স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক

স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক


সাম্য স্বাধীনতার বিরোধী একটি মত: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী উদারনীতিক চিন্তাবিদগণ সামাজিক ও আর্থনীতিক সাম্য এবং স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধিতার কথা বলেন। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা কেবল স্বাধীনতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। লর্ড অ্যাকটন, টক্‌ভিল, হার্বার্ট স্পেনসার, বেজহট, লেকি প্রমুখ চিন্তাবিদ সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণাকে পরস্পরবিরোধী বলে মত প্রকাশ করেছেন। অ্যাটনের মতানুসারে, 'সাম্য অর্জনের আগ্রহ স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থ করে। তাঁর কথায়: “The passion for equality makes vain the hope for freedom. "


সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর-বিরোধী নয়: 'সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ পরস্পর-বিরোধী’–এ হল স্বাধীনতা ও সাম্য সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা বলতে যদি ব্যক্তির খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করার অনিয়ন্ত্রিত ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে বোঝায় তা হলে সাম্যের সঙ্গে এই স্বাধীনতার বিরোধ স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বাধীনতার সঠিক ধারণা নয়; এ হল উচ্ছৃঙ্খলতা বা স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের অত্যুগ্র বাসনার জন্য এই শ্রেণীর চিন্তানায়কগণ সাম্যের আদর্শকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্যে সাম্য ও স্বাধীনতার ভিতর পারস্পরিক পরিপুরক সম্পর্কের কথা নিহিত আছে। উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারাও সাম্য ও স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধিতাকে অস্বীকার করেছেন।


সাম্য প্রকৃত স্বাধীনতার ভিত্তি: রুশো, মেইটল্যান্ড, ল্যাস্কি, বার্কার, টনি প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ও মার্কসবাদি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক ধারণা। উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক অতি নিবিড়। সাম্যের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব। রুশো বলেছেন: “Liberty cannot exist without equality." স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সাম্যের পরিবেশ প্রয়োজন। আইনের দৃষ্টিতে সমানাধিকার স্বীকৃত হলে এবং অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য বিলুপ্ত হলে নাগরিকদের সামাজিক, রাজনীতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা যথাযথভাবে ভোগ করা সম্ভব হয়। সমাজে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা থাকলে স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, অর্থ প্রতিপত্তি ভেদাভেদে সমাজজীবনে বৈষম্যমূলক আচরণ স্বাধীনতার অস্তিত্বকে বিপর্যস্ত করে। শ্রেণীবৈষম্য বা ধনবৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত স্বাধীনতার সৃষ্টি ও ভোগ অসম্ভব। আর্থনীতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চোরাবালির উপর স্বাধীনতার সৌধ নির্মাণ করা যায় না। সাম্য ও সমানাধিকারের ভিত্তিতেই প্রকৃত স্বাধীনতা উপলব্ধি করা যায়।


সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক: 'সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা অভিন্ন বললে অত্যুক্তি হয় না। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে স্বাধীনতা বলতে এক বিশেষ পরিবেশকে বোঝায়, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ বিকাশ সাধন করতে পারে। সাম্য বলতেও প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবেশকে বোঝায়, যেখানে মানুষ তার ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ পায়। সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়েরই উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক মানুষের আত্মোপলব্ধিতে সহায়তা করা। সমাজব্যবস্থায় এমন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হবে যাতে প্রত্যেকে স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের ভিত্তিতে আপন আপন ব্যক্তিসত্তার বিকাশ সাধন করতে সক্ষম হবে। সুতরাং সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক; পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত (“Liberty...implies equality; liberty and equality are not in conflict nor even separate, but are different facers of the same ideal.”—H. A. Deane) টনির মতানুসারে 'সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, স্বাধীনতার স্বার্থে একান্ত প্রয়োজন।' তাঁর কথায় “...a large measure of equality, so far from being inimical to liberty is essential to it." মানবতার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ যদি স্বাধীনতা হয়, তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া এই স্বাধীনতা অসম্ভব। টনির অভিমত হল: “If liberty means the power of expansion in human spirit, it is rarely present save in a society of equals.” বাস্তবে এবং প্রকৃতিগত বিচারে উভয় ধারণাই আইনগত। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে। আবার রাষ্ট্র স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে সমাজের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ সাধন করে।


মার্কসীয় মতবাদে আর্থনীতিক সাম্যকে স্বাধীনতার পূর্ব শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এই তত্ত্ব অনুসারে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পিক্‌স (D. M. Pickles) বলেছেন: “The Marxist thesis denies the possibility of liberty in the absence of the conditions of economic equality which alone make it possible…"


স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্কে ল্যাস্কির ধারণা:

স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে ল্যাস্কি ও বার্কারের অভিমত বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics এবং Liberty in the Modern State শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। অ্যাক্‌টন বা টকভিলের মতো তিনি স্বাধীনতা ও সাম্যকে পরস্পর-বিরোধী বলেননি। তিনি স্বাধীনতা ও সাম্যের সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে সকলের জীবনকে সৃজনশীল করে তোলা দরকার। এই সৃজনশীলতাকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে উপযুক্ত উপায় ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। একে সম্ভব করে তোলার জন্য সাধারণ মানুষের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করতে হবে যে, তাদের সকলের ভূমিকাই হল গুরুত্বপূর্ণ। এবং স্বাধীনতা ও সাম্যের সহাবস্থানমূলক প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে এই অবস্থার সৃষ্টি অসম্ভব। ল্যাস্কির আরও অভিমত হল যে প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বের বিকাশকে সুনিশ্চিত করার জন্য অসাম্যের অবসান আবশ্যক। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বকে সৃজনশীল করে তুলতে হবে। তারজন্য দরকার একটি সহায়ক পরিবেশের। স্বাধীনতা ও সাম্যের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে এই পরিবেশের সৃষ্টি হতে পারে না। স্বাধীনতা ও সাম্যের ভিত্তিতে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় সেখানে সকলের সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব বিকশিত ও কার্যকর হয়। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিবেশ হিসাবে যে স্বাধীনতার কথা বলা হয়, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ব্যতিরেকে তার সৃষ্টি হতে পারে না। আবার স্বাধীনতার অনুশীলন ও উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন হল এক শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশের। এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য না থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায় না।


আর্থনীতিক সাম্যের উপর গুরুত্ব আরোপ: ল্যাস্কির মতানুসারে সাম্য না থাকলে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। ল্যাস্কি এ বিষয়ে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্যের উপর জোর দিয়েছেন। ধনবণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব রাজনীতিক ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে। যাদের হাতে আর্থনীতিক ক্ষমতা থাকে, রাজনীতিক ক্ষমতাও তাদের হাতেই থাকে। ধনসম্পদের অধিকার থেকে যারা বঞ্চিত সমাজে তাদের অবহেলিত অবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। বস্তুত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। ল্যাস্কি বলেছেন: “...I am urging that great inequalities of wealth make impossible the attainment of freedom." আবার রাজনীতিক ক্ষেত্রেও সাম্যের অনুপস্থিতি স্বাধীনতার অনস্তিত্ব সূচিত করে। যাইহোক স্বাধীনতার উপলব্ধি ও অনুশীলন বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। তবে সুষম ধনবণ্টন এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিবেচিত হয়।


স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্কে বার্কারের ধারণা:

বার্কার ও তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সাম্য, কোন বিচ্ছিন্ন নীতি বা আদর্শ নয়। স্বাধীনতা ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতির পাশাপাশি সাম্যের অবস্থান। এই দু’য়ের সঙ্গে এবং বিশেষত স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যের সামঞ্জস্য বিধান আবশ্যক। কারণ সাম্য ও স্বাধীনতা উভয়ই হল গুরুত্বপূর্ণ। বার্কার বলেছেন: “...equality is not an isolated principle. It stands by the side of the principle of liberty and the principle of fraternity. It has to be reconciled with both, and, in particular, with the principle of liberty. Both liberty and equality matter, ” তবে বার্কারের মতে স্বাধীনতা হল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বাধীনতা ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ মূল্যের সঙ্গে অধিকতর গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তা ছাড়া ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত সামর্থ্যের স্বতস্ফূর্ত বিকাশের সঙ্গেও স্বাধীনতা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বার্কার স্বাধীনতাকে মহত্তর বলেছেন। এর কারণ হিসাবে বলেছেন যে স্বাধীনতার সঙ্গে সাম্যও এসে পড়ে। তাঁর মতে স্বাধীনতা দাবী করে গেলেই সাম্যও নাগালের মধ্যে এসে যায়। স্বাধীন মানুষ হল স্বাধীন এবং এই কারণেই স্বাধীনতার প্রকৃতি অনুযায়ী তারা পরস্পরের সমকক্ষ ও সঙ্গী। তা ছাড়া আর একটি কারণে স্বাধীনতা মহত্তর। তা হল, স্বাধীনতার কারণে মানুষ এমন বিষয়ে একত্রিত হয়, সকলেই যার অধিকারী হতে পারে। বার্কার বলেছেন: “It is greater because it entails the other; because we may say of it, 'Seek ye liberty, and equality shall be added unto you'; because, in a word, free man, by the mere fact of being free, are also peers and equals in the essential and cardinal attribute of liberty."


বার্কারের অভিমত অনুসারে যোগ্যতার মুক্তি সাধনই হল মানুষের প্রধান লক্ষ্য। এবং এর জন্য সুযোগের ক্ষেত্রে সাম্য থাকা দরকার। মানুষের প্রধান ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হল যোগ্যতা বা সামর্থ্যের অভিব্যক্তি বা প্রকাশ (Liberation)। সকল সামর্থ্যের স্বাধীন বিকাশের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য হল সুযোগ-সুবিধার সমতা। বার্কার বলেছেন: “There must indeed be equality of opportunity before all capacity can be free to develop; but the major and ultimate aim is liberation of capacity." তাঁর মতে মর্যাদা ও বিষয়-সম্পত্তির ক্ষেত্রে অধিকতর সাম্য অভিপ্রেত। তিনি আর্থনীতিক আদর্শকেও প্রধানত মুক্তি সাধনের আদর্শ হিসাবেই প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর মতানুসারে এক্ষেত্রেও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের সাফল্যের আগে মর্যাদা ও সম্পদের ক্ষেত্রে অধিকতর সাম্যের প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। বার্কার বলেছেন: "...the economic ideal is essentially an ideal liberation; and...there has to be achieved some greater measure of equality, both in status and in possession, before the battle of liberty can be won....." তবে এক্ষেত্রেও প্রধান ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হল অবাধ অংশীদার হিসাবে কর্ম সম্পাদনের উদ্দেশ্যে সকলের মুক্তি সাধন। সেখানে মজুরি ও কাজের নিয়মকানুন নির্ধারণের ক্ষেত্রে সকলের বক্তব্য গুরুত্ব পাবে। সেখানে সকলে সাধারণ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পাবে। এই আইন অনুযায়ী সকলে কাজ করবে।