সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকা বলতে কী বােঝাে? ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা বিষয়ে একটি টীকা লেখো।

পরামর্শদান এলাকার সংজ্ঞা: ভারতের সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ১৪৩(১) নং ধারানুসারে রাষ্ট্রপতিকে বিভিন্ন বিষয়ে আইনগত পরামর্শ দেওয়ার জন্য যে ভূমিকা পালন করে, তাকে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শদান সংক্রান্ত ক্ষমতা বলে অভিহিত করা হয়।


সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকা

(1) রাষ্ট্রপতি আইন সংক্রান্ত যে-কোনাে প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের অভিমত নিতে পারেন অথবা জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ কোনাে বিষয়ের উপর সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতির অনুরােধ পেয়ে সুপ্রিমকোর্ট এই বিষয়ে প্রয়ােজনীয় অনুসন্ধান করে মতামত জানাতে পারে। যদিও রাষ্ট্রপতি এই পরামর্শ গ্রহণ অথবা বর্জনও করতে পারেন। এই সংক্রান্ত প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দিল্লি আইন মামলায় (১৯৫১)।


(2) সংবিধান চালু হওয়ার পূর্বে সম্পাদিত সন্ধি, চুক্তি, অঙ্গীকার পত্র বা সনদ প্রভৃতির মধ্যে যেগুলি সংবিধান চালু হওয়ার পরেও কার্যকর রয়েছে, সেসব বিষয়ে কোনাে বিরােধ দেখা দিলে সংবিধানের ১৪৩ (২) নং ধারানুসারে রাষ্ট্রপতি সে সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চেয়ে পাঠাতে পারেন। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট পরামর্শদান করতে বাধ্য থাকে, তবে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের সেই পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য নন।


যদিও অতীতে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করেছেন, যেমন— ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কেরল শিক্ষাবিল, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বেরুবাড়ি সমস্যা, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গুজরাট বিধানসভার বিগঠিত অবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জম্মু ও কাশ্মীর পুনর্বাসন বিল প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। এইভাবে রাষ্ট্রপতি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পনেরােটি বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চেয়ে পাঠান।


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতের সুপ্রিমকোর্টের থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্ট এবং অস্ট্রেলিয়ার হাইকোর্ট অধিকতর শক্তিশালী বলে বিবেচিত হলেও, তাদের উপর পরামর্শদানের কোনাে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়নি। সেদিক থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকার ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।


সমালােচনা :


(1) জগমােহন রেড্ডি প্রমুখ সমালােচকদের মতানুসারে, সংবিধান কর্তৃক সরকারের আইনগত পরামর্শদাতার ভূমিকা ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বহন করে চলেছে। জগমােহন রেড্ডি পরিহাস করে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকার ভূমিকাকে আরও প্রসারিত করা হলে সাধারণ নাগরিকদেরও পরামর্শদাতার ভূমিকা সুপ্রিমকোর্টই গ্রহণ করে থাকবে।


(2) অনেক সমালােচকের মতে, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শদান এলাকা ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মামলার স্বার্থকে ক্ষুন্ন করতে পারে।


পরিশেষে বলা যায় যে, সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট অনেকাংশেই সরকারের আইনগত পরামর্শদাতায় পরিণত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের এখন অন্যতম দায়িত্ব হল সরকারকে প্রয়াজনীয় সকল বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা অর্থাৎ সরকার যেসকল বিষয়ে পরামর্শের প্রয়ােজন বােধ করে সেই সমস্ত বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট পরামর্শ প্রদান করে থাকে।


ভারতীয় সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা


সামাজিক প্রগতিমূলক ভূমিকা পালনে সুপ্রিম কোর্টের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। অনেক ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্ট গণতন্ত্রের প্রহরী পে অনেক গণতান্ত্রিক আইন কে বাতিল বলে ঘােষণা করেছে। এ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট সামাজিক সংস্কারসাধনের ক্ষেত্রেও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- সুপ্রিমকোর্ট ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরােধী অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা আইন (Maintenance of Internal Security Act) ১৭(ক) ধারাটিকে বাতিল করে দিয়ে ঘােষণা করে যে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা আইনের ১৭(ক) ধারাটি সংবিধানের ২২(৭) ধারার বিরােধী। সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা তিন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়, যথা―


(1) জনকল্যাণমূলক নির্দেশ প্রদান: জনসাধারণের কল্যাণের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ বা অধস্তন আদালতে বহু ও বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে থাকে। যেমন ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষজনিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এক মানবিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।


(2) সামাজিক কল্যাণমূলক নির্দেশ প্রদান: সামাজিক সংস্কার ও কল্যাণসাধনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শাহবানু মামলা (১৯৮৫ খ্রি.) এবং সুবানু মামলায় (১৯৮৭ খ্রি.) প্রদত্ত প্রগতিশীল রায়ের কথা বলা যায়। সুপ্রিম কোর্ট এই সমস্ত রায়ের মাধ্যমে পীড়নকারী স্বামীর অন্যায়-অবিচারের হাত থেকে মুসলমান মহিলাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছে এবং তাদের ভরণপােষণের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।


(3) সরকারকে নির্দেশ প্রদান: সুপ্রিমকোর্ট ভারত সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। যেমন- ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার এবং হরিয়ানা সরকার দুটি বিষয়ে দৃষ্টান্তমূলক নির্দেশ প্রদান করে থাকে। বেগার শ্রমিকদের মুক্তি প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার ও হরিয়ানা সরকারকে নির্দেশ দেয়।


উপরােক্ত তিনটি দিক বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, সামাজিক প্রগতিতে সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।