'পুতুল নাচের ইতিকথা' নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।

উপন্যাসের নামকরণের গুরুত্ব অসাধারণ। নামকরণের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু প্রতিভাত হয়। ঔপন্যাসিকের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি যাকে সমালোচকরা বলেন attitude to life—তাই এই নামকরণের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়ে। নামকরণ তাই উপন্যাসের ঘটনাস্রোত বা চরিত্র প্রবাহের মধ্যে দিয়ে ভেসে ওঠে। কারণ উপন্যাসের মূল motif বা উদ্দেশ্য এই নামকরণের মধ্যে ধরা পড়ে। এই নামকরণ কখনও হয় ব্যক্তিমূলক, কখনও হয় ভাবমূলক, কখনও হয় ঘটনামূলক, কখনও দৃষ্টিভঙ্গিমূলক। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-র নামকরণ জীবনদৃষ্টিমূলক, তবে রূপকাত্মক। জীবন সম্পর্কে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির কথা লেখক রূপকাকারে প্রকাশ করেছেন। এই দিক থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামকরণ বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী। উপন্যাসের শিল্পকর্ম-বিচারে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মানস-বিচারই মুখ্য। তাই নামকরণের মধ্যে এই মানস-বিচারকে বিশ্লেষণ করা চলে।


‘পুতুল নাচের ইতিকথা'-র পশ্চাৎ প্রচ্ছদে গ্রন্থপরিচিতি হিসেবে লেখা হয়েছিল—“পৃথিবীর এই বিরাট রঙ্গমঞ্চে মানুষ যেন শুধু পুতুল। কোনো অদৃশ্য হাতের সুতোর টানাপোড়েনে মানুষ নাচে, কাঁদে, কথা বলে। নদীর মত নিজের খুশিতে গড়াপথে তার জীবনের স্রোত বয়ে চলে না, মানুষের হাতে-কাটা খালে তার গতি।”


যে সীমাহীন নীড়প্রেমের স্বপ্ন দেখেছিল শশী, সে স্বপ্ন তার চুরমার হয়ে গেল কেন? তার প্রিয়জনের পদচিহ্ন লাঞ্ছিত কায়েত পাড়ার সেই নির্জন রাস্তা শশীর জীবনে শুধু রাজপথ হয়েই রইল। কিন্তু সে পথে প্রিয়জনের আনাগোনার প্রয়োজন গেল ফুরিয়ে। তালবনের মাটির টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবার শখ শশীর জীবনে সত্যিই কি আর আসবে না? দীর্ঘ ন'বছর ধরে প্রতিটি মুহূর্ত যে দুর্জয় প্রেমের জন্য কুসুমের দেহমন উদ্বেল হয়েছিল, সে মূহূর্ত যখন সত্যিই এল, সেই চপল রহস্যময়ী কুসুম সেদিন আবিষ্কার করল সে আর বেঁচে নেই। অপরূপ সুন্দরী সেনদিদি, গোপাল, নন্দলালের পাপ জমা করা দেহের অধিকারিণী বিন্দু, কুমুদ, মতি, এদের রহস্যঘন জীবনের অবগুণ্ঠন মোচন করবে কে? ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'—এই বিপর্যস্ত জীবন্ত পুতুলদের হাসিকান্নার মর্মান্তিক অভিনয় আর তাদের প্রেরণাহীন যান্ত্রিক জীবনের ব্যর্থতার ইতিহাস।


জীবনের অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে মানুষ কীভাবে যান্ত্রিক হয়ে যায়, কীভাবে তার স্বচ্ছন্দ গতিপথে বাধা পড়ে, কীভাবে জীবনে চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে আসে বিরাট দ্বন্দ্ব, তার ট্র্যাজিক রসাস্বাদের চিত্রমালা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'।


এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র শশী ও কুসুম। শশী ও কুসুমের সম্পর্ক যে নির্দিষ্ট গতিতে এক শুভ পরিণাম বা happy ending-এ গিয়ে উপনীত হয়নি এই উপন্যাসের প্রধান আখ্যায়িকা তার নিদর্শন। শশী গাওদিয়া গ্রামের সুখদুঃখের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মানুষের কল্যাণকর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। কিন্তু এই অনুকূল পরিবেশের মধ্যে শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতা ক্রমে দেখা দিল। শশীর কর্মপ্রেরণা তার Social ego-র সার্থক প্রকাশ। মতির জন্য তার স্নেহ ও সেবার শেষ নেই, সেনদিদিকে সে আপ্রাণ চেষ্টা করে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু বিনিময়ে সে কুসুমের কাছে ভুল বোঝাবুঝির চিহ্ন হিসেবে তিরস্কার পায়। সেনদিদির প্রতি আন্তরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধার বিনিময়ে সে পায় পিতা গোপালের সন্দেহ দৃষ্টি, যামিনী কবিরাজের অভিশাপ। শশী কুসুমের দুর্বার ভালবাসাকে বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না তার অন্তরের চাওয়া-পাওয়া। তাই কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে শশীর নীড়স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। “শশীর নীড়প্রেম সীমাহীন।" শেষে যখন সে নিজেকে বুঝতে পারে তখন ধরা দেয় কুসুমের বন্ধনে। কিন্তু তখন কুসুম তার ব্যাকুল মিনতি, তার আত্মনিবেদনকে ফিরিয়ে দেয় নিষ্ঠুর আবেগে। দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা করে করে শেষ পর্যন্ত কুসুম তাকে ছেড়ে পিত্রালয়ের দিকে চলে যায়। তালবনের উঁচু টিলার ওপর থেকে সূর্যাস্ত দেখার সখ ও সুখ চিরতরে হারিয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে শশীর দৈন্য ও কাঙালপনা দুর্নিবার হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। শশী কুসুমকে কাছে পেতে চায়। কিন্তু পরিবর্তনের স্রোতে কুসুম পরিবর্তিত হয়। শশীর ডাকে সাড়া দিয়ে সে নবজীবনের পথে নীড় বাঁধতে আর যেতে পারে না। কুসুম যে শশীর সঙ্গে মিলতে পারে না এর পেছনে কার অঙ্গুলি সঙ্কেত আছে জানা যায় না। কিন্তু শশী-কুসুমের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে যে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক পরিণাম সৃষ্টি হয়ে যায়, তা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র ট্র্যাজেডির একটি দৃষ্টান্ত। লেখক প্রশ্ন করে, "নদীর মতো নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বইতে পারে? মানুষের হাতে-কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিত, মাধ্যাকর্ষণের মতো যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।” এই অজানা শক্তির প্রভাবেই কুসুম-শশীর স্বপ্নের নীড় চুরমার হয়ে গেল, কুসুমের পরিবর্তন কেন শশীকে ঈপ্সিত পথে যেতে দিল না। “শশী জ্বালা বোধ করে। এ কি আশ্চর্য যে কুসুমকে সে বুঝিতে পারে না। মৃদু স্নেহ সিঙ্খিত অবজ্ঞায় সাতবছর যার পাগলামিকে সে প্রশ্রয় দিয়াছিল? শশীর একটা দুর্বোধ্য কষ্ট হয়। যা ছিল শুধু জীবনসীমায় বহিঃপ্রাচীর। হঠাৎ তার মধ্যে একটা চোরা দরজা আবিষ্কৃত হইয়াছে, ওপাশে কত বিস্তৃত, কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময়।” এই সম্ভাবনার ক্ষেত্র রুদ্ধ হয়ে গেল যে শক্তিতে সে শক্তি সকলের কাছে দুর্বোধ্য। প্রথম জীবনে কর্মপ্রেরণায় শশীর কুসুমের প্রতি অবজ্ঞা, পরবর্তীকালে কুসুমের আবেগহীন নিষ্ক্রমণ সবই যেন কার্যকারণহীন সূত্রহীন পাগলামি—“কে জানিত কুসুমের দৈনন্দিন কথা ও ব্যবহার মেশানো অসংখ্য সংকেত, অসংখ্য নিবেদন এত প্রিয় ছিল শশীর। এত সে ভালোবাসিত কুসুমের জীবনধারায় মৃদু এলোমেলো, অফুরন্ত কাতরতা। বিষাদ চিরদিনের জন্য চলিয়া যাইবে। আর আজ এই তালবনে তার এত কাছে বলিয়া খেলার ছলে কুসুম শুধু বাজাইতে থাকিবে। কি অন্যায় কুসুমের, কি সৃষ্টি ছাড়া পাগলামি।” কুসুমের এই পরিবর্তনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যাই হোক, এই পরিবর্তনের পশ্চাতে কোন অদৃশ্য শক্তির লীলা নিশ্চয় আছে।


কুসুমের জীবন সম্পর্কে কুসুমের বাবা অনন্ত শশীকে একবার বলেছিল তার স্বপ্নের ব্যর্থতা প্রসঙ্গে—“সব চেয়ে ভালো ঘর দেখে ওর বিয়ে দিলাম। ওর অদৃষ্টেই হল কষ্ট। সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে আসছি ডাক্তারবাবু। পুতুল বই তো নই আমরা। একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন”–এর উত্তর বিজ্ঞানমনস্ক শশী বলেছে, “তাকে একবার হাতে পেলে দেখে নিতাম।” কুসুম চিরকালের জন্য গাওদিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে, পরান জমিজমা সব বেচে দেবেন এমনি করে পরানের সংসারও শেষ হবে এক অর্থহীন অপচয়ে। এটাও সেই অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিত।


শশীও এই অদৃশ্য শক্তির লীলাতে বিশ্বাস করে। কেবল তার নিজের জীবনেই পুতুল নাচের ইতিকথা সার্থক হয়ে উঠেনি। গোপালের সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া, যাদব ও পাগলদিদির মৃত্যুকে দেখে, বিন্দু, মতির জীবনের পরিণতি দেখে শশীর বার বার মনে হয়েছে যে জীবনের সব শক্তি মানুষের হাতে নেই।


মতিকে সুখী করার জন্য শশীর কত চেষ্টা। মতি ছিল শশীর স্নেহের ও আদরের। ছেলেবেলা থেকে মতির জীবন ছিল স্বপ্নে ভরা। “স্বপ্ন মতির অফুরন্ত। মস্ত একটি ঘরের এককোণে সে বসিয়া আছে। সর্বাঙ্গে তাহার ঝলমলে গহনা, পরণে ঝকঝকে শাড়ি। ঘোমটার মধ্যে চন্দনচর্চিত মতির মুখখানি কি রাঙা লজ্জায়।” এই লজ্জা-সুন্দর বধূ জীবন থেকে সে কোন জীবনে পৌঁছল? শশী ছিল মতির আদর্শ তাই ছেলেবেলা থেকে শশীকে সে ভক্তি করে, শশীকে শ্রদ্ধা করে। “মতির ভারি ইচ্ছা, বড়লোকের বাড়িতে শশীর মতো বরের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। কাজ নাই, বকুনি নাই, নোংরামি নাই, বাড়ির সকলে সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে হাসে, তাসপাশা খেলে, কলের গান বাজায় আর বাড়ির বৌকে খালি আদর করে। চিবুক ধরিয়া তাহার লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া বলে লক্ষ্মী বৌ, এমন না হলে বৌ।” এই পটভূমিতে মতির জীবনে একদিন কুমুদ এসে দেখা দেয়। বিনোদিনী অপেরার দলে অভিনয় করতে এসে কুমুদের প্রবীরের ভূমিকায় অভিনয় দেখে মতি মুগ্ধ হয়। তার স্বপ্ন-কল্পনাকে সে প্রবীরের মধ্যে দেখে। বীরপূজা নেমে আসে প্রেমে। কিন্তু সেই প্রেমের পরিণামে ঘর নয়, পথই হয়ে ওঠে তার সঙ্গী। হোটেলে হোটেলে ঘুরে তার দাম্পত্যজীবন অপ্রচলিত পথে চলতে থাকে। কুমুদের বোহেমিয়ান, খামখেয়ালী, বর্তমান সর্বস্ব জীবনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মতিকে জীবনের অন্য পথে “যেতে হয়। “গাওদিয়ার গেঁয়ো মেয়ে মতি" শেষ পর্যন্ত মতিকে নিয়ে কুমুদ নিরুদ্দেশের পথে পা বাড়ায়। মতির স্বপ্নভঙ্গ হয়। এই ট্র্যাজেডি মতির জীবনের যন্ত্রণা। অস্থির, চঞ্চলস্বভাবী মতি হোটেলের ঘরে বসে আক্ষেপে ছটফট করে—“মনে হয় কুমুদ তাকে চিরকাল এই ছোটো ঘরটাতে পা-টেপানোর জন্য আটকাইয়া রাখিবে। তার খেলার সাথী কেউ থাকিবে না। মাঠ ও আকাশ আর জীবনে পড়িবে না চোখে, বালিমাটির নরম গেঁয়ো পথে আর সে পারিবে না হাঁটিতে।" এই 'nostalgia' মতির জীবনের ব্যর্থতাবোধ থেকেই উদ্ভূত। কুমুদের জীবনে কোনো সুবিবেচনা ও শুভবুদ্ধি নেই। জীবনকে উপভোগ করার জন্য কুমুদ ঝুঁকি নিতে চায়। তাই সে যাযাবর কিন্তু গৃহনীড় নেই, সংসার নেই। এমন এক জীবনের আকর্ষণ মতির কাছে তুচ্ছ। তবু সে স্বামীর বধূ নয়, সঙ্গিনী হয়ে থাকতে চায়। তার জীবনের এই ট্র্যাজেডির জন্য যে নিয়তির নির্দেশ আছে, সেই নিয়তির নির্দেশকে পুতুল নাচের ইঙ্গিত ছাড়া কিছুই বলা যায় না। মতি-কুমুদের জীবনের ট্র্যাজেডি এই পুতুল নাচের ইতিকথার ট্র্যাজেডি। বিন্দু-নন্দলালের অস্বাভাবিক জীবন নরনারীর সম্পর্কের আর এক জীবন যন্ত্রণার দিক।


গোপাল দাসের দালালি-মহাজনি কারবারের ইতিহাসে হঠাৎ একদিন নন্দলাল পাটের কারবার উপলক্ষে গাওদিয়ায় এসে পড়ে। ব্যবসার প্রয়োজনে একটি মধ্যবর্তী গ্রাম খুঁজে বাড়ি করার উদ্দেশ্যে সে গোপালদাসের সান্নিধ্য পায়। গোপাল দাস তাকে আদর যত্ন করে ঘরের ভেতর স্থান দেয়। তারপর জীবনের চক্র যে কী রহস্য সৃষ্টি করে, যে পাড়ার লোকে নন্দলাল-বিন্দুর সম্পর্ককে বিবাহে রূপ দেবার জন্য লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়ে। এক সামাজিক গণ্ডগোলের পটভূমিতে বিন্দু-নন্দলালের জীবনে স্বামী স্ত্রীর দায়িত্ব এসে পড়ে। কিন্তু কালের গতিতে শেষ পর্যন্ত বিন্দু নন্দলালের জীবনে এমন এক ট্র্যাজেডির অন্ধকার নেমে আসে, যা তার স্বামীবন্ধন থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে বিন্দুকে নন্দলালের রক্ষিতা পরিচয়ে আবদ্ধ করে রাখে। প্রেমের বিষামৃত পান করে বিন্দু নিজেকে নিঃশেষ করেছে। সে নন্দলালের ল্যাম্পট্যকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। তাই সে নন্দলালের রংমহলে হারমোনিয়াম, বাঁয়া তবলা, দেওয়াল জুড়ে পাতা ফরাসের মধ্যে সাময়িক অলংকার-ঐশ্বর্য্যের পঙ্কে দিন কাটায়। শশী বিন্দুকে গাওদিয়ায় নিয়ে আসে। সে শশীর ওষুধ খায়। কিন্তু বিন্দুর মন হাহাকার করে নন্দলালের জন্য। “সংসারে এরকম অদ্ভুত মেয়ে দু-চারটে থাকে।” শশী বিন্দুর অন্তলোককে সুবিন্যস্ত করার জন্য তাকে কাছে নিয়ে আসে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। নন্দর কাছে যাওয়া ছাড়া তার গতি নেই। বিন্দুর এই অনমনীয় জেদ ও আসক্তি তাকে এক অদ্ভুত জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। বিন্দুর এই ট্র্যাজেডির জন্য কোনো অদৃশ্য শক্তির ক্রিয়া যে দায়ী, এ বিষয়ে শশীর কোনো সন্দেহ নেই। জীবনের অজ্ঞাত রহস্য বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে বৈকি।” শশী যতই চেষ্টা করুক কোনো অদৃশ্য শক্তি তার সর্বকর্মের পথ রুদ্ধ করেছে। শশীর এই বোধের মধ্যে 'পুতুল নাচের ইতিকথা'-র নামকরণের ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। বিশেষ করে শশী চিকিৎসক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। তার পরিজনদের পরোপকার-কৃত্য সন্দেহের অতীত। কিন্তু এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার মধ্যে তার মনে হয়েছে যে “একটা অদৃশ্য দুর্বার শক্তি যেন অহরহ তার বিরুদ্ধে কাজ করিতেছে।" বিন্দুর কথা ভাবিয়া সে কূলকিনারা দেখিতে পায় না। বিন্দুকে সেই নন্দর কবল হইতে ছিনাইয়া আনিয়াছে—ওর সম্বন্ধে সমস্ত দায়িত্ব তাহার। বিন্দু যে বীভৎস কীর্তি করিয়া লোক হাসাইয়াছে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে অকথ্য রটনা হইতেছে, এজন্য শশী নিজেকে অপরাধী মনে করে। তারই দোষ। যে বিষয়ে সে দায়িত্ব গ্রহণ করে তাই ভেস্তাইয়া যায়।” এই বোধ ট্র্যাজিক নায়কের বোধ নয়, উপন্যাসের মূল ভাবাদর্শের বোধ। মতির ব্যর্থতা, বিন্দুর নিষ্ফল ও বিকৃত জীবন, শশী-কুসুমের সম্পর্কের করুণ অবসান সবই এক অদৃশ্য শক্তির অঙ্গুলি হেলনে নিজস্ব পরিণতির মুখোমুখি হয়েছে। এই সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক মানিকের জীবনদর্শন ফুটে উঠেছে। এই দিক থেকে বিচার করলে ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র নামকরণ সার্থক হয়ে উঠেছে।