্রী পরিষদ তথা মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় সংবিধানের ১৬৩ (১) ধারা অনুযায়ী রাজ্যপালকে তার কাজকর্ম পরিচালনার ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়ার জন্য রাজ্য মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়। এই রাজ্য মন্ত্রীপরিষদে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা।
রাজ্যপালের শাসনতান্ত্রিক পদমর্যাদা
রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় রাজ্যপালের প্রকৃত অবস্থানটি কী? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী যে পরিমাণ কাজ করতে বাধ্য সেই পরিমাণে তিনি হলেন রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক শাসক। এইসকল ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা হল নামসর্বস্ব।
কিন্তু যেসকল ক্ষেত্রে তিনি স্ববিবেচনা অনুযায়ী কাজ করেন বা করতে পারেন সেইসকল ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা হল প্রকৃত শাসকের। রাজ্যপালের স্ববিবেচনা অনুযায়ী কাজ করার ক্ষেত্রে কোনাে সাংবিধানিক বাধানিষেধ নেই, এক্ষেত্রে তার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রসারিত। তাই বিরুদ্ধবাদীরা মনে করেন রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসকপ্রধান।
রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসক
যারা মনে করেন রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসক, তাঁদের যুক্তিগুলি হল নিম্নরূপㅡ
(১) সংবিধানের নির্দেশিকা অনুযায়ী রাজ্যপাল রাজ্যের শাসনকর্তা: ভারতীয় সংবিধান রাজ্যপালের হাতেই রাজ্যের শাসনক্ষমতার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। সংবিধানের নির্দেশিকা অনুসারে রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের শাসনকর্তা। সংবিধানের ১৫৪ (১) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যপাল যে শাসনক্ষমতা ভােগ করেন সেটা তিনি নিজে বা তার অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে সংবিধান সম্মতভাবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন।
(২) রাজ্যপাল মন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য নন: সংবিধানের ১৬৩ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে। এই মন্ত্রীপরিষদ রাজ্যপাল কে তার কার্যসম্পাদনে সাহায্য ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে রাজ্যপাল মন্ত্রী-সহ মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ ও সাহায্য নাও গ্রহণ করতে পারেন।
(৩) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ: রাজ্যপাল তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে স্ববিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগের জন্য রাজ্যপাল মন্ত্রিসভার সঙ্গে কোনাে পরামর্শ করতে হয় না। সংবিধানের ১৬৩ (২) নং ধারানুসারে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে, সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রাজ্যপাল। সংবিধানে রাজ্যপালের কতকগুলি সুনির্দিষ্ট স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার উল্লেখ আছে। যেমন— মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ােগ, অপসারণ, বিধানসভা ভেঙে দেওয়া, রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করা, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য বিল প্রেরণ ইত্যাদি।
(৪) রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ: রাজ্যের রাজ্যপাল কে নিয়ােগ করেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ১৫৬ (১) নং ধারানুসারে রাজ্যপালের কার্যকাল অনেকাংশেই নির্ভর করে রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর। অনেকসময় দেখা যায়, রাষ্ট্রপতির ইচ্ছার উপরই রাজ্যপালের বদলি বা পদচ্যুতি ঘটে থাকে। রাজ্যপাল কে চাকরির শর্তের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতি ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অনুগত থাকতে হয়।
(৫) রাজ্যপাল ও মন্ত্রী পরিষদের যােগসূত্র: রাজ্যের মন্ত্রী পরিষদের শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত প্রস্তাব সমূহ রাজ্যপাল কে জানাতে হয়। এই দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রীর (১৬৭ [A] নং ধারা)। আবার রাজ্যপাল নিজে কিছু জানতে চাইলে তাও মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে হয় (১৬৭ [B]নং ধারা)। সাধারণত মুখ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রীপরিষদের সঙ্গে রাজ্যপালের সংযােগ সাধিত হয়। তবে প্রয়ােজনবােধে কোনাে বিষয়ে তিনি মন্ত্রীদের মন্ত্রী পরিষদের কোনো তথ্য পেশ করতে বলতে পারেন, আবার প্রয়ােজনবােধে মন্ত্রীদের কাছে কোনাে নির্দেশও পাঠাতে পারেন।
(৬) মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের নিয়োগ: সংবিধানের ১৬৪ (১) নং ধারা অনুসারে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। বিধানসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলের প্রধান বা জোটের প্রধানকেই রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেন এবং তার পরামর্শ অনুসারে তিনি মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নিয়ােগ করে থাকে।
(৭) মন্ত্রীসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করা: রাজ্যপাল রাজ্যের বিধানসভার আস্থাভাজন মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত বা ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন। রাজ্যপাল প্রথমে রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেন। রাজ্যপালের এই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি করে থাকেন (৩৫৬ নং ধারা)। এই রিপাের্ট পেশ করার ক্ষেত্রে রাজ্যপাল মন্ত্রীসভার সঙ্গে পরামর্শ করেন না।
(৮) রাজ্য বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত রাখা: অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল একটি বিশেষ ক্ষমতা ভােগ করে থাকেন। সেই বিশেষ ক্ষমতাটি হল বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করা। যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের অনুরােধ করা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণের জন্য বিধানসভার অধিবেশন আহ্বানে রাজি না হন তাহলে সেক্ষেত্রে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার জোরে বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করে থাকেন। এ ছাড়া রাজ্যপাল মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে রাজ্য আইনসভার অধিবেশন স্থগিত রাখতে এবং প্রয়ােজনে বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন। এখানেই রাজ্যপালের প্রকৃত শাসকের পরিচয় পাওয়া যায়।
রাজ্যপাল হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসক
রাজ্যের প্রকৃত শাসক হল রাজ্য মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট, মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে রাজ্যপাল কে তাঁর ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে হয়। রাজ্যপাল যে নিয়মতান্ত্রিক শাসক তার যুক্তিগুলি নিম্নে তালিকাবদ্ধ করা হল—
(১) মন্ত্রীপরিষদ প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী: সংবিধানের ১৬৪ (২) নং ধারানুসারে, রাজ্যের শাসন ব্যবস্থার প্রত্যেক ক্ষেত্রে মন্ত্রীপরিষদকে বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এক্ষেত্রে রাজ্যপাল কোনােরূপ দায়িত্ব পালন করেন না। রাজ্যপাল শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এই কারণেই রাজ্যের শাসনকার্যের জন্য মন্ত্রিসভার প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী বলে চিহ্নিত করা হয়।
(২) জনগণের প্রতিনিধি: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনপ্রতিনিধির হাতে প্রকৃত শাসনক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। সুতরাং রাজ্যে আলংকারিক-প্রধান হলেন রাজ্যপাল এবং প্রকৃত প্রধান হলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রীপরিষদ যতক্ষণ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা লাভ করতে পারবেন, ততক্ষণ রাজ্যে মন্ত্রীপরিষদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে। রাজ্যপালের সন্তুষ্টির উপর মন্ত্রীপরিষদের অস্তিত্ব নির্ভর করে না।
(৩) মনোনীত পদাধিকারী: পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা অর্পিত থাকে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালকে মনােনীত করেন বলেই মনােনয়নের ব্যাপারে জনগণের নির্বাচনের সঙ্গে রাজ্যপালের কোনাে সম্পর্ক থাকে না, ফলে রাজ্যপালের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে না। এই কারণেই সংবিধান-প্রণেতারা রাজ্যপালের পদটিকে রাজ্যের নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধানের পদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
(৪) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা খুশিমতাে প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়: রাজ্যপাল খুশিমতাে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না। ভারতের নতুন সংবিধানে উল্লেখ করা আছে যে, রাজ্যপাল তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বা নিজস্ব বিচারবিবেচনা অনুযায়ী কাজ করার ক্ষমতা পরিহার করে মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে পারবেন। মূলত মন্ত্রীসভাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে থাকে বলেই রাজ্যপাল কে নিয়মতান্ত্রিক শাসকের ভূমিকা পালন করতে হয়।
(৫) রাজ্যপালের নির্বাচিত মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করা অগণতান্ত্রিক: মন্ত্রী পরিষদ যেহেতু যৌথভাবে বিধানসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন তাই মন্ত্রীপরিষদকে বাতিল করার ক্ষমতা রাজ্যপালের থাকলেও, সেটা তার নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা বলে গণ্য হবে।
(৬) প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ গ্রহণ করে: সংবিধানের ১৬৭ (১) নং ধারানুযায়ী মন্ত্রীপরিষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল কে অবহিত করার দায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী পালন করে থাকেন। এ ছাড়া রাজ্যপাল নিজে কিছু জানতে চাইলেও তাও তাকে জানানাে মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য [ ১৬৭ (২) ধারা ]। এর থেকে বােঝা যায় যে, রাজ্যের আইন ও শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্যের মন্ত্রীসভা বা মন্ত্রীপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে, রাজ্যপাল এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম নন।
(৭) মন্ত্রীদের নিযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে রাজ্যপালের ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক: সংবিধানের ১৬৪ (১) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যান্য মন্ত্রীদের নিযুক্ত করেন, কিন্তু তার এই ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক কারণ রাজ্যের মন্ত্রীসভা বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে বলেই রাজ্যপাল নিয়মতান্ত্রিক শাসক বলে বিবেচিত হন।
মূল্যায়ন: উপরোক্ত আলােচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার যে, রাজ্য রাজনীতিতে মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ বিশাল ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজ্যপাল রাজ্য প্রশাসনে শুধুমাত্র নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের ভূমিকা গ্রহণ করলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রাধান্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হয়। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে সাধারণত রাজ্যপাল নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়। কিংবা রাজ্যে কোনাে দল যদি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, সেক্ষেত্রে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করেন। এইসময় রাজ্যপাল কেন্দ্রের প্রতিনিধি (Agent) হিসেবে কাজ করেন এবং স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের রাজ্যপাল রমেশ ভাণ্ডারি সেখানকার কল্যাণ সিং-এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে বরখাস্ত করেছিলেন। তবে সংসদীয় গণতন্ত্রে এ ঘটনা অভিপ্রেত নয়।