রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বর্ণনা করাে।

অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা

ভারতীয় সংবিধানের ১৬৩ (১) নং ধারায় অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার উল্লেখ আছে। রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার পরিধি ব্যাপক। রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকা উচিত কি অনুচিত এ নিয়ে বিতর্ক আছে।


তথাপি সংবিধানে ১৬৩ (২) নং ধারায় বলা হয়েছে যে-কোনাে একটি বিষয় রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত অথবা অন্তর্ভুক্ত নয় এ ধরনের কোনাে প্রশ্ন দেখা দিলে সে ব্যাপারে রাজ্যপালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। এক্ষেত্রে রাজ্যপালের সম্পাদিত কার্যাবলি স্বেচ্ছাধীন এলাকার অন্তর্ভুক্ত অথবা অন্তর্ভুক্ত নয়, এই যুক্তিতে কোনাে প্রশ্ন তোলা যায় না। সাধারণভাবে এমন কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ গ্রহণ করা রাজ্যপালের কাছে বাধ্যতামূলক নয়। সেইসকল ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিজের বিবেচনা অনুসারে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন। রাজ্যপাল যেসকল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভােগ করেন বা প্রয়ােগ করেন সেগুলি নিম্নে আলােচনা করা হলㅡ


(১) অসমের উপজাতি অঞ্চলের প্রশাসন পরিচালনা: ৩৭১ (ক)নং ধারা অনুযায়ী অসমের উপজাতি অঞ্চলে প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভােগ করেন। অসম সরকার কর্তৃক জেলাপরিষদকে প্রদেয় খনিজ লাইসেন্স-এর রয়্যালটি সংক্রান্ত নিষ্পত্তির ব্যাপারে রাজ্যপাল স্ববিবেচনামতাে সেই বিরােধের মীমাংসা করে থাকেন।


(২) পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসক: রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ২৩৯ (২) নং ধারানুসারে মন্ত্রীসভার পরামর্শ ছাড়াই কোনাে রাজ্যের রাজ্যপাল কে পার্শ্ববর্তী কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এক্ষেত্রেও রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীনভাবে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারেন মন্ত্রীসভার সহযােগিতা ও পরামর্শ ছাড়াই।


(৩) নাগাল্যান্ডের আঞ্চলিক পরিষদ গঠন: নাগাল্যান্ড বিদ্রোহী নাগাদের কার্যকলাপ যতদিন চলবে ততদিন ওই রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগাল্যান্ডের রাজ্যপালের বিশেষ দায়িত্ব থাকবে। সংবিধানের ৩৭১ (ক) নং ধারানুযায়ী নাগাল্যান্ডের তিয়েনসান জেলার আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের ব্যাপারে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন।


(৪) মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলের কমিটির তত্ত্বাবধান: মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে নির্বাচিত বিধানসভার সদস্যদের নিয়ে রাষ্ট্রপতি পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করতে পারেন। এই কমিটির কাজকর্ম তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালের উপর ন্যস্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রেও রাজ্যপাল স্ববিবেচনামতাে কাজ করে থাকেন [৩৭১ (গ) ধারা ]।


(৫) গুজরাট ও মহারাষ্ট্র রাজ্যের আঞ্চলিক উন্নয়ন: রাষ্ট্রপতি গুজরাট ও মহারাষ্ট্র রাজ্য দুটির আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য দুটির রাজ্যপালকে বিশেষ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন [৩৭১(২) ধারা ]। এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন।


(৬) মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ: রাজ্যপাল নিজের বিবেচনা অনুযায়ী তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সি রাজাগোপালাচারী নিযুক্ত হন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যপাল ধরমবীর কর্তৃক পশ্চিমবঙ্গে ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ মুখ্যমন্ত্রী রূপে নিয়ােগ হল রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগের নিদর্শন।


(৭) মুখ্যমন্ত্রীদের বরখাস্ত: রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে মুখ্যমন্ত্রীদের বরখাস্ত করতে পারেন। যেমন অতীতে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপাল রামলাল এন টি রামা রাও কে এবং সিকিমের রাজ্যপাল তলােয়ার খান নরবাহাদুরকে বরখাস্ত করেছিলেন।


(৮) রাষ্ট্রপতির কাছে পাক্ষিক প্রতিবেদন পেশ: রাজ্য প্রশাসন সম্পর্কে রাজ্যপাল যে পাক্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন, তা তিনি নিজের বিবেচনা অনুসারে প্রেরণ করে থাকেন।


(৯) রাষ্ট্রপতির কাছে বিল প্রেরণ: রাজ্য আইনসভায় গৃহীত কোনাে বিলকে রাষ্ট্রপতির অনুমােদনের জন্য রাজ্যপাল সংরক্ষণ করতে পারেন (২০১ নং ধারা)।


(১০) রাজ্যে জরুরি অবস্থার সুপারিশ: কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভিন্ন মতাদর্শের কারণে রাজ্যপাল রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারির সুপারিশ করেন। এই সুপারিশ জারি করার বহু প্রমাণ আছে। যেমন— ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে কেরলে এই জরুরি অবস্থা জারির সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে বহু রাজ্যে জরুরি অবস্থা ঘােষণার সুপারিশ করা হয়েছে।


(১১) বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা: রাজ্যপাল নিজের বিবেচনা অনুসারে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে রাজ্য বিধানসভা ভেঙে দিতে পারেন। যেমন— ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচিত সরকারের আইনসভা তৎকালীন রাজ্যপাল ভেঙে দিয়েছিলেন।


(১২) রাজ্য বিলে ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ: রাজ্যপাল নিজে ইচ্ছা করলে যে-কোনাে রাজ্য বিলে ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন বা পুনর্বিবেচনার জন্য রাজ্য বিলকে ফেরত পাঠাতে পারেন।


(১৩) উপাচার্য নিয়ােগ: অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল রাজ্যের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। তিনি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ােগ করে থাকেন। যেমন— পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল এ পি শর্মা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়ােগে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছিলেন।


(১৪) বিধানসভায় ভাষণ দান: রাজ্যপাল স্বেচ্ছায় বিধানসভায় ভাষণ দেন। তিনি ইচ্ছা করলে পূর্ণাঙ্গ ভাষণ নাও দিতে পারেন। যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ধরমবীর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ পাঠ করেননি।


রাজ্যপালের বিশেষাধিকার


রাজ্যপালের বিশেষ অধিকারগুলি হল রাজ্যপাল তাঁর সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য আদালতের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। রাজ্যপালের কার্যকালের মেয়েদের মধ্যে তার বিরুদ্ধে কোনাে ধরনের ফৌজদারি মামলা করা যায় না। আদালত কোনাে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করতে পারে না। ব্যক্তিগত বিষয়ে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা রুজু করতে হলে ২ মাস আগে নােটিশ দিতে হয়। এ ছাড়াও মনে রাখা দরকার, রাজ্যপাল দ্বারা সম্পাদিত কার্যাবলি স্বেচ্ছাধীন এলাকার অন্তর্ভুক্ত অথবা অন্তর্ভুক্ত নয় এই যুক্তিতেও কোনাে প্রশ্ন তােলা যায় না।


উপসংহার: রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা সংবিধানের কোনাে একটি নির্দিষ্ট পরিধিতে আবদ্ধ রাখেনি। তার প্রমাণ আমরা সংবিধানের ১৬৩ (২) নং ধারাতে দেখতে পাই। যার দ্বারা রাজ্য প্রশাসনে রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। তবে অনেকে মনে করেন, আইনসভা কর্তৃক গৃহীত বিলে সম্মতিপ্রদান, রাষ্ট্রপতিকে রিপাের্ট পাঠান, উপজাতি অধ্যুষিত এলাকাসমূহের শাসন পরিচালনা, রাজ্য বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান বা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যপাল গণ কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছাপূরণ করেছেন, যা তাদের নিয়মতান্ত্রিক শাসকের মর্যাদাহানি করেছে। তবে এইসমস্ত ক্ষেত্র ছাড়া রাজ্যপাল অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমনভাবে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে  পারেন না। তাই বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক দেশে কোনাে পদাধিকারীর ক্ষমতাই সীমাহীন, অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ হওয়া উচিত নয়।