কবি জয়দেব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা | 'গীতগোবিন্দ' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

জয়দেব গোস্বামীর জীবন কাহিনী, আবির্ভাবকাল এবং তাঁর রচিত 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করো।


জয়দেবের পরিচয় : বিভিন্ন কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করে জয়দেব গোস্বামীর যে সমস্ত জীবনকাহিনী রচিত হয়েছে, তার পরিচয় পাওয়া যায় চক্রদত্ত-রচিত সংস্কৃত ‘ভক্তমাল’, নাভাজীকৃত ‘ভক্তমাল’, বনমালীদাস-কৃত ‘জয়দেব চরিত্র' এবং 'শেকশুভোদয়া' নামক গ্রন্থসমূহে। এ সমস্ত গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনী প্রধানতঃ জনশ্রুতি-নির্ভর এবং অলৌকিকতার পরিচয়ও যথেষ্ট রয়েছে। তাই জয়দেবের তথ্যনিষ্ঠ জীবনকাহিনীর জন্য এ জাতীয় গ্রন্থের উপর আস্থা স্থাপন করা যায় না। এ বিষয়ে বরং জয়দেব গোস্বামী তাঁর 'গীতগোবিন্দ' গ্রন্থে যে আত্মপরিচয় দান করেছেন, তার উপর নির্ভর করাই সঙ্গত। গ্রন্থের দ্বাদশ সর্গের শেষ শ্লোকে লিখিত হয়েছে

‘শ্রীভোজদেবপ্রভবস্য বামাদেবীসুত শ্রীজয়দেবস্য।

পরাশরাদিপ্রিয়বন্ধুকণ্ঠে শ্রীগীতগোবিন্দকবিত্বমস্ত৷৷'


এ থেকে জানা যায় 'গীতগোবিন্দ' গ্রন্থ-রচয়িতা জয়দেব, তাঁর পিতার নাম ভোজদের মাতার নাম বামাদেবী এবং তাঁর একজন বন্ধু ছিলেন পরাশর। গ্রন্থের বিভিন্ন সর্গেই কবি ‘পদ্মাবতী' নামটি যেভাবে উচ্চারণ করেছেন, তাতে মনে হয় পদ্মাবতী ছিলেন জয়দেব-পত্নী; কেউ কেউ মনে করেন জয়দেব ছিলেন পদ্মাবতীর নৃত্য-শিক্ষক (‘পদ্মাবতী-চরণ-চক্রবর্তী'); এ বিষয়ে ভিন্ন মতও প্রচলিত আছে। কবি তাঁর জন্মস্থান-রূপে উল্লেখ করেছেন ‘কেন্দুবিল্বে’র নাম। বীরভূম জেলার অজয় নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা ‘কেঁদুলি’ গ্রামটিই কবি-ধাত্রী-রূপে গণ্য হয়ে থাকে, কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তর মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বগুড়া জেলায় ‘কেন্দুলী' নামে একটি গ্রাম তৎ-সন্নিহিত ‘জয়দেব ঠাকুর’ নামক একটি পুকুরও পাওয়া যায়। উড়িষ্যার প্রাচীন নদীর ধারে ‘কেন্দুলী' নামে একটি বড় গ্রাম আছে। মিথিলাতেও ‘কেন্দোলি' নামে একটি গ্রাম আছে এবং এরা সকলেই জয়দেবের দাবিদার। তবে ভক্তমাল’ এবং ‘জয়দেবচরিত্র' গ্রন্থে বীরভূম জেলার কেদুলিকেই জয়দেবের জন্মস্থান-রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণভাবে পণ্ডিতমণ্ডলী এই অভিমতটিকেই মান্যতা দিয়ে থাকেন।


জীবৎকাল : জয়দেবের জন্মকাল সম্বন্ধে কিছুই জানা সম্ভবপর না হলেও তাঁর জীবৎকাল-বিষয়ে একটা মোটামুটি ধারণা করা চলে। জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ' কাব্যে উমাপতিধর, শরণ, গোবর্ধন এবং ধোয়ীর নাম তাঁর নিজের নামের সহযোগে উচ্চারণ করেছেন। ঐতিহ্যানুসারে এই পঞ্চজন সেনবংশীয় সম্রাট লক্ষ্মণসেনের রাজসভার ‘পঞ্চরত্ন’ ছিলেন বলে প্রসিদ্ধি আছে। মেবারের রাণা কুম্ভ, প্রখ্যাত বৈষ্ণবসন্দর্ভকার সনাতন গোস্বামী এবং ‘শেকশুভোদয়া’ গ্রন্থেও লক্ষ্মণসেনের সভায়ই যে জয়দেব উপস্থিত ছিলেন, তার উল্লেখ রয়েছে। অতএব, জয়দেব লক্ষ্মণসেনের সমকালীন ছিলেন—এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো বাধা নেই। লক্ষ্মণসেন দীর্ঘজীবী পুরুষ ছিলেন এবং তিনি শেষ জীবনেই রাজ্যভার গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিকগণ অনুমান করেন, সম্ভবত ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লক্ষ্মণসেন রাজত্ব করেছিলেন। অতএব দ্বাদশ শতকের শেষদিকে যে জয়দেব গোস্বামী বর্তমান ছিলেন, এ বিষয়ে সংশয়ের কোন কারণ নেই।


গীতগোবিন্দ :

উৎস : বৈষ্ণবদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ দ্বাদশ সার্গে রচিত শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণের অনুসরণে জয়দেব গোস্বামী মধুরকোমলকাত্ত-পদাবলী 'গীতগোবিন্দ' নামক কাব্য দ্বাদশ সর্গে রচনা করেন। প্রধানত ভাগবতপুরাণ থেকেই তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু গ্রহণ করলেও হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং ব্রহ্মপুরাণে অনুরূপ কাহিনী বর্তমান আছে। আলোচ্য ‘গীতগোবিন্দ' কাব্যের মূল বিষয়-বসন্তরাস পরিত্যাগিণী রাধা কৃষ্ণ-সন্ধানে তৎপর, তাঁর বিরহ, মান-অভিমান এবং পরিণামে কৃষ্ণ-সহ মিলন। পূর্বোক্ত উৎস গ্রন্থগুলির কোথাও রাধার নাম নেই, 'রাধা' নামটি বৈষ্ণব সাহিত্যে পরবর্তীকালে যোজিত হয়েছে। অনুমিত হয়, কোন লৌকিক কাহিনী থেকেই এই নামটি বৃন্দাবনের কৃষ্ণ-কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারে। পক্ষান্তরে, কোনো কোনো বৈষ্ণবাচার্য অনুমান করেন, ভাগবতের ‘অনয়ারাধিতো’ পদের মধ্যেই 'রাধা' নামের বীজ লুক্কায়িত। পরবর্তীকালে রাধাকৃষ্ণের লীলাকাহিনী অবলম্বনে যে অসংখ্য বৈষ্ণব পদ এবং অজস্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে, জয়দেবের 'গীতগোবিন্দ' কাব্যই তার প্রথম পথপ্রদর্শকের মর্যাদা দাবী করতে পারে।


জাতিবিচার : জয়দেব তাঁর রচনাকে 'মহাকাব্য' রূপে গ্রহণ করেই একে দ্বাদশটি সর্গে বিভক্ত করেছেন। তবে সর্গবন্ধ এবং বিষয়গৌরব থাকলেও অন্যান্য বিচারে এটিকে 'নাট্যপ্রবন্ধ' কিংবা ‘গীতিনাট্য' বলা চলে। পাশ্চাত্ত্য সমালোচকগণ এর জাতি নির্ণয়ে বহু বিচিত্র মত উল্লেখ করেছেন : “Modern critics have found in it a lyrical drama (Lassen), a pastoral (Jones) an opera (Levi), a melodrama (Pischel) and a refined Yatra (Von Schroeder)." I


কাহিনী বিশ্লেষণ : দ্বাদশ সর্গে বিরচিত ‘গীতগোবিন্দ’ মূলত চব্বিশটি গানের একটি পালা, এ ছাড়া কাহিনী-সূত্র ধরিয়ে দেবার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ছন্দে রচিত কতকগুলি শ্লোক। এই গান বা পদ এবং শ্লোকগুলি কৃষ্ণ রাধা অথবা কোন এক সখীর উক্তি-রূপে ব্যবহৃত হওয়াতে সমগ্র কাহিনীটি একটি নাটকের পালার আকার ধারণ করে। বারোটি সর্গের প্রত্যেকটিরই একটি নাম আছে এবং নামটি অর্থবহ।


প্রথম সর্গ – 'সামোদ দামোদর’ : কৃষ্ণসন্ধানে তৎপরা শ্রীমতী রাধিকা এক সখীর সহায়তায় দেখতে পেলেন, অপর এক নায়িকার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ আমোদে মত্ত। দ্বিতীয় সর্গ— 'অক্লেশ কেশব' : নিজের উৎকর্ষ আর রইলো না ভেবে শ্রীমতী নির্জনে এক লতাকুঞ্জে ক্ষুব্ধ হয়ে সখীকে বল্লেন, শ্রীকৃষ্ণ অপর যুবতীর প্রতি আসক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমার মন তাঁর প্রতি অনুরক্ত কেন? শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের বিলাসকলা দেখে হয়তো বা রাধার কথাই স্মরণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে রাধা মিলন কামনা করেছেন—কেশব সকলের ক্লেশ দূর করুন। তৃতীয় সর্গ—'মুগ্ধ মধুসূদন' : শ্রীকৃষ্ণ ও অপর ব্রজাঙ্গনাদের ত্যাগ করে রাধার সন্ধানেই তৎপর হলেন। নিজের অপরাধবোধে তিনিও অনুতপ্ত। রাধাভাবে তন্ময় মুগ্ধ মধুসূদন রাধার সঙ্গে মিলনের কথাই ভাবছেন। চতুর্থ সর্গ – ‘স্নিগ্ধ মধুসূদন': যমুনাতীরে বেতসকুঞ্জে অসহায় উদ্ভ্রান্ত মাধবকে এক সখী জানালেন তাঁর বিরহে রাধা অতিশয় কাতর হয়ে পড়েছেন; কখনো তিনি রোমাঞ্চিত, কখনো বিলাপরত, কখনো বা মূর্ছিত। একমাত্র স্নিগ্ধ মধুসুদনের কথা ভেবেই তিনি এখনো জীবিত রয়েছেন। পঞ্চম সর্গ – ‘সাকাঙ্খ পুণ্ডরীকাক্ষ': রাধাকে তাঁর কুঞ্জে নিয়ে আসবার জন্য কৃষ্ণ সখীকে রাধার কাছে পাঠিয়ে দিলে সেই সখী রাধার নিকট কৃষ্ণের বিরহ-কাতর অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে জানালেন যে কৃষ্ণ ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে রাধার নাম ধরে কাঁদছেন। অতএব রজনী প্রভাত হবার পূর্বে শ্রীমতী যেন পুশুরীকাক্ষের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন। ষষ্ঠ সর্গ—‘ধৃষ্ট বৈকুণ্ঠ’ : সখী শ্রীকৃষ্ণের কাছে ফিরে এসে জানালেন যে শ্রীমতীর দেহ কৃষ্ণবিরহে বিকল, তার চলবার শক্তি নেই। এতএব ধৃষ্ট বা নির্লজ্জ-রূপে কৃষ্ণের এখন কর্তব্য বিপরীত অভিসারে রাধাকুঞ্জে গমন। সপ্তম সর্গ – 'নাগর নারায়ণ’কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় সময় কেটে চলে শ্রীমতীর; পাতা পড়ার শব্দে মনে হয় বুঝি কৃষ্ণ আসছেন। এদিকে জ্যোৎস্না দেখা দিলে রাধিকা একান্ত হতাশ হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। তার মনে ভয় হলো, কৃষ্ণ কি তবে সঙ্কেত-নির্দিষ্ট বেতস কুঞ্জে না এসে অপর কোন নায়িকার অভিসারে গিয়েছেন? বিপ্রলব্ধা শ্রীমতী বহুবল্লভ কৃষ্ণের নাগর-রূপের কল্পনায় সাতিশয় মনঃপীড়া বোধ করতে লাগলেন। অষ্টম সর্গ—“বিলক্ষ লক্ষ্মীপতিঃ যামিনী অবসানে কৃষ্ণ শ্রীমতীর কুঞ্জদ্বারে উপনীত হলে তাঁর দেহে অপর নারীর সম্ভোগচিহ্ন দর্শন করে শ্রীমতী তীব্র ভাষায় তাঁকে বিদ্ধ করতে লাগলেন। খণ্ডিত নায়িকার ভর্ৎসনায় বিলক্ষ অর্থাৎ বিস্মিত কৃষ্ণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নবম সর্গ – 'মুগ্ধ মুকুন্দ' : মদনসত্তপা ক্ষুব্ধা কলহান্তরিতা রাধাকে লক্ষ্য করে সখী নির্জনে তাকে বল্লেন যে কৃষ্ণ যখন অভিসারে এসেছেন তখন আর মান করে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। তিনি এসে মধুর কথা বলুন, তোমার হৃদয় যন্ত্রণাও দূরীভূত হবে। দশম সর্গ—'মুগ্ধ মাধব'। সন্ধ্যার দিকে রাধার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলে কৃষ্ণ কাছে এসে রাধার রূপগুণের প্রশংসা করতে লাগলেন এবং তাঁর মান ত্যাগ করবার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন। অতঃপর শ্রীমতীর চরণযুগলে মস্তক স্থাপন করে শ্রীকৃষ্ণ মানিনীর মানভঞ্জন করলেন। একাদশ সর্গ – 'সানন্দ গোবিন্দ': এইভাবে শ্রীমতীকে প্রসন্ন করে কৃষ্ণ কুঞ্জশয্যায় গেলে সখী রাধিকাকে অনুসরণ করতে বললেন। সখীরা সকলে কুঞ্জ থেকে বাইরে চলে গেলে অভিসারিকা রাধিকার লজ্জাও অপসৃত হলো। দ্বাদশ সর্গ – ‘সুপ্রীত পীতাম্বর': সখীরা চলে গেলে শ্রীকৃষ্ণ সাদরে রাধিকাকে গ্রহণ করলেন। স্বাধীনভর্তৃকা শ্রীমতী রাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হলেন।


‘গীতগোবিন্দের’ ২৪টি প্রবন্ধগানে বিভিন্ন প্রকার রাগ-রাগিণী এবং তাল-ব্যবহারের নির্দেশ রয়েছে। অনুরূপভাবে ছন্দ-ব্যবহারেও জয়দেব যথেষ্ট কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। শ্লোকগুলি বৃত্তছন্দে রচিত হলেও যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে। পদ বা গানগুলি রচিত হয়েছে মাত্রাছন্দে – এর মধ্যে তিনি প্রাকৃত অবহট্ঠ ছন্দকে অনায়াসে স্থান দান করেছেন, এ বিষয়ে তাঁর অনন্যতা অবশ্যস্বীকার্য।