ভারতের সুপ্রিমকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে।

সুপ্রিম কোর্টের গঠন

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যা কত হবে তা নির্ধারণের ভার সংবিধান কর্তৃক পার্লামেন্টের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। মূল সংবিধানের ১২৪ নং ধারা অনুসারে পার্লামেন্ট আইন করে যতদিন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে ততদিন পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং অনধিক ৭ জন বিচারপতি নিয়ে গঠিত হয়। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে মােট বিচার পতি র সংখ্যা বাড়িয়ে ২৬ জন করেছে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আইন অনুসারে ১ জন প্রধান বিচারপতি এবং সর্বাধিক ৩০ জন অন্যান্য বিচারপতি-সহ মােট ৩১ জন বিচারপতি নিয়ে বর্তমানে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট গঠনের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া一


বিচারপতিদের নিয়ােগ পদ্ধতি: সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়ােগ করেন। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন বিচারপতিদের নিয়ােগের পূর্বে সুপ্রিমকোর্ট বা হাইকোর্টের বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার, তাহলে তিনি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন। প্রধান বিচারপতি ব্যতীত অন্যান্য বিচারপতি নিয়ােগের পূর্বে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করা বাধ্যতামূলক। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে যে পরামর্শ দেন সেই পরামর্শ অনুযায়ীই বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন।


বিচারপতিদের যােগ্যতা: সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতে হলে একজন ব্যক্তিকে প্রথমত, ভারতীয় নাগরিক হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, কমপক্ষে ৫ বছর কোনাে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা অথবা ১০ বছর অ্যাডভােকেট হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং তিনি রাষ্ট্রপতির মতে বিশিষ্ট আইনজ্ঞ হবেন।


বিচারপতিদের কার্যকাল ও পদচ্যুতি: সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত পদে আসীন থাকতে পারেন। বিচারপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন অথবা সংসদের প্রস্তাব অনুসারে রাষ্ট্রপতি তাকে ইমপিচমেন্ট পদ্ধতির সাহায্যে পদচ্যুত করে থাকেন। অসদাচরণ অথবা উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ সংক্রান্ত কোনাে প্রস্তাব পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে উপস্থিত হলে এবং ভােটদানকারী সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের ও প্রত্যেক কক্ষের মােট সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সমর্থিত হলে প্রস্তাবটি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়। রাষ্ট্রপতি ওই প্রস্তাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে পদচ্যুত করে থাকেন। অবসর গ্রহণের পর কোনাে বিচারপতি ভারতের কোনাে আদালতে ওকালতি করতে পারেন না। বিচারপতিগণের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্যই সংবিধানে এই ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছে।


বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা: পার্লামেন্ট-প্রণীত (২০০৯ খ্রি.) আইন অনুসারে বিচারপতিগণের বেতন ও ভাতা সংবিধানের দ্বিতীয় তপশিলে নির্দিষ্ট করা আছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মাসিক ২,৮০,০০০ টাকা ও অন্যান্য বিচারপতিরা ২,৫০,০০০ টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। বিচারপতিদের বেতন ও ভাতা ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া বিচারপতিরা অন্যান্য ভাতা ও সুযোগ সুবিধা ভােগ করে থাকেন।


সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি


ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট দ্বৈত ভূমিকা (Dual role) পালন করে থাকে তাই সুপ্রিমকোর্টকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হয়। সুপ্রিমকোর্টের কর্মক্ষেত্রের মূলত চারটি এলাকা রয়েছে। এই এলাকাগুলির মধ্য দিয়েই সুপ্রিমকোর্ট তার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করে থাকে। এই এলাকাগুলি হল যথাক্রমে一

  • (1) মূল এলাকা (Original Jurisdiction),
  • (2) আপিল এলাকা (appellate Jurisdiction),
  • (3) পরামর্শদান এলাকা (Advisory Jurisdiction),
  • (4) আদেশ, নির্দেশ ও লেখ জারি এলাকা


(1) মূল এলাকা (Original Jurisdiction): ভারতীয় সংবিধানের ১৩১ নং ধারা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মূল এলাকা যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত বিরােধের মীমাংসা হয়ে থাকে। কোনো বিরােধের সঙ্গে যদি এমন প্রশ্ন জড়িত থাকে যার উপর বৈধ অধিকারের অস্তিত্ব ও প্রসার নির্ভর করে এবং সেই বিরােধের-

  • এক পক্ষ যদি ভারত সরকার হয় তাহলে অপরপক্ষ হবে এক বা একাধিক রাজ্য সরকার,
  • অথবা এক পক্ষ যদি হয় ভারত সরকার এবং এক বা একাধিক রাজ্য সরকার তাহলে অন্য পক্ষও হয় একাধিক রাজ্য সরকার,
  • আবার উভয় পক্ষই যদি রাজ্য সরকার হয় তাহলে সেই বিরােধের মীমাংসা সুপ্রিম কোর্টের মূল এলাকায় হয়ে থাকে।


সংবিধানের ৭১(১) নং ধারায় উল্লেখ আছে, সুপ্রিমকোর্টের মূল এলাকা রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনােরকম বিরােধ সৃষ্টি হলে তার মীমাংসা করতে পারে। এই কারণে সুপ্রিম কোর্টের মূল এলাকা অনন্য এলাকা (exclusive Jurisdiction) বলেও অভিহিত করা হয়। তবে সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পূর্বে সম্পাদিত কোনাে চুক্তি, সনদ, সন্ধি প্রভৃতি যা সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পরও চালু রয়েছে তার থেকে কোনােরূপ বিরােধের উৎপত্তি ঘটলে সেই বিরােধের মীমাংসা সুপ্রিম কোর্টের মূল এলাকায় নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয় না।


(2) আপিল এলাকা (Appellate Jurisdiction): ভারতের যে-কোনাে রাজ্যের হাইকোর্টের রায় বা ডিক্রির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যায়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল এলাকা চার ভাগে ভাগ করা যায় - (a) সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল, (b) দেওয়ানি আপিল, (c) ফৌজদারি আপিল, (d) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল।

  • (a) সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত আপিল: সংবিধানের ১৩২ (১) নং ধারা অনুসারে দেওয়ানি, ফৌজদারি কিংবা অন্য যেকোনো মামলার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাইকোর্ট যদি এই মর্মে একটি সার্টিফিকেট দেয় যে উক্ত মামলার সঙ্গে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রয়েছে, তাহলে সেই মামলা বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আবেদন করা যায়।
  • (b) দেওয়ানি আপিল: সংবিধানের ১৩৩ (১) নং ধারায় উল্লেখ আছে। যে, কোনো দেওয়ানি মামলায় হাইকোর্টের রায় বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়। যদি হাইকোর্ট এই মর্মে প্রমাণপত্র দেয় যে, সংশ্লিষ্ট মামলাটির সঙ্গে আইনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রয়েছে তাহলে সেই মামলার বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।
  • (c) ফৌজদারি আপিল: ফৌজদারি মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যেতে পারে। সেই বিষয়গুলি হল- (1) যদি হাইকোর্ট কোনাে অভিযুক্ত ব্যক্তির যুক্তির আদেশ বাতিল করে, তাকে মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করে, (2) নিম্ন আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত কোনাে ব্যক্তিকে হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে, (3) যদি কোনাে মামলা সুপ্রিম কোর্টে আপিল যোগ্য এই মর্মে হাইকোর্ট নিজে থেকে কোনো সার্টিফিকেট প্রদান করলে [১৩৪(২) নং ধারা]।
  • (d) বিশেষ অনুমতি সূত্রে আপিল: সংবিধানের ১৩৬ (১) নং ধারা অনুসারে যে-কোনাে আদালত বা ট্রাইবিউনালের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিশেষ অনুমতি (Special Leave) সুপ্রিমকোর্ট নিজেই প্রদান করতে পারে।


(3) পরামর্শদান এলাকা (Advisory Jurisdiction): সংবিধানের ১৪৩ (১) নং ধারায় উল্লেখ করা রয়েছে যে, সর্বজনীন গুরুত্ব রয়েছে এমন কোনাে আইন বা তথ্য সংক্রান্ত প্রশ্ন রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন। সুপ্রিমকোর্টের অভিমত অনুযায়ী সরকার কাজ করতে বাধ্য থাকে না। সংবিধানের ১৪৩ (২) নং ধারানুযায়ী, সংবিধান চালু হওয়ার আগে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তি, অঙ্গীকারপত্র যা আজ পর্যন্তও বলবৎ রয়েছে, সে বিষয়ে কোনাে বিরােধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে আইনগত পরামর্শ চাইতে পারেন।


(4) আদেশ, নির্দেশ ও লেখ জারির এলাকা: সুপ্রিমকোর্ট ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত এবং তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লিখিত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে চিহ্নিত। তাই ৩২ নং ধারানুসারে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি ক্ষুন্ন হলে তার প্রতিকার সুপ্রিম কোর্ট করে থাকে। এই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়ােজনমতাে― (a) বন্দি-প্রত্যক্ষীকরণ (Hebeas Corpus), (b) পরমাদেশ (Mandamus), (c) প্রতিষেধ (Prohibition), (d) উৎপ্রেষণ (Certiorari), (e) অধিকার পৃচ্ছা (Quo Warranto) প্রভৃতি চরিত্রের লেখ জারি করে থাকে। তবে জরুরি অবস্থা বলবৎকালীন অবস্থায় এইরূপ পদক্ষেপ সুপ্রিম কোর্ট নাও গ্রহণ করতে পারে।


উপরোক্ত সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলিগুলির গুরুদায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্যান্য যেসব দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্ট পালন করে থাকে। সেগুলি হল―

  • (a) ১২৯ নং ধারা অনুযায়ী অভিলেখ আদালত (Court of Records) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা,
  • (b) সুপ্রিম কোর্ট নিজের অবমাননার জন্য অবমাননাকারীকে শাস্তি প্রদান (১৪২ (২) নং ধারা],
  • (c) নিজের দেওয়া রায় বা সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করা প্রভৃতি।


উপসংহার: ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনার শেষে এর ক্ষমতার পরিধি সহজেই অনুমেয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ আল্লাদি কৃত স্বামী আয়ারের ভাষায় বলা যায় যে, কাজের পরিধি ও ক্ষমতার বৈচিত্র্যের দিক থেকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান এক ও অদ্বিতীয় (একমেবাদ্বিতীয়ম)।