আদি-মধ্যযুগের ভারতে ভাস্কর্য ও চিত্রকলা

আদি-মধ্যযুগের ভাস্কর্য:

স্থাপত্যের মতোই আদি-মধ্যযুগে ভারতীয় ভাস্কর্যের মূল কেন্দ্র ছিল মন্দিরে সৃষ্ট অসংখ্য দেবদেবী ও তাদের অনুচরদের মূর্তি। মন্দির ধ্বংস হবার সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য নিদর্শনের মতো বহু ভাস্কর্য নিদর্শনও হারিয়ে গেছে। অবশ্য ক্ষীয়মান অবস্থাতে হলেও, যে অসংখ্য ভাস্কর্যকর্ম এখনও টিকে আছে, তা থেকে সমকালের ভাস্কর্যশৈলী সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব। গুপ্ত রাজবংশের শাসনকালে ভারতীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বিপুল চর্চা হয়েছিল। এই সময়ের সৃষ্টিতে ধ্রুপদী ঐতিহ্য (Classical Tradition) অনুসারে ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলিতে ‘ত্রিমাত্রিক' (Trio-dimentional) বৈশিষ্ট্য আরোপিত হয়েছিল। কিন্তু আদি-মধ্যযুগে সেই ধ্রুপদী ধারণার প্রভাব কমতে থাকে। সপ্তম শতকের পরবর্তী চার শতকে ভারতের বৃহত্তর অংশের ভাস্কর্যকর্মে ‘দ্বিমাত্রিক' গুণ আরোপিত হয়। এই সময়ের ভাস্কর্য আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। অবশ্য গুজরাট, রাজপুতানা, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারত বা মধ্য ভারতে দশম শতক পর্যন্ত ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যসৃষ্টির প্রবণতা অব্যাহত ছিল। আবার আদি-মধ্যযুগের ভারতে শিল্পকলাচর্চার প্রাণকেন্দ্র দক্ষিণ ভারত এবং পূর্ব ভারতে পালরাজাদের ভাস্কর্যে প্রাচীন ধ্রুপদী শৈলীর প্রকাশ প্রায় এবং এটি একাদশ শতক পর্যন্ত যথেষ্ট জোরালো ছিল। আদি-মধ্যযুগের ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু মূলত ধর্মকেন্দ্রিক। আরও নির্দিষ্টভাবে বলা যায়, দেবদেবীর মূর্তিনির্ভর। তবে ধর্মনিরপেক্ষ ভাস্কর্য একেবারে অনুপস্থিত ছিল—এমন নয়। মন্দিরের দেওয়াল অলংকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পৌরাণিক ঘটনা যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি মানব মানবীর মূর্তি, দৈনন্দিন জীবনের দৃশ্য, পশুপাখি, লতাগুল্ম ইত্যাদির অলংকরণও ভাস্করদের আকৃষ্ট করেছে।


ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বাংলার ভাস্কর্যে কোনো বিশেষ প্রণালী ও নতুন পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায় না। তাঁর মতে, সপ্তম শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলার ভাস্কর্যে গুপ্তযুগের সংযম ও গাম্ভীর্যের সাথে কমনীয়তা ও আবেগপ্রবণতার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায়। সপ্তম শতকের শেষভাগে নির্মিত দেবখঙ্গের রানি প্রভাবতীর লিপিযুক্ত 'শার্বাণী' ও একটি ক্ষুদ্র 'সূর্যমূর্তি’র ভাস্কর্যশৈলী বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন যে, এগুলিতে গুপ্তযুগের ধ্রুপদী ঐতিহ্য, সংযম, গাম্ভীর্যের পাশাপাশি পরবর্তী দ্বিমাত্রিক ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্যগুলির সমাবেশ ঘটেছে। অর্থাৎ সপ্তম শতকের ভাস্কর্যে গুপ্ত-ভাস্কর্যের অবসন্ন রূপ ধরা পড়ে। অষ্টম শতকে বাঙালি ভাস্কররা সেই অবসাদমুক্ত হয়ে বাংলার ভাস্কর্যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সংযোজন করতে সক্ষম হন। পাহাড়পুরের মন্দিরে উৎকীর্ণ তেষট্টিটি প্রস্তর ও পোড়ামাটির ফলকে আদি-মধ্যযুগে বাংলার নিজস্ব ভাস্কর্যশৈলীর প্রথম প্রকাশ দেখা যায়। ফলকগুলিতে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার চরিত্রে বিভিন্নতা স্পষ্ট। বৈশিষ্ট্যগত প্রভেদের ভিত্তিতে পাহাড়পুরের ভাস্কর্যগুলিকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়, যথা—লোকায়ত ভাস্কর্য, অভিজাত ভাস্কর্য এবং সমন্বিত ভাস্কর্য। এই ফলকগুলিতে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যের শিল্পরীতি স্বতন্ত্র। কয়েকটিতে পূর্বাঞ্চলীয় গুপ্ত ভাস্কর্যশৈলীর সার্বিক প্রভাব বিদ্যমান। কতকগুলিতে বাংলার স্বতন্ত্র ধারার প্রকাশ ঘটেছে, আবার কতকগুলি মূর্তির পরিকল্পনায় উপরোক্ত দুটি প্রবণতার সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। এই তিন শ্রেণির ভাস্কর্যে শিল্পশৈলীর বিভিন্নতার পাশাপাশি এদের নির্মাণের উপকরণের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। অধ্যাপক সরসী কুমার সরস্বতীর মতে, এই তিন ধারা ভাস্কর্য শিল্প যথাক্রমে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শতকে নির্মিত হয়েছিল। প্রথম ধারার মূর্তিগুলিতে গুপ্ত আমলের ভাস্কর্যশৈলীর প্রভাব স্পষ্ট। দ্বিতীয় ধারাতে গুপ্ত-প্রভাব অনেকটা প্রচ্ছন্ন। এবং তৃতীয় শ্রেণির মূর্তির পরিকল্পনা ও প্রকাশ এক স্বতন্ত্র স্থানীয় বৈশিষ্ট্য দ্বারা শ্রীমণ্ডিত।


কয়েকটি প্রস্তর ফলক ও পোড়ামাটির ফলকে প্রথম শ্রেণির ভাস্কর্যের প্রকাশ দেখা যায়। বাঙালির জনপ্রিয় মহাকাব্যের কাহিনি ও অবতারের লীলা এই সকল ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, কর্মময় জীবনধারা ইত্যাদি বিষয়কে ভিত্তি করেও এই শ্রেণির বহু ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছে। জলভরা কলশি বহনরতা রমণী, লাঙল কাঁধে কৃষক, তৈজসপত্র বহনকারী শীর্ণকায় কুব্জদেহ সন্ন্যাসী, পূজাপাঠরত পুরোহিত, তির-ধনুক হস্তে শবর পুরুষ কিংবা মৃত পশু হাতে শবর রমণী—এমন অসংখ্য পরিচিত দৃশ্যাবলি ভাস্করদের সৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে ফলকের গায়ে। এই সকল ভাস্কর্যের উপস্থাপনা খুবই নিম্নমানের। মানব-মানবীর মূর্তির গঠন খুবই সাদামাটা, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কুৎসিতও। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও পোশাক-পরিচ্ছদ অতি সাধারণ ও নিম্নমানের। শিল্পীর সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ এই শ্রেণির ভাস্কর্যে অনুপস্থিত। ড. মজুমদারের মতে, সম্ভবত এই শ্রেণির ভাস্কররা সমাজের নিম্নশ্রেণি থেকে এসেছিলেন এবং তাঁদের বিশেষ শিক্ষাও ছিল না। তবে সাধারণ মানের হলেও এঁদের পর্যবেক্ষণ শক্তির গভীরতা অস্বীকার করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত ছবিগুলি তাঁরা যেভাবে ভাস্কর্যে তুলে ধরে, তা তাঁদের সমাজ-সচেতনতার পরিচয় দেয়। পাহাড়পুরের পাথরের ফলকে খোদিত উচ্চ শ্রেণির মূর্তিগুলিকে দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে ফেলা যায়। এগুলি প্রধানত কৃষ্ণ, বলরাম, রাধা ইত্যাদি দেবদেবীর মূর্তিকে ভিত্তি করে খোদিত হয়েছে। এখানে পুরুষ ও নারীর একটি প্রণয়-চিত্রকে রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়লীলা মনে করা হয়। কিন্তু মহাভারত বা পুরাণ গ্রন্থে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই শিল্প সমালোচকদের অনুমান—এই চিত্রে কৃষ্ণের পাশে দণ্ডায়মান নারী ছিলেন রুক্মিণী অথবা সত্যভামা। এই পর্বের ভাস্করদের সমাজচেতনা ও সৌন্দর্যানুভূতি ছিল উচ্চমানের। এঁদের প্রেরণা ছিল গুপ্তযুগের ধ্রুপদী শিল্পশৈলী। এখানে মূর্তিগুলির মুখশ্রী, শরীরের গঠন-সৌষ্ঠব, পরিধেয় বসনের আভিজাত্য ভাস্করদের সৌন্দর্য-চেতনা ও গভীর মননশীলতার পরিচয় বহন করে। মূর্তিগুলিতে পার্থিব ও অপার্থিব ভাবের অপরূপ সমন্বয় দেখা যায়। সংস্কৃত কাব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে পুরুষমূর্তির পৌরুষ কিংবা নারীমূর্তির লাস্যময়ীতা অতিরঞ্জিত হয়েছে। তবে অধ্যাত্মভাব-কল্পনার সাথে মানবিক ইন্দ্রিয়পরায়ণতার যে সমন্বয় ঘটানো হয়েছে, তা ভাস্করদের গভীর শিল্পদক্ষতার পরিচায়ক। পাহাড়পুরের কিছু ভাস্কর্যে প্রথম শ্রেণির গ্রাম্যভাব ও দ্বিতীয় শ্রেণির আভিজাত্যের সহাবস্থান দেখা যায়। কৃষ্ণের বাল্যলীলা, দিপালের মূর্তি, ইন্দ্রের মূর্তি ইত্যাদিতে এই সমাবেশ দেখা যায়। এগুলিকে তৃতীয় শ্রেণির নিদর্শন বলা যায়। গুপ্ত পরবর্তী ও অষ্টম শতকের অন্তর্বর্তীকালে এই সকল ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছিল। তাই গুপ্ত শিল্পধারার প্রভাব অস্বীকার করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য শিল্পধারার প্রকাশ ঘটানোর প্রয়াস এই সকল ভাস্কর্যে লক্ষ্য করা যায়।


নবম থেকে দ্বাদশ শতকে গুপ্ত ভাস্কর্যশৈলীর প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র বাংলাদেশী ভাস্কর্যশৈলী বিকাশলাভ করে। কেবল পাল রাজবংশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা নয়; পূর্ব ভারতের বর্ম, চন্দ্র ইত্যাদি ছোটো ছোটো আঞ্চলিক রাজ্যগুলিতেও পালরাজ্যের শিল্পধারার বিকাশ ঘটেছিল। এই পর্বের ভাস্কর্যের বিষয়বস্তু ছিল দেবদেবীর মূর্তি। সাধারণ মানুষের পার্থিব জীবনের কোনো ছবি এখানে পাওয়া যায় না। ভাস্কর্যের প্রধান উপকরণ ছিল অষ্টধাতু ও কৃষ্ণবর্ণ কষ্টি পাথর। সোনা রূপা ইত্যাদি ধাতুর ব্যবহার ছিল খুবই নগণ্য। পালযুগের ভাস্কর্যশৈলীতে নানা বিবর্তন ঘটেছে। ড. মজুমদারের মতে, সে যুগের প্রাপ্ত মূর্তিগুলির সংখ্যাল্পতার ফলে বিবর্তনের ধারা সম্পর্কে গভীর ব্যাখ্যা কষ্টকর। অনেক সময় শিল্পীর ব্যক্তিগত শিল্পবোধ, আবার অনেক সময় পারিপার্শ্বিকতা শিল্পশৈলীর বিবর্তনে সক্রিয় থাকে। কিন্তু অধিকাংশ মূর্তিতে নির্মাণকার্য উল্লেখ না থাকায় সময়কালের নিরিখে বিবর্তনের ধারা ব্যাখ্যা করা যায় না। তিব্বতি ঐতিহাসিক তারানাথ সপ্তম শতকে পূর্ব ভারতের শিল্প ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তিনি দেবপাল ও ধর্মপালের সময় বরেন্দ্রভূমির দুজন শিল্পীর নাম উল্লেখ করেছেন— ধীমান ও বীতপাল। সম্পর্কে এঁরা পিতা ও পুত্র। তারানাথের মতে, বীতপাল ধাতু খোদাই-এর ক্ষেত্রে প্রাচ্যরীতি অনুসরণ করেন, কিন্তু ধীমান অনুসরণ করেছিলেন মধ্য দেশীয় রীতি। এঁরা চিত্রাঙ্কনেও পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে পিতা-পুত্র ঠিক বিপরীত শৈলীর অনুসারী ছিলেন। পরবর্তীকালে খননকার্য থেকে পাল সেন যুগের আরও ভাস্কর্য-নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলি বিশ্লেষণ করে ড. সরসী কুমার সরস্বতী বলেছেন যে, এ যুগের ভাস্কর্যরীতিবে বিভক্ত করা সঠিক হবে না। নবম শতকের পরবর্তী ভাস্কর্যকে সাধারণভাবে প্রাচ্যরীতির অনুসারী বলা যায়। কোনো কোনো সমালোচক মূর্তিগুলির অবয়বগত ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে বিবর্তনের ধারা নির্দিষ্ট করেছেন। এঁদের মতে, নবম শতকের মূর্তি ছিল শান্ত সৌম্য, কমনীয়। দশম শতকে দেহগুলি ছিল বলিষ্ঠ ও শক্তিব্যঞ্জক। কিন্তু একাদশ শতকে মুখমণ্ডলে ছিল অপার্থিব ভাবের প্রকাশ। দেহের ঊর্ধ্বভাগ ছিল নমনীয় ও কোমল। মুখমণ্ডল ছিল ভাবলেশ হীন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল আড়ষ্ট। কিন্তু ড. মজুমদার মনে করেন, এই ধরনের কাল-বৈশিষ্ট্যের বিভাজন যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তাঁর মতে, পালযুগের শ্রেষ্ঠ মূর্তিগুলিতে গুপ্তযুগের আধ্যাত্মিক ভাব এবং পালযুগের সৌন্দর্য ও লাবণ্যের সমন্বয় দেখা যায়। শিয়ালদি, বাখাউরা, সাগরদিঘি, রংপুর, বগুড়া, দেওপা, বানগড় ইত্যাদি স্থানের বুদ্ধমূর্তি, ঝিল্লির (মুর্শিদাবাদ) বরাহ অবতার, শংকর বাঁধার নটরাজ মূর্তি, উত্তরবঙ্গের কার্তিক মূর্তি ইত্যাদিতে আধ্যাত্মিকতা ও সৌন্দর্যের সমন্বয় দেখা যায়।


দক্ষিণ ভারতে ভাস্কর্য শিল্পের সূচনা পল্লবযুগেই (ষষ্ঠ-নবম শতক) হয়েছিল। প্রথম মহেন্দ্রবর্মন ও তাঁর পুত্র নরসিংহবর্মনের গুহামন্দির ও রথমন্দিরগুলি সুন্দর ভাস্কর্য দ্বারা শ্রীমণ্ডিত করা হয়েছিল। উন্মুক্ত আকাশের নীচে পাহাড় খোদাই করে ‘কিরাতাজুনীয়' মহাকাব্যের কাহিনির উপস্থাপনা পল্লব ভাস্কর্যের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। প্রথমদিকের পল্লর ভাস্কর্যে এবং শেষদিকের বেঙ্গী ভাস্কর্যের প্রভাব দেখা যায়। অধ্যাপক সরস্বতী মনে করেন, পল্লব ভাস্কররা কালক্রমে বেঙ্গীর প্রভাবমুক্ত হয়ে দ্রাবিড় ভাস্কর্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন। বেঙ্গীর ভাস্কর্যের ইন্দ্রিয়পরায়ণতা থেকে মুক্ত হয়ে পল্লব শিল্পীরা শান্ত, সংযত ও আধ্যাত্মিকতা দ্বারা উদ্ভাসিত মূর্তি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আদি-মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যের দৃপ্ত প্রকাশ ঘটে চোলরাজ্যে। চোলযুগে পাথর ও ধাতুর সাহায্যে অসংখ্য অবিস্মরণীয় ভাস্কর্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তর খোদিত চোল-ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখা যায় মন্দিরের গায়ে, বিস্তৃত হল ঘরে, গো পুরমগুলিতে। শ্রীনিবাসনপ্লুরে কোরঙ্গনাথ মন্দিরের দেওয়ালে এবং কুম্বকোনয়ে নাগেশ্বর মন্দিরে নরনারীর প্রতিকৃতি খোদিত আছে। জীবন ও সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ হিসেবে এই ভাস্কর্যগুলি অনবদ্য। তাঞ্জোরে বৃহদীশ্বর ও গোঙ্গইকোও চোলপুরম মন্দিরের অভ্যন্তর ও বহির্ভাগ অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি দ্বারা শোভিত। এসবই চোলযুগে উন্নত প্রস্তর-ভাস্কর্যের সাক্ষ্য বহন করে। চোল আমলের ভাস্কর্যের অবিস্মরণীয় নিদর্শন হল ব্রোঞ্জ-ধাতু নির্মিত মূর্তিগুলি। এ. এল. ব্যাসামের মতে, সমগ্র বিশ্বে এদের তুলনা মেলা কঠিন। বস্তুত, ভারতে ধাতু শিল্পের উন্নততর রূপটি চোলদের আমলেই বিকশিত হয়। তাঞ্জোর লিপিতে অসংখ্য ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের নামোল্লেখ আছে। শৈবধর্ম ও দেবতাকেন্দ্রিক এই সকল নিদর্শন অধিকাংশই বিনষ্ট হয়ে গেছে। দক্ষিণ ভারতের মন্দির ও নানা দেশের জাদুঘরে রক্ষিত চোলযুগের নিদর্শগুলি থেকে সেকালের ধাতুনির্মিত ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা যায়। পূর্ণগর্ভ ও শূন্যগর্ভ উভয় ধরনের ব্রোঞ্জ মূর্তি তৈরি হত। বড়ো বড়ো মূর্তিগুলি ধর্মীয় শোভাযাত্রায় বহন করা হত কিংবা নানা অনুষ্ঠানে প্রদর্শন করা হত। ছোটো ছোটো মূর্তিগুলি ব্যবহার করা হত অলংকরণের কাজে। ধাতুমূর্তির অধিকাংশই ছিল দেবদেবীর মূর্তি। শিবের নানা রূপ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, লক্ষ্মী, ভূদেবী, রাম-সীতা, কিছু শৈবসাধকের মূর্তি চোল ভাস্কর্যের নিদর্শন হিসেবে এখনো দেখা যায়। চোল মূর্তিগুলির অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুপাত একান্তভাবে শিল্পসম্মত। নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, ঐতিহ্যের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেও চোলযুগের ভাস্কর্যগুলি রুচিবোধ, দেহসৌষ্ঠব, জাঁকজমক ইত্যাদির অতুলনীয় প্রতীক হিসেবে বন্দিত হবে। ধাতু নির্মিত মূর্তিগুলির মধ্যে 'নটরাজ' মূর্তিটি সবচেয়ে বড়ো এবং সর্বাধিক সুন্দর। নৃত্যের দেবতা ‘নটরাজ’ তাঁর অনবদ্য নৃত্যভঙ্গিমার মাধ্যমে বিশ্বজগতের আধ্যাত্মিক রহস্যসৃষ্টি স্থিতি-লয়’ কে প্রস্ফুটিত করেছেন। জীবন ও মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই অচঞ্চলতার প্রকাশ করে হিন্দু দর্শনের গভীর তত্ত্ব এই ভাস্কর্যে শিল্পী প্রকাশ করেছেন। কুমার স্বামীর মতে, নটরাজ মূর্তিতে শিল্পীরা পরিবর্তন ও অস্থিরতার মধ্যে অন্তর্নিহিত চিরন্তন শান্তি ও স্থৈর্যকে প্রকাশ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। ড. নীহাররঞ্জন রায় এই মূর্তিকে সারনাথের বিশ্বখ্যাত বুদ্ধমূর্তির সমতুল্য বলে অভিহিত করেছেন।


আদি-মধ্যযুগের চিত্রকলা :

ভারতে চিত্রাঙ্কন শিল্পের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। তবে স্থাপত্য-ভাস্কর্যের মতো চিত্রকলারও বিষয়বস্তু ছিল ধর্ম এবং মন্দির বা বিহার ইত্যাদি ছিল চিত্রচর্চার ক্ষেত্র। স্বভাবতই স্থাপত্যকর্মগুলি ধ্বংস হওয়ার কারণে চিত্রকলার নিদর্শনগুলিও অধিকাংশ বিনষ্ট হয়ে গেছে। প্রাচীন তাম্রলিপ্তি (তমলুক) নগরে যে চিত্রশিল্প জনপ্রিয় ছিল, ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে তা জানা যায়। ড. মজুমদার মনে করেন যে, পরবর্তীকালের শিল্পশাস্ত্রের অনুশাসনের ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায় যে, প্রাচীন ও বৌদ্ধবিহারের প্রাচীরগাত্র চিত্র দ্বারা সুসজ্জিত করা হত। এ ছাড়া তান্ত্রিক বৌদ্ধ গ্রন্থাদি থেকে কিছু চিত্রের নমুনা পাওয়া যায়। একাদশ-দ্বাদশ শতকের বৌদ্ধ পুঁথিতে বজ্রযান, তন্ত্রযান মতের দেবদেবীর কিছু ছবি পাওয়া যায়। পাল আমলের শেষদিকে রচিত ‘অষ্টসাহস্রিকা' এবং 'পঞ্চবিংশতি সাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা' পুঁথিতে সমকালীন বাংলার চিত্রবিদ্যা সম্পর্কে কিছু আলোচনা পাওয়া যায়। রেখাবিন্যাস ও বর্ণসমাবেশ এই দুটি ছিল প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য। অজন্তা, ইলোরার গুহাচিত্রে এই দুটি বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ দেখা যায়। বাংলার চিত্রশিল্পীরাও এই দুটি বৈশিষ্ট্যকে তাঁদের চিত্রকর্মে রূপদান করেছেন। ‘প্রজ্ঞাপারমিতা' পুঁথিতে যে চিত্র দেখা যায়, তাতে সূক্ষ্মরেখা ও বর্ণের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। ড. মজুমদারের মতে, বাংলার চিত্রশিল্পের নমুনা মুষ্টিমেয়; কিন্তু এটি যে স্বর্ণমুষ্টি তাতে সন্দেহ নাই। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতেও মূলত ধর্মভিত্তিক চিত্রকলাচর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়। পল্লবরাজ রাজসিংহের রাজত্বকালে পনমলই ও কাঞ্চিপুরম মন্দিরে অলংকরণের কাজে চিত্রকল্পের ব্যবহার দেখা যায়। কাঞ্চির কৈলাসনাথ মন্দিরের দেওয়ালে প্লাস্টারে সোমস্কন্দ অর্থাৎ শিব, উমা ও স্কন্দের ছবি চিত্রিত হয়েছে। চোল আমলেও শৈব চিত্রকলার দক্ষতা দেখা যায়। বিজয়ালয় চোলেশ্বর মন্দিরগাত্রে মহাকাল ও নটরাজশিবের মূর্তি চিত্রিত আছে। বৃহদেশ্বরী মন্দিরের গায়ে অঙ্কিত হয়েছে নটরাজ, ত্রিপুরান্তক ও কৈলাসবাসী মহেশ্বরের চিত্র। চালুক্য-পরবর্তীকালে গুজরাট অঞ্চলে চিত্রকলার চর্চা ছিল। ক্লাসিকাল ধ্যানধারণার সাথে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে রাজস্থান রীতির উদ্ভব ঘটেছিল। পরবর্তীকালে পরমার ও চৌহান শাসকদের আমলে চিত্রকলার বৈচিত্র্য বিঘ্নিত হয়।