'ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলীর স্কাইলার্ক (Skylark) এর মধ্যে পার্থক্য | শেলীর কবিতায় মুক্তি-চেতনা আলোচনা করো।

শেলীর কবিতায় মুক্তি-চেতনা আলোচনা করো।


রোমান্টিক যুগের (১৭৮০-১৮৩০) অন্য স্তম্ভ কবি শেলী ছিলেন প্রকৃত অর্থে বিদ্রোহী কবি। স্বাভাবিক ভাবেই রোমান্টিক কল্পনার বিকাশ তাঁর মধ্যে দেখা গেলেও অন্যান্য কবিদের মতো তিনি প্রধানত প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিভোর বিমুগ্ধ হয়ে কাব্যরচনা করেননি, তিনি দেখেছেন মানুষের মনুষ্যত্বের উদ্বোধন। পুরোনো ধ্বংসস্তূপের ওপর তিনি নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে, মানবপ্রেমী না হলে কেউ বিদ্রোহী হতে পারে না। মানুষের মুক্তিচেতনা তাই ধ্বনিত হয়েছে তার কবিতায় বারংবার। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নির্যাতিত মানবের অন্তরাত্মা যখনই মুক্তির জন্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তখনই শেলী তার সমর্থনে কলম ধরেছেন। তাঁর 'প্রমিথিউস আনবাউন্ড' (Prometheus Unbound), 'রিভোল্ট অফ ইসলাম' (Revolt of Islam), 'দ্য মাস্ক অফ এনার্কি' (The Mask of Anarchy), দ্য উইচ অফ এটলাস' (The Witch of Atlas) প্রভৃতি রচনায় তাঁর বিদ্রোহাত্মক মন ও মানবের মুক্তিচেতনা উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-দেশ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ স্বাধীনভাবে সুখে জীবনযাপন করুক। মুক্তির খোলা হাওয়ায় ও অবারিত আলোকে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করুক। হিংসাজর্জর, অত্যাচারপূর্ণ, শোষিত মানুষদের মুক্তির আশায় আশাবাদী শেলী তাই 'ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইন্ড' (Ode to the West Wind) কবিতায় ব্যস্ত করেছেন তাঁর একান্ত আশা If winter comes, can spring be far behind— শীত যখন এসেছে তখন বসন্ত তার পশ্চাতেই আছে 'মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে।



শেলীর কাব্যছন্দ বিষয়ে দু-চার কথা ব্যক্ত করো।

ইংরেজি সাহিত্যে পাশি বিশি শেলী (Percy Bysshe Shelley) একটি উল্লেখযোগ্য নাম। রোমান্টিক যুগের তিনি একটি অন্যতম স্তম্ভ। তাঁর কবিতায় সৌন্দর্যচেতনা, বিদ্রোহ-ভঙ্গি, মুক্তিচেতনা যেমন ধ্বনিত হয়েছে,‌ তেমনি চমৎকার ছন্দদোলায় দোলায়িত হয়েছে অঙ্গ কাব্যিক মূর্ছনায়। রোমান্টিক কবিদের মধ্যে একমাত্র তিনিই গদ্যস্বভাব যুক্ত মুক্তবদ্ধ ছন্দে মৌলিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। মুক্তির চেতনায় তাঁর অন্তর নিষিক্ত ছিল বলেই বোধহয়, মুক্তবদ্ধ ছন্দের গীতিপ্রবণতাকে তিনি মুক্তি দিতে পেরেছিলেন। তাঁর অধিকাংশ কবিতাই জাত‌ হয়েছে কোনো না কোনো আবেগময় প্রেরণা থেকে তাই ছন্দের মধ্যেও রয়েছে সেই আবেগময় স্বভাব। মানুষের নাড়ী (Pulse beat) যেমন আবেগ নির্ভর হয়ে আন্দোলিত হয়, শেলীর কবিতার ছন্দও অনেকটা সেই স্বভাবযুক্ত। ইংরেজি ছন্দের, একটি কঠিন ছন্দ 'তেরজা রাইমা' (Terza Rima) তিনি চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেছেন 'ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড' (Ode to the West Wind) কবিতায়। এই ছন্দের বৈশিষ্ট্য হল আয়াম্বিক এর পঞ্চপার্বিক চলন বিন্যাস। দুটি ঝোঁকহীন ও একটি ঝোঁক নিয়ে গঠিত একটি আয়াম্বিক পর্ব। সেই রকম পাঁচটি পর্বের সুষম বিন্যাসে বিন্যস্ত এই চলন ইংরেজি সাহিত্যে একটি বিরল দৃষ্টান্ত।



শেলীর 'প্রমিথিউস আনবাউণ্ড' (Prometheus Unbound)-এর মৌলিকতা আলোচনা করো।

ফরাসী বিপ্লবের প্রেরণায় ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় শেলীর এক অনবদ্য কাব্যনাট্য প্রমিথিউস আনবাউণ্ড'। এখানে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাটির সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এই কাব্যনাট্য তিনি রচনা করেছিলেন ইস্কাইলাসের ‘প্রমিথিউস বাউণ্ড’-এর নবরূপায়ণে। গ্রীক কাহিনীতে আছে মানবদরদী 'প্রমিথিউস, মানুষের কল্যাণের জন্যে স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন। এবং মানুষকে বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা দান করেছিলেন। এর ফলে ক্রুদ্ধ জীয়ুস ককেশাস পর্বতে তাঁকে বন্দী করে রাখেন সেখানে এক ঈগল প্রতিরাত্রে তাঁর মাংস ঠুকরে খেত। নাটকের পরিণতিতে অত্যাচারী জীয়ুসের পদানত মানবতার প্রতিমূর্তি প্রমিথিউসের আপোসে মিলন হয়। অর্থাৎ সমস্ত অত্যাচারকে স্বীকার করে পদানত হয়েই থাকতে হয় প্রমিথিউসকে।


পক্ষান্তরে শেলী প্রমিথিউসকে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানবাত্মার প্রতীক এবং জীউসকে হিংসা ও অত্যাচারের প্রতিমূর্তি রূপে চিত্রিত করার পর, মানবতার কাছে অত্যাচারীকে পরাভূত করেছেন। প্রমিথিউসের পুত্র হারকিউলিস ককেশাস পর্বতের সেই ভয়ানক ঈগলকে হত্যা করেন। মানবাত্মার বিজয় ঘোষিত হয়। প্রমিথিউসের মুক্তির মধ্যে দিয়ে দ্যোতিত হয় বিশ্বের অত্যাচারিত, নিপীড়িতের মুক্তির বাসনা। এখানেই শেলীর মৌলিকতা।



শেলীর 'অ্যাডোনেইস' (Adonais) রচনার কারণ কী? কীটসের সঙ্গে অ্যাডোনেইস-এর মিল কোথায়?

কবি কীটস্ (John Keats )-এর মৃত্যু উপলক্ষে শেলী তাঁর শোকগাথা 'অ্যাডোনেইস' (Adonais) রচনা করেন। কীটস ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮২১-এ রোমে মারা যান, আর শেলী সম্ভবত ৮ জুন ১৮২১-এ এই শোকগাথাটি লেখা শেষ করেন।


‘অ্যাডোনেইস্’ শোকগাথায় শেলীর সুতীব্র বেদনামথিত আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। এই শোক তাঁর কীটসের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচিতির জন্য নয়। এই শোক অন্তত একটি রচনার জন্যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী এক কবির মৃত্যুর কারণে, অপর এক কবির শোক।


‘অ্যাডোনাইসে'র অ্যাডোনিস (Adonis) সুন্দর তরুণ। তাকে ভালোবাসে আফ্রোদিতে (Aphrodite)। শিকার করার সময় বরাহের আক্রমণে অ্যাডোনিসের মৃত্যু হয়। তার রক্তধারা থেকে ফুলের সুগন্ধ পরাগ নির্গত হতে থাকে। তার মৃত্যুতে আফ্রোদিতে শোকাভিভূত হলে, দেবতা অ্যাডোনিসকে বাঁচায় এবং আফ্রোদিত্যের সঙ্গে ছ'মাস থাকতে দেয়।


অ্যাডোনিসের সঙ্গে কীটসের মিল এই যে, উভয়েই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। উভয়েরই মৃত্যু হয় শ্বাপদ নখরাঘাতে—অ্যাডোনিস মারা যায় বন্য বরাহের আক্রমণে তাকে প্রতীকী হিসেবে ধরলে কীটসের যক্ষ্মা রোগের ক্ষয়িষ্ণুতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। উভয়েই মৃত্যুর পর অমরত্ব লাভ করেছেন। অ্যাডোনিসের nature cult আর কীটসের অমর আত্মা যুগে যুগে যেন নবসৃজ্যমান।



'ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলীর স্কাইলার্ক (Skylark) এর মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করো।

এই রোমান্টিক কালসীমায় দুই কবি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও শেলীর অবস্থান হলেও ভিন্ন মানসিকতার জন্য ওয়ার্ডওয়ার্থের টু দ্য স্কাইলার্ক' (To the Skylark) এবং শেলীর টু এ স্কাইলার্ক (To a Skylark) কবিতা দুটি দুই ভিন্ন অনুভব সৃষ্টি করেছে। কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ এই কবিতাটি রচনা করেন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে। শেলী রচনা করেন ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে। কাজেই রোমান্টিক কাব্য-জগতের গুরুস্থানীয় ওয়ার্ডওয়ার্থ তাঁর কনিষ্ঠ শিষ্যস্থানীয় শেলীর মানসিকতা ও তাঁর কবিতা সম্বন্ধে জেনেই কতকটা শেলীর কবিতা স্কাইলার্কের উত্তররূপেই তাঁর 'স্কাইলার্ক’ কবিতাটি লেখেন।


শেলীর স্কাইলার্ক হচ্ছে এক আনন্দময় আত্মা, একটি সাধারণ পাখি নয়। একটা বিদ্রোহী আনন্দশক্তি আকাশের বহু উঁচুতে উঠে গেছে এবং গান গাইছে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার স্কাইলার্ককে ‘গগনচারী চারণ কবি! আকাশ তীর্থযাত্রী'! বলে সম্বোধন করেছেন। দৃষ্টিসীমার শেষবিন্দুতে এ গান গাইছে।


শেলীর স্কাইলার্ক ভূমিতল অবজ্ঞাকারী। ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কাইলার্ক ঊর্ধ্বচারী কিন্তু ভ্রমবিলাসী নয়, স্বর্গ ও মর্ত্যের মিলনগ্রন্থি রচক। শেলীর মতে মানুষের জন্ম হয়েছে অশ্রুপাতের জন্য, তাই তার মধুরতম গান হচ্ছে ব্যথার স্মৃতি। এমনকি তার ভালোবাসার মধ্যেও রয়েছে বিষণ্ণ পরিতৃপ্তি, মিলনের ক্লান্তি। কিন্তু ভূমিতল অবজ্ঞাকারী শেলীর স্কাইলার্ক হচ্ছে অবিমিশ্র আনন্দের উৎস। তাঁর স্কাইলার্কের আনন্দগীতে মর্ত্য মাটির কোনো বেদনাই স্পর্শ করতে পারে না। এই জগতের আনন্দ-দুঃখ-মিশ্রিত অসম্পূর্ণ আনন্দ, স্কাইলার্কের সুরমূর্ছনায় যে আনন্দ ঝরে পড়ে, সেই অপার্থিব আনন্দ সম্পূর্ণ। তাই পার্থিব আনন্দের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। কিন্তু ওয়ার্ডসওয়ার্থের স্কাইলার্ক ঊর্ধ্বগগনচারী হলেও মাটির সঙ্গে, মাটির নীড়ের সঙ্গে তার সম্বন্ধ আছে। ঊর্ধ্বপ্রয়াণ অভিলাষী হলেও নয়ন নীড়ের প্রতি ন্যস্ত থাকে। দুটি কবির দৃষ্টিভঙ্গিজাত পার্থক্যের জন্য একই পাখিকে নিয়ে লেখা কবিতাও হয়ে উঠেছে দুটি পৃথক কবিতা।


উভয়ের মধ্যে আর এক পার্থক্য আমাদের কৌতূহল সৃষ্টি করে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ রাইডাল পাহাড় (Rydal Mount) বলে কবিতাটি লেখেন। তাঁর লেখার সময় কবির ধারে কাছে কোনো স্কাইলার্ক ছিল না, ছিল না কোনো স্কাইলার্কের গীতরস-ধারা, কিন্তু তাঁর কল্পনাবিলাসী মন এই স্কাইলার্ক ও তার গীতধারার এক বাস্তবসম্মত ছবি আঁকেন। আর শেলী তাঁর কবিতাটি রচনা করেন ইতালির লেগহর্ন-এ। সেখানে পাখিটিকে না দেখতে পেলেও তার গান তিনি শুনতে পান। এই গান কানে শুনে তিনি স্কাইলার্ককে 'বিদেহী আনন্দশক্তি' সুদূর 'আকাশের তীর্থযাত্রী' এবং 'ভূমিতল অবজ্ঞাকারী' বলে অভিহিত করেছেন।


পরিশেষে বলা যায়, ওয়ার্ডস্ট্ওয়ার্থের কবিতার ভাষা ও ছন্দের মধ্যে রয়েছে এক প্রশান্তির ব্যঞ্জনা। কিন্তু শেলীর একের পর এক সাজানো স্তবক সজ্জার মধ্য দিয়ে ঝরে পড়ছে স্বর্গীয় আনন্দের স্ফুলিঙ্গ। ওয়ার্ডওয়ার্থ ও শেলী দু'জনের মধ্যে দুটি পৃথক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।