নয়টি রস কীভাবে নয়টি ভাব থেকে জাত হয় | করুণ রস পরিণামে আনন্দদায়ক হয় কেন?

'রীতিরাত্মা কাব্যসা'- এই মতটি আলংকারিকরা গ্রহণ করতে পারেননি কেন?

'সাহিত্যদর্পণ 'কার বিশ্বনাথ একটি উক্তি উদ্ধার করে বলেছেন, 'রীতয়ঃ অবয়ব-সংস্থানবিশেষবং অলঙ্কারাশ্চ কটককুণ্ডলাদিবৎ'—অর্থাৎ রীতি যেন অবয়ব সংস্থান-বিশেষ এবং অলংকার তার কটককুণ্ডলাদির মতো সজ্জা উপকরণ। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-সংস্থান যদি নির্দোষ হয়, তবেই সেই দেহের শোভা বৃদ্ধি করতে পারে অলংকার। স্টাইল বা রীতি হচ্ছে সেই অঙ্গ-সংস্থান।


অলংকার শাস্ত্রে যাঁরা রীতি-বাদী নন, তাঁরা কিন্তু অবয়ব-সংস্থানকে কোনো বিশেষ মূল্য দানে স্বীকৃত নন। “ধ্বন্যালোক' গ্রন্থে রয়েছে—'রমণীদেহের লাবণ্য যেমন অবয়ব-সংস্থানের অতিরিক্ত অন্য জিনিস, তেমনি মহাকবিদের বাণীতে এমন বস্তু আছে যা শব্দ, অর্থ, রচনাভঙ্গি, এ সবার অতিরিক্ত আরও কিছু।' এই অতিরিক্ত বস্তুই কাব্যের আত্মা। অতএব, ওঁদের মতে, 'রীতিরাত্মা কাব্যস্য' কিংবা 'কাব্যের আত্মা হল স্টাইল'—শেষ পর্যন্ত এই মতবাদ অস্বীকৃত হয়েছে।



সঙ্কর অলংকার ও ধ্বনি এক নয় কেন?

বস্তুত কিছু বাচ্যালঙ্কারের সঙ্গে ধ্বনিকে যে গুলিয়ে ফেলা সম্ভব, তা' ধ্বনিবাদীগণ যথাযথভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বলেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। 'ধ্বন্যালোকে বলা হয়েছে ব্যঙ্গা যেখানে অপ্রধান এবং বাচ্যার্থের অনুযায়ী মাত্র, যেমন সমাসোক্তি অলংকার, সেখানে সেটি স্পষ্টতই বাচ্যালঙ্কার, কোনো ক্রমেই একে ধ্বনি বলা চলে না। ব্যঙ্গ্য আভাসমাত্র থাকলে অথবা বাচ্যার্থের অনুগামী হলে তাকে ধ্বনি বলে না, কারণ ধ্বনির প্রাধান্য সেখানে প্রতীয়মান নয়, যেখানে শব্দ ও অর্থ ব্যঙ্গাতেই প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেই হচ্ছে ধ্বনির বিষয় : অতএব সঙ্কর অলংকার এবং ধ্বনিও এক নয়। সমাসোক্তি অলংকারে শব্দের প্রয়োগ খুব সংক্ষেপে করা হয়। বলে এই নাম। এই অলংকারে বর্ণিত এক বস্তুতে অপর বস্তুর ব্যবহার অরোপ করা হয়, কিন্তু তার স্বতন্ত্র উল্লেখ থাকে না। আচার্য আনন্দবর্ধন একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধার করেছেন, যার মর্মার্থ—“উপগত সন্ধ্যারোগ আকাশে যখন তারকা অস্থিরদর্শন, সেই নিশার প্রারম্ভে যেমন চন্দ্রোদয় হল, অমনি পূর্বদিকের সমস্ত তিমির যবনিকা কখন যে রশ্মিরাগে অপসৃত হল তা লক্ষ্যই হল না।"


সমাসোক্তি, অতিশয়োক্তি, কিংবা সঙ্কর আদি অলংকারের যথাযথ প্রয়োগ ঘটলে তার কৌশল, মাধুর্য ও তাদের ব্যঞ্জনাকে 'ধ্বনি' বলে ভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। তাই ধ্বনিবাদীগণ সতর্ক করে দিয়েছেন যে প্রতীয়মান অর্থব্যানা না থাকলে তা ধ্বনি হবে না কারণ এটিই তার বিশিষ্ট লক্ষণ। ধ্বনি বাচ্যার্থকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেলেও তা বাচ্যাতিরিক্ত, ধ্বনি বাচ্যও নয়, অলংকারও নয়, তবে ব্যঙ্গ্য এবং অলঙ্কার্য—এটি রমণীদেহের লাবণ্যের মতোই দেহাতিরিক্ত সৌন্দর্য।



কাব্যের ধ্বনি কীভাবে রসের ধ্বনিতে পরিণত হয় আলোচনা করো।

কোনো কোনো অলংকারের সুকৌশল ব্যবহারে এক বস্তুর দ্বারা অপর বস্তুর ব্যঞ্জনা অথবা এক অলংকার দ্বারা অপর অলংকারের ব্যঞ্জনাকে ‘ধ্বনি’ বলে ভ্রম হতে পারে। এ বিষয়ে সতর্ক করে দেবার জন্য ‘ধ্বনি’ সমাসোক্তি এবং সঙ্কর অলংকারের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে এদের মধ্যে বাচ্যাতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা না থাকায় এগুলিকে ধ্বনি-রূপে গ্রহণ করা চলে না। ব্যঞ্জনামাত্রই কাব্য নয়, শব্দের ও অলংকারের ব্যঞ্জনা যদি বাচ্যাতিরিক্ত বিষয়ের ব্যঞ্জনা না হয়, তবে তা কাব্য হতে পারে না। বাচ্যার্থ-অতিক্রমী রসের ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্যে উন্নীত করতে পারে। আচার্য অভিনব গুপ্ত তাঁর ‘লোচন’ টীকায় স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন যে অসংলক্ষ্যক্রমধ্বনি অর্থাৎ যেখানে বাচ্যার্থ এবং ব্যঙ্গ্যার্থের যুগপৎ প্রকাশ ঘটে, সেই ধ্বনিই শ্রেষ্ঠ ধ্বনি এবং রসধ্বনিই ধ্বনিসম্রাট্, এটিই কাব্যের আত্মা—‘রসধ্বনেঃ এর সর্বত্র মুখ্যভূতমাত্মত্বম্।' ব্যঙ্গ্যার্থ অসংলক্ষ্যক্রমে সাক্ষাৎভাবে রসকে জাগালেই তা হয় ‘রসধ্বনি'। বস্তুত ধ্বনিবাদীরাও কাব্যের আত্মারূপে স্বীকৃতি দান করেছেন রসকেই এবং ধ্বনিকে বলেছেন রসের প্রকাশ। যাবতীয় ধ্বনির পর্যাবসান ঘটে রসধ্বনিতে। এমন কি সংলক্ষ্যক্রম ‘বস্তু-ধ্বনি’ এবং ‘অলংকারধ্বনি'—যা দ্বারা যথাক্রমে বাচ্যাতিরিক্ত বস্তু ও অলংকার ব্যঞ্জিত হয়, তারাও শেষ পর্যন্ত রসে পর্যবসিত হয়।



পাঠক চিত্তে রসোপলব্ধি কী করে সম্ভব হয়—আলোচনা করো।

একটি কঙ্কাল থেকে যেমন লালিত্যে ও লাবণ্যে ভরা যৌবনের কঠিন-কোমল নিটোল পরিপূর্ণ দেহের পরিচয় পাওয়া যায় না, তেমনি কাব্যের তত্ত্ব-বিচারেও কাব্যরসের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবু মানুষ নিজের তৃপ্তির জন্য কাব্য-রসের বিচারে প্রবৃত্ত হয় এবং এইভাবেই কাব্যের সঙ্গে অলংকার-শাস্ত্রও গড়ে ওঠে। কাব্যের রস সহৃদয়-হৃদয়-সংবাদী বলেই কাব্যের রস-বিচারে কাব্যরসের আস্বাদ পাওয়া যায় না। বস্তুত কাব্যরসাস্বাদী সহৃদয় লোকের মনের বাইরে রসের আর কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। সহৃদয় লোকের চিত্তে সুকাব্যপাঠ-জনিত যে বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তারই নাম 'রস'। অতএব কাব্যরসের অবস্থান কাব্যে নয়, তার অবস্থান কাব্যপাঠকের মনে।


রসের বিশ্লেষণেও পাওয়া যায় বাহ্যিক ও মানসিক উপাদান। বাহ্যিক উপাদান আসে কবির সৃষ্ট কাব্যের জগৎ থেকে, বাইরের জগৎ থেকে নয়, আর মানসিক উপাদান হল 'ভাব' নামক চিত্তবৃত্তি বা 'ইমোশন'। কাব্যজগতের বাহ্যিক উপাদানের ক্রিয়ায় মনের ভাব ‘রসে' রূপান্তরিত হয়। লৌকিক বস্তুজগতের শোক-হর্ষাদি নানা কারণে মানুষের মনে লৌকিক ভাবের জন্ম দেয় আবার ঐ সকল লৌকিক ভাব এবং কারণই কাব্যের জগতে এক অলৌকিক রূপ প্রাপ্ত হয়ে লৌকিক ভাবের বৃত্তি বা বাসনাকে অলৌকিক রসে পরিণত করে।



করুণ রস পরিণামে আনন্দদায়ক হয় কেন?

করুণ রসের পশ্চাতে লৌকিক শোকের কারণ থাকলেও তা কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই শোকের 'ভাব' বা ‘ইমোশন' নয়। কারণ, শোক দুঃখদায়ক, কিন্তু শোকের কাব্যপাঠে সহৃদয় পাঠকের মনে যে করুণ রসের সৃষ্টি হয়, তা চোখে জল আনলেও পাঠকের মনকে আনন্দে পূর্ণ করে দেয়।


করুণ রসমাত্রই যে দুঃখদায়ক নয়, এ বিষয়ে প্রাচীন আলংকারিকগণ বিশেষভাবেই অবহিত ছিলেন। 'সাহিত্যদর্পণ' কার বলেন, 'বিষ্ণু তেষু যদা দুখং ন কোঽপি স্যাত্তদুন্মুখঃ। তথা রামায়ণাদীনাং ভবিতা দুঃখহেতুতা। অর্থাৎ করুণরস মাত্রই যদি দুঃখের কারণ হত তবে রামায়ণাদি কাব্যপাঠে কেউ উন্মুখ হত না। ক্রৌঞ্জীর লৌকিক দুঃখে অবশ্যই বাল্মীকির মনেও লৌকিক দুঃখের সৃষ্টি করে থাকবে, কিন্তু বাল্মীকি যদি শুধু শোকার্ত হয়েই থাকতেন, তবে হয়তো ঘটনাটি তাঁর অশ্রুজলেই সমাপ্ত হত। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাল্মীকি তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বলে এই লৌকিক শোককে ব্যক্তি সম্পর্ক-বর্জিত লোকোত্তরতা দান করায় সেই শোকই অলৌকিক রসমূর্তি পরিগ্রহ করে।


করুণ রসের মূলে লৌকিক শোকের কারণ থাকলেও তা যে পরিণামে আনন্দদায়ক হয়, এ বিষয়ে সব দেশেরই রসপ্রমাতাগণ অভিন্নমত পোষণ করেন। দার্শনিকোত্তম আরিস্তোতল্ ট্র্যাজিডি-আলোচনা-প্রসঙ্গে যে ‘ক্যাথারসিস' (Catharsis) বা 'পারগেশানে'র (Purgation) কথা বলেছেন, সেখানেও আনন্দের সঙ্কেত রয়েছে। তাঁর মতে ‘ভীতি' বা 'করুণা'র মিশ্রণে যে 'ক্যাথারসিস্' বা মোক্ষণ ঘটে, তাঁকে 'ট্র্যাজিক প্লেজার' বলে অভিহিত করা চলে। কবি শেলীও বলেছেন যে, মানুষের আত্মার ভিতর যে জৈবিক সত্তা এবং অন্তরতম সত্তার দুই ভাগ থাকে, তাদের সামস্য থেকেই সৃষ্টি হয় আনন্দের আর তীব্রতম দুঃখই মহত্তম আনন্দের কারণ ("Our sweetest songs are those that tell of saddest thought”)। ফর্তে বলেন, দুঃখের ও আনন্দের মধ্যে হেতুগত কোনো পার্থক্য নেই—এই দু'টির অনুভূতির মধ্যে রয়েছে একটি সূক্ষ্ম মায়াযবনিকার ‘অন্তরাল' মাত্র এমনকি সংশয়বাদী শোপেনহাওয়ারও বলেন যে কাব্যপাঠের ফলে প্যাশনের বড় দুঃখ ও ভীতির অসহনীয় চাপের উপশম ঘটে, অহং চেতনা বিলুপ্ত হয় ও সর্বোপরি লাভ হয় আনন্দ।



নয়টি রস কীভাবে নয়টি ভাব থেকে জাত হয়?

বহির্ভগৎ কিংবা অন্তর্জগতের নানারূপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের মনে যে বিচিত্র চিত্তবৃত্তি বা ‘ইমোশনে’র সৃষ্টি করে তাদের বলা হয় 'ভাব'। মনের লৌকিক ‘ডাব’ অসাধারণ কবি-প্রতিভার স্পর্শে কাব্যে অলৌকিক রসমূর্তি লাভ করে থাকে।


আচার্য ভরত এদের সংখ্যা বলেছিলেন আট, কিন্তু 'সাহিত্যদর্পণ' কার এ সঙ্গে ‘শম' যোগ করে মোট প্রধান ভাবের সংখ্যা নির্ণয় করেছেন নয়টি—"রতিহাসশ্চশোকশ্চ ক্রোধোৎসাহৌ ভয়ং তথা। জগুপ্সা বিস্ময়শ্চেখমষ্টো প্রোত্তাঃ শমোঽপি চ।' আচার্য অভিনবগুপ্ত বলেন, “ভাবরূপ চিত্তবৃত্তির মধ্যে যে ভাব মনে বহুলরূপে প্রতীয়মান হয়, সেটি স্থায়ীভাব।" এই হিসেবে এবং নয়টি ভাবকেই ‘স্থায়ীভাব' রূপে অভিহিত করা হয়। এই স্থায়ীভাবগুলিই কাব্যের বিভাব-অনুভাব-আদির সহায়তায় নয়টি রসে পরিণত হয়—রতিভাব শৃঙ্গার রসে, হাস্যভাব হাস্যরসে, শোকভাব করুণ রসে, ক্রোধভাব রৌদ্ররসে, উৎসাহভাব বীররসে, ভয়ভাব ভয়ানক রসে, জগুদা ভাব বীভৎস রসে, বিস্ময়ভাব অদ্ভুতরসে এবং শমভাব শান্তরসে পরিণতি লাভ করে।