বাণভট্ট-রচিত 'কাদম্বরী' কাহিনীর বিষয়বস্তু; একালের উপন্যাসের সঙ্গে এজাতীয় রচনার পার্থক্য এবং সমস্ত 'কাদম্বরী' কাব্য একটি চিত্রশালা; পত্রলেখা ও মহাশ্বেতা এবং 'কাদম্বরী'র রচনারীতির বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় রচিত সুপ্রাচীন বৈদিক সাহিত্যেই সার্থক গদ্যরচনার যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া গেলেও লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যে তার আবির্ভাব অনেকটাই বিলম্বিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কাব্য-মহাকাব্য আদি সমুদ্র দ্বারাই যেন গদ্যের সামান্য ভূভাগ বেষ্টিত ছিল। গদ্যকাব্য রচয়িতাদের মধ্যে দণ্ডী, সুবন্ধু এবং বাণভট্ট এই তিনটি মাত্র নামই স্মৃতিতে সতত বিরাজমান, অপরদের নাম চেষ্টা করে আনতে হয়। এঁদের মধ্যেও বাণভট্ট রচিত 'কাদম্বরী' নামক কথা জাতীয় গদ্যকাব্যটিই সমকালে এবং পরবর্তীকালে শ্রেষ্ঠ গদ্যের নিদর্শনরূপে কীর্তিত হয়ে আসছে।


(ক) গদ্যকাব্য দ্বিবিধ—'আখ্যায়িকা' এবং 'কথা'। ঐতিহাসিক কাহিনী অথবা বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয় 'আখ্যায়িকা' এবং লেখক স্বীয় কল্পনার সাহায্যে রচনা করেন 'কথা'। বাণভট্ট উভয়জাতীয় গদ্যকাব্যই রচনা করেছেন—'হর্ষচরিত’ তাঁর রচিত ও সংস্কৃত ভাষার একমাত্র ‘আখ্যায়িকা কাব্য' এবং 'কাদম্বরী' বাণভট্ট-রচিত 'কথা' জাতীয় গদ্যকাব্য। তুলনামূলক বিচারে 'কাদম্বরী’র শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিতভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 'কাদম্বরী' কাহিনী লেখকের স্বকল্পিত এবং বড়ই জটিল; একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্প তার মধ্যে আরেকটি গল্প এইভাবে যেন গল্পের লহর চলেছে।


(খ) 'কাদম্বরী’ বাণভট্ট রচিত কথা-জাতীয় গদ্যকাব্য, এর কাহিনী কবিকল্পিত এবং গদ্যে রচিত। অতএব আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক কালের উপন্যাসের সঙ্গে এর একটা সহজ সাদৃশ্য চোখে পড়ায়। কেউ কেউ 'কাদম্বরী'কে সংস্কৃত সাহিত্যের উপন্যাসরূপে অভিহিত করতে চান। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে 'কাদম্বরী'র এই উপন্যাস লক্ষণ দর্শনেই সম্ভবত মারাঠী ভাষায় 'উপন্যাস' তথা ইংরেজি Novel-এর প্রতিশব্দরূপে 'কাদম্বরী' শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যাহোক, 'কাদম্বরী'র সঙ্গে একালের উপন্যাসের সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাঁর ‘সংস্কৃত সাহিত্যের পরিচয়’ গ্রন্থে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা উদ্ধৃত করা হল। তিনি বলেন, “কাদম্বরী পাঠে অনেকেই অতি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন, ‘কাদম্বরী’ কি উপন্যাস? প্রশ্নটি একটু বিচার করে দেখা প্রয়োজন। উপন্যাস সাহিত্যের উদ্ভব বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যদিও আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে রচিত জাপানের ‘গেঞ্জি মোনোঙ্গাতারি' নামক একটি গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা হয়ে থাকে, তবুও প্রকৃত উপন্যাসকে একালের সামগ্রী বলেই মেনে নিতে হয়। এ বিষয়ে সর্বজনমান্য সাহিত্যতত্ত্বজ্ঞ Ralph Fox-এর অভিমতটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর The Novel and the People গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছেন, 'The Novel is the epic form of our modern bourgeois society. It did not except in very rudimentary form before that modern civilisation which began with the renaissance and like every new art form it have served its purpose of extending and deepening consciousness' | কাজেই একটা জাতির জীবনে নবজাগৃতির সূচনার জন্য উপন্যাস থাকে অপেক্ষিত এবং এ-জাতীয় জাগৃতি শুধু একালের সমাজ-পরিবেশেই সম্ভবপর। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ও সমাজ সচেতনতা ব্যতীত এ জাতীয় নবজাগৃতি সম্ভব নয় এবং এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত থাকে গভীর জীবনজিজ্ঞাসা। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে এ জাতীয় জীবন-জিজ্ঞাসার কথা কল্পনাই করা সম্ভবপর নয় বলেই প্রাগাধুনিক যুগে উপন্যাস সাহিত্যের আবির্ভাবও অকল্পনীয়। কিন্তু সদ্য-কথিত জীবন-জিজ্ঞাসা-ব্যতীত উপন্যাসে অপর যে সকল উপাদানের প্রয়োজন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু অল্পাধিক পরিমাণে ‘কাদম্বরী’, ‘দশকুমারচরিত’ এবং ‘বৃহৎকথা’র কোনো কোনো কাহিনীতে বর্তমান থাকায় শিথিল উক্তিতে এই কাব্যগুলিকে ‘উপন্যাস’ অথবা ‘উপন্যাস জাতীয় কাব্যের’ মর্যাদা দান করা যায়। সাধারণভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সব কাহিনীই ধর্মাশ্রয়ী, অসম্ভব অবস্তু রাজ্যের বিষয় সমৃদ্ধ এবং অতিপ্রাকৃতধর্মী, কিন্তু এদের মধ্যে ব্যতিক্রমরূপে গৃহীত হতে পারে ‘কাদম্বরী' এবং অপর কোনো কোনো কাহিনী—যাদের মূল ভাবটি মৃত্তিকাসম্ভব এবং লৌকিক জীবনাশ্রয়ী। কাহিনী-ব্যতীত চরিত্র সৃষ্টির দিক থেকেও ‘কাদম্বরী'র ঔপন্যাসিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণই রয়েছে, বলতে হয়। কাব্যের প্রধান চরিত্র–চন্দ্রাপীড়, বৈশম্পায়ন, মহাশ্বেতা এবং কাদম্বরী—শুধু আদর্শ-রূপেই বন্দিত নয়, এগুলি সু-অঙ্কিত এবং পরিপূর্ণও বটে। এই মহাগ্রন্থের একটি অপেক্ষাকৃত গৌণ চরিত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা চলে—এটি ‘পত্রলেখা' চরিত্র। গ্রন্থে অনেক কয়টি কাহিনী থাকলেও পত্রলেখা কোনো কাহিনীর নায়িকা নয়। স্বর্গ থেকে স্বয়মাগতা চন্দ্রপ্রিয়া রোহিণীই রাজা চন্দ্রাপীড়ের তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী পত্রলেখারূপে আবির্ভূত হয়। পত্রলেখা চন্দ্রাপীড়ের দিগ্বীজয় কালেও ছিলেন সঙ্গিনী। চন্দ্রাপীড়ের প্রতি কাদম্বরীর প্রণয়ের কথা পত্রলেখাই প্রকাশ করেছিলেন। কাহিনীতে পত্রলেখার কোনো মুখ্য ভূমিকা নেই অথচ তৎসত্ত্বেও চরিত্রটির আকর্ষণ এত প্রবল যে রবীন্দ্রনাথও মনে করেন যে, চরিত্রটি 'কাব্যে উপেক্ষিতা' হয়ে রইলেন। একটি অপ্রধান চরিত্রেরও এই আকর্ষণযোগ্যতা নিশ্চয়ই এর মাহাত্ম্যেরই প্রকাশক। বস্তুত কালোচিত বিচারে 'কাদম্বরী' যে উপন্যাস নামে অভিহিত হয়ে থাকে তার যাথার্থ্য মেনে নেওয়াই সঙ্গত। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও 'কাদম্বরী'কে উপন্যাসের স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন: “সংস্কৃত সাহিত্যে গদ্যে যে দুই-তিনখানি উপন্যাস আছে তাহাদের মধ্যে 'কাদম্বরী' সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে।" এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে বাঙলা এবং অপর কোনো কোনো ভারতীয় ভাষায় ইংরেজি ‘Novel' শব্দের প্রতিশব্দরূপে ‘উপন্যাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হলেও মারাঠী এবং সম্ভবত আরও কোনো কোনো ভাষায় উপন্যাসের স্থলবর্তী শব্দটি হল 'কাদম্বরী'। 'কাদম্বরী'র ঔপন্যাসিকত্ব-বিষয়ে সাধারণভাবে ভারতীয় মনোভাবের পরিচয় এ থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।


(গ) চিত্ৰধর্মিতা : সমস্ত ‘কাদম্বরী' কাব্য একটি চিত্রশালা। 'কাদম্বরী' কাব্য-বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে এটিই তার সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় প্রশংসোক্তি-রূপে বিবেচিত হয়। অথচ ‘কাদম্বরী' একটি 'কথা'-জাতীয় গদ্যকাব্য, একালের বিচারে একটি উপন্যাস-প্রতিম রচনা, প্রধান আকর্ষণ ছিল তার কাহিনী। 'কাদম্বরী'তেও একটি কাহিনী আছে, না বলে বরং বলা চলে যে 'কাদম্বরী'তে কাহিনীর ভিতর থেকে আবার কাহিনী—এইভাবে কাহিনী লহর চলেছে। এতে বেশ কয়েকটি উৎকৃষ্ট এবং পরিপূর্ণ চিত্রও রয়েছে, যাদের আকর্ষণযোগ্যতা সন্দেহাতীত; এমনকি নায়িকা না হয়েও এমন পার্শ্বচরিত্র রয়েছে, যার আকর্ষণ এত দুর্বার যে, তার প্রতি সুবিচার করা হয়নি বলে রবীন্দ্রনাথ চরিত্রটিকে ‘কাব্যে উপেক্ষিতা' বলে অভিযোগ করেছেন। ঘটনার ঘনঘটায় পাঠক-মনকে আচ্ছন্ন হতে হয় বহুবারই। অর্থাৎ সাধারণভাবে বলা যায়, উপন্যাসধর্মী রচনার অধিকাংশ লক্ষণই 'কাদম্বরী'তে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তার প্রশংসার সিংহভাগটি অধিকার করেছে এর অপর একটি গুণ যাকে বলা হয়—‘চিত্রধর্মিতা'। 'কাদম্বরী'র এই বিশেষ গুণ বা লক্ষণটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেকালের আলঙ্কারিক সমালোচকদের কেউ নন, একালের সৃজনধর্মী কবি ও চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বাণভট্টের ‘কাদম্বরী' পাঠে তার চিত্রসম্পদ-দর্শনে মুগ্ধ হয়ে সোৎসাহে এর বিস্তৃত পরিচয় দান প্রসঙ্গে যা’ বলেছেন, তার কিছুটা উল্লেখ করা প্রয়োজন। কারণ উপন্যাসের সমালোচনা যেভাবে করা হয়, রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য ক্ষেত্রে তা থেকে সরে গিয়ে শুধু তার চিত্ররচনা কুশলতার ওপরই গুরুত্ব দান করেছেন, উপন্যাসের অপরাপর লক্ষণ এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, 'বাণভট্ট যদিচ স্পষ্টত গল্প করিতে বসিয়াছেন, তথাপি ভাষার বিপুল গৌরব লাঘব করিয়া কোথাও গল্পকে দৌড় করান নাই; সংস্কৃত ভাষাকে অনুচর-পরিবৃত সম্রাটের মতো অগ্রসর করিয়া দিয়া গল্পটি তাহার পশ্চাতে প্রচ্ছন্নভাবে ছত্র বহন করিয়া চলিয়াছে মাত্র। ভাষায় রাজমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য গল্পটির কিঞ্চিৎ প্রয়োজন আছে বলিয়াই সে আছে, কিন্তু তাহার প্রতি কাহারও দৃষ্টি নাই।... কাদম্বরীর মুখ্যগৌণ, ছোটবড়ো কোনো কথাকেই কিছুমাত্র বঞ্চিত করিতে চাহেন নাই। তাহাতে যদি গল্পের ক্ষতি হয়, মূল প্রসঙ্গটি দূরবর্তী হইয়া পড়ে, তাহাতে তিনি বা তাঁহার শ্রোতারা কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহেন— তথাপি কথা কিছু বাদ দিলে চলিবে না—কারণ কথা সুনিপুণ, বড়ো সুশ্রাব্য, কৌশলে মাধুর্যে ধ্বনিতে ও প্রতিধ্বনিতে পূর্ণ। .....রঙ্ ফলাইতে কবির কী আনন্দ। যেন শ্রান্তি নাই, তৃপ্তি নাই। সে রঙ্ শুধু চিত্রপটের রঙ্ নহে, তাহাতে কবিত্বের রঙ্, ভাবের রঙ্ আছে, অর্থাৎ কোন জিনিষের কী রঙ শুধু সেই বর্ণনামাত্র নহে, তাহার মধ্যে হৃদয়ের অংশ আছে। সংস্কৃত কবিদের মধ্যে চিত্রাঙ্কনে বাণভট্টের সমতুল্য কেহ নাই, এ কথা আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি। সমস্ত 'কাদম্বরী' কাব্য একটি চিত্রশালা। সাধারণত লোকে ঘটনা বর্ণনা করিয়া গল্প করে বাণভট্ট পরে পরে চিত্র সজ্জিত করিয়া গল্প বলিয়াছেন—এজন্য তাঁহার গল্প গতিশীল নহে, তাহা বর্ণচ্ছটায় অঙ্কিত। চিত্রগুলি যে ঘনসংলগ্ন ধারাবাহিক তাহা নহে; এক একটি ছবির চারিদিকে প্রচুর কারুকার্যবিশিষ্ট বাহু বিস্তৃত ভাষায় সোনার ফ্রেম দেওয়া, ফ্রেমসমেত সেই ছবিগুলির সৌন্দর্য আস্বাদনে যে বঞ্চিত সে দুর্ভাগা।”


চিত্রধর্মিতাই যে 'কাদম্বরী' কাব্যের প্রধান গুণ, এ কথা একালের অপর সকল সমালোচকদের মতোই রবীন্দ্রনাথও নিঃসন্দিগ্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। এমনকি, 'কাদম্বরী' কাব্যের সমাসবহুল দুরুচ্চার্য যে গম্ভীর ভাষা অনেকের নিকট নিন্দিত হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ চিত্রসৃষ্টি এবং রং ফলানোর পক্ষে তার উপযোগিতার কথাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে নিয়েছেন। বাণভট্ট 'কাদম্বরী'র জন্য চিত্র-সৃষ্টির জন্য তাঁর চিত্তলোককে কল্পলোকে রূপান্তরিত করেছিলেন; তারই ফলে সেখান থেকে যে চিত্ররাজি সমগ্র 'কাদম্বরী' জুড়ে বিরাজ করছে, তাদের একালের ভাষায় বহুবর্ণময় চলচ্চিত্রের সঙ্গেই তুলিত করা চলে। এর বর্ণবৈভবের বুঝি কোনো তুলনা নেই। মণিময় রাজহর্মের মণিকুট্টিম-ই হোক্ কিংবা ঋষির পাতা-ছাওয়া কুটিরই হোক্, কিংবা ঋষির আশ্রমে পেখম-তোলা ময়ূরের নাচই—যখন যে চিত্রটি তাঁর চোখে পড়েছে, সেটিকে তিনি রঙে-রসে অপূর্ব করে তুলেছেন। তপোবনের বৃক্ষরাজির ওপর দিয়ে অগ্নিহোত্রের যে ধুমলেখা উদ্‌গত হচ্ছে, তার রংটি রাসভ-রোম-ধূসর; আকাশ-গঙ্গায় ছড়িয়ে যাওয়া একরাশ পাতার মতোই হরিৎ-বর্ণ শুকপাখিগুলি উড়ে গেলো; শিমূলের সাদা তুলো উড়ে যাচ্ছে, যেন সূর্যের অশ্বদের কা বেয়ে পড়ছে সাদা ফেনা; ঊর্ধ্ববাহু নটরাজের মতো সহস্র বাহু ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাল্মলী তরু; শুষ্কদেহ জাবালি মুনির বুকে শোভমান পৈতাগাছি যেন গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া পদ্মডাটার সুতো; সূর্যদেব টুপ করে ডুবে গেলেন যেন দিনলক্ষ্মীর পায়ের চুনির নূপুরটি খসে পড়লো।


বাণভট্ট যা’ কিছু বলছেন, তাকেই একটা ছবির মতো করে ফুটিয়ে তুলছেন। কিন্তু একই ছবিকে তিনি দুবার ব্যবহার করছেন না – এক চাঁদ ওঠাকেই তিনি কতবার কতরকমভাবে ব্যবহার করেছেন। মর্ত্যলোকের পম্পাসরোবর আর দিব্যলোকের অচ্ছোদ সরোবরকে তিনি ভিন্ন ভিন্নভাবে রূপায়িত করেছেন। তপোবনের সূর্যাস্ত সন্ধ্যা, হেমকূটের সূর্যাস্ত-সন্ধ্যা এবং উজ্জয়িনীর সূর্যাস্ত সন্ধ্যা—তিনটির ভিন্ন ভিন্ন রূপ। বর্ণনার এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে দুর্লভ। জাবালি মুনির বুকে পৈতাগাছির বিবরণটিই দেখা যাক— বালি ঠাকুরের মুখখানি এইরকম : বড়ই রোগা, তাই গাল দুটি তুবড়ে গর্ত হয়ে গেছে। চোয়াল এবং নাকটি যেন আরও উঁচু হয়ে গেছে। চোখের তারা ঘোরালো। চোখের পাতা খসে খসে ফাঁক ফাঁক হয়ে গেছে। লম্বা লম্বা লোম বেরিয়ে এসে কানের ফুটো বন্ধ। নাভিকুণ্ডল পর্যন্ত ঝাঁকড়া দাড়ি। শরীরটি কি পবিত্র। যেন মন্দাকিনীর ধারা। তার উঁচু উঁচু ফাঁক ফাঁক হাড়-পাঁজরার ওপর দিয়ে কাঁধ থেকে নেমে আসা ধপধপে পৈতেটি যেন একটি তাজা পদ্মডাঁটার সুতো, ভাসছে হাওয়ায় হাওয়ায় ছোট ছোট ঢেউ-ভাঙা মন্দাকিনীর জলে।” দেবী মহাশ্বেতাকে সঙ্গে নিয়ে চন্দ্রাপীড় প্রবেশ করলেন গন্ধর্বরাজের অন্তঃপুরের দ্বারমুখে, উদ্দেশ্য—কাদম্বরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী যে অবস্থায় দেখতে পেলেন চন্দ্রাপীড় তার একটু নিদর্শনঃ “শুধু মেয়ে আর মেয়ে। চন্দ্রাপীড় দেখল, তাদের মুখের ছটায় চারদিকে যেন চাঁদবৃষ্টি হচ্ছে। তাদের (দীঘল নয়নের) বঙ্কিম চাহনিতে মাটিতে যেন দুলে দুলে উঠছে নীলপদ্মের বন। তাদের বল্লরীহেন ভূর অগোপন বিলাসে যেন হাজারো খেলায় মেতেছে কামধেনু। তাদের ঈষৎ হাসির ঝলকানিতে যেন ঘুরছে পাপড়ি মেলা ফুলে ধবধবে এক ঝাঁক বসন্তের দিন। তাদের নিশ্বাস-বায়ুর সৌরভে ঘুরে ঘুরে বইছে যেন ঝলক ঝলক মলয় বাতাস। নিচোল সুডৌল ঝকমকে গালে যেন চিকচিকিয়ে উঠছে হাজার হাজার মাণিকের আয়না।” বস্তুত, ‘কাদম্বরী'র চিত্রসম্পদের যথার্থ নিদর্শন দিতে গেলে প্রায় সমগ্র গ্রন্থটিই তুলে ধরতে হয়। শুধু চিত্র সাজিয়ে কাহিনী রচনার অনুরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অপর কোনো ভাষার সাহিত্যে আছে কিনা সন্দেহ।


(ঘ) পত্রলেখা : উজ্জয়িনীরাজ তারাপীড় কুলুত জয় করে তথাকার রাজকন্যা পত্রলেখাকে নিয়ে এলেন রাজপুরীতে। রাজমহিষী বিলাসবতী তাকে কন্যা-নির্বিশেষে প্রতিপালন করে তাকে রাজপুত্র চন্দ্রাপীড়ের তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী করে দিলেন এবং বলে দিলেন, রাজপুত্র তার সঙ্গে যেন প্রিয়সখীর মতো ব্যবহার করেন। তদবধি পত্রলেখা চন্দ্ৰাপীড়ের অভিন্নহৃদয়া সখীর স্থান অধিকার করে। এই সখীত্বের মধ্যে কোনো আড়াল ছিল না। উভয়ের প্রথম সাক্ষাৎ মুহূর্তে থেকেই পত্রলেখা সেবারসসমুপজানন্দা হয়ে দিবারাত্রি নির্বিশেষে উপবেশনে উত্থানে ভ্রমণে ছায়ার মতো চন্দ্রাপীড়ের নিত্যসঙ্গিনী। তার দৈনন্দিন জীবনের এবং সমস্ত বিশ্বাসকার্যে চন্দ্ৰাপীড় পত্রলেখাকে আত্মহৃদয় থেকে অতিরিক্ত মনে করতেন। নারীর সঙ্গে পুরুষের এই সম্বন্ধের মধ্যে লজ্জাবোধহীন অসঙ্কোচ যে সম্পর্ক, তা’ একান্তভাবে সৌহার্দ্যের ওপরই নির্ভরশীল, অনঙ্গ দেব এদের মধ্যে কখনও প্রবেশের অধিকার পাননি। তাদের এই পারস্পরিক সম্বন্ধটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন : “এই আখ্যায়িকায় পত্রলেখা যে সুকুমার সম্বন্ধসূত্রে আবদ্ধ হইয়া আছে সেরূপ সম্বন্ধ আর কোনো সাহিত্যে কোথাও দেখি নাই। অথচ কবি অতি সহজে সরলচিত্তে এই অপূর্ব সম্বন্ধ বন্ধনের অবতারণা করিয়াছেন, কোনোখানে এই ঊর্ণাতন্তুর প্রতি এতটুকু টান পড়ে নাই যাহাতে মুহূর্তের জন্য ছিন্ন হইবার আশঙ্কামাত্র ঘটিতে পারে।'


অথচ অবকাশ প্রচুর ছিল। চন্দ্রাপীড় দিগ্‌বিজয়ে বেরিয়েছেন, হস্তিপৃষ্ঠে চন্দ্রাপীড়ের সম্মুখে আসীনা পত্রলেখা। শিবিরে চন্দ্রাপীড় যখন নিজ শয্যার অদূরেই সখা বৈশম্পায়নের সঙ্গে আলাপরত, তখন নিকটেই ক্ষিতিতলে নিঃশঙ্ক পত্রলেখা সুযুপ্তা। এমনকি চদ্ৰাপীড় যখন কাদম্বরীকে বধুরূপে গ্রহণ করেছেন, তখনও পত্রলেখা এবং কাদম্বরী পরস্পরকে সহজভাবেই সখীরূপে গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে কোনো ঈর্ষা, সঙ্কট, সংশয় বা বেদনা ছিল না। কিন্তু হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল, কারণ চন্দ্রাপীড় যেমন পূর্বজন্মে ছিলেন দেবচন্দ্রমা, পত্রলেখাও তেমনি ছিলেন চন্দ্রমার অন্যতমা প্রেয়সী রোহিণী, অথচ কবি বাণভট্ট পত্রলেখাকে সেই প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে রাখলেন। পত্রলেখাকে আর আমরা বধূরূপে দেখতে পেলাম না, কবি তাকে শুধু সেবাপরায়ণা করেই রাখলেন। কিন্তু পত্রলেখাকে সমগ্র হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করবার মতো যাবতীয় রূপগুণই তো তার ছিল। কিন্তু কবিদের স্বভাবই বুঝি এই – “কঠিন-হৃদয় কবি তাঁহার নায়ক-নায়িকার জন্য যত অক্ষয় প্রতিমা গড়িয়া নির্মমচিত্তে বিসর্জন দেন।” কবি বাণভট্ট যাবতীয় রূপ-রস দিয়ে পত্রলেখাকে সৃষ্টি করে নির্মমচিত্তে বিসর্জন দিয়েছেন। তাই রবীন্দ্রনাথও বড় দুঃখেই বলেছেন: “আমরা বলিব কবি অন্ধ। কাদম্বরী ও মহাশ্বেতার দিকেই ক্রমাগত একদৃষ্টে চাহিয়া তাঁহার চক্ষু ঝলসিয়া গিয়াছে, এই ক্ষুদ্র বন্দিনীটিকে (পত্রলেখাকে) তিনি দেখিতে পান নাই। ইহার মধ্যে যে প্রণয়-তৃষ্ণার্ত চিরবঞ্চিত একটি নারীহৃদয় রহিয়া গেল, সে-কথা তিনি একেবারে বিস্মৃত হইয়াছেন।” তিনি আরও বলেন, “কাদম্বরী পড়িয়া কেবলই মনে হয় অন্য সমস্ত নায়িকার কথা অনাবশ্যক বাহুল্যের সহিত বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু পত্রলেখার কথা কিছুই বলা হয় নাই।” পত্রলেখা কাব্যে উপেক্ষিতা হয়েই রইলো।


মহাশ্বেতা : উজ্জয়িনীরাজ তারাপীড়ের পুত্র চন্দ্রাপীড় একবার প্রিয়সখা বৈশম্পায়ন ও প্রিয়সখী পত্রলেখাসহ সৈন্যদল নিয়ে দিগ্‌বিজয়ে বেরুলেন। তিন বৎসর পর কৈলাসের নিকটবর্তী কিন্নর রাজ্য জয় করে একদিন চন্দ্রাপীড় একাকী তার ইন্দ্রায়ূধে চড়ে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেললেন। সেখানে অচ্ছোদসরোবর তীরে বিশ্রাম গ্রহণকালে অকস্মাৎ সঙ্গীতধ্বনি শুনে তার অনুসরণে তিনি নিবিড় বনমধ্যে এক শিবমন্দিরে এসে দেখতে পেলেন অসাধারণ শ্বেতবর্ণা দিব্যদর্শনা কিন্তু তপঃক্রিষ্টা এক লাবণ্যবতী রমণীকে। চন্দ্রাপীড় তার পরিচয় জানতে চাইলে সেই রমণী জানালেন তার দুঃখময় জীবন কথা।


গন্ধর্বরাজ হংস ও রাণী অপ্সরা গৌরীর কন্যা এই নারী, নাম তার মহাশ্বেতা। একদিন এই অচ্ছোদসরোবর তীরভূমি অনাস্বাদিতপূর্ব এক দিব্য সৌরভে আমোদিত হলে সেই সৌরভের উৎসসন্ধানে কুতূহলী মহাশ্বেতা আবিষ্কার করলেন পারিজাত কুণ্ডলধারী পুণ্ড্ররীক এবং তার বন্ধু কপিঞ্জলকে। প্রথম দর্শনেই পুণ্ডরীক ও মহাশ্বেতা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন। পারিজাতমঞ্জরীর প্রতি মহাশ্বেতার আগ্রহ বুঝতে পেরে পুণ্ডরীক ঐ মঞ্জরীটি মহাশ্বেতার কানে পরিয়ে দিতে গেলে পুণ্ডরীকের হাত থেকে জপের মালাটি পড়ে গেল। মহাশ্বেতা সেটি ধরে ফেলে নিজের গলায় পরিয়ে নিলেন। কিন্তু পুণ্ডরীক তা ফেরত চাইলে মহাশ্বেতা নিজের একাবলী হারটি তার হাতে তুলে দিলেন। মহাশ্বেতা বাড়ি ফিরে আসবার পর সখী তরলিকার হাত দিয়ে পেলেন পুণ্ডরীকের প্রেমপত্র। সন্ধ্যায় জপমালা ফেরত চাইবার ছলে কপিঞ্জল এসে জানালেন যে মহাশ্বেতার বিরহে পুগুরীকের প্রাণসংশয়, অতএব তিনি যেন তার বন্ধুর প্রাণ রক্ষা করেন। সেই রজনীতেই মহাশ্বেতা তরলিকাকে নিয়ে অচ্ছোদসরোবর-তীরে উপনীত হয়ে দেখলেন পুণ্ডরীক তার দেওয়া হারটি বুকে নিয়ে পড়ে আছেন, দেহ প্রাণহীন, কপিঞ্জল বিলাপরত। সহমরণের সঙ্কল্প করে তরলিকাকে মহাশ্বেতা চিতা সাজাতে বললে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটলো। চন্দ্রমণ্ডল থেকে অকস্মাৎ এক দিব্যপুরুষ এসে পুশুরীকের দেহ নিয়ে চলে গেল। বলে গেল, মহাশ্বেতা, দেহত্যাগ করো না, পুণ্ডরীকের সঙ্গে তোমার আবার মিলন হবে। কপিঞ্জলও ঐ দিব্যপুরুষকে অনুসরণ করলো। তদারধি মহাশ্বেতা এখানেই অবস্থান করছেন।


মহাশ্বেতার অনুরোধে চন্দ্রাপীড় গন্ধর্বরাজকন্যা কাদম্বরীর সঙ্গে আলাপ করে তার প্রতি প্রণয়াসক্ত হন। এবং পরবর্তী সুদীর্ঘ অংশ প্রধানত এঁরা দুজনেই অধিকার করে রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত দৈবঘটনাধীন মৃত চন্দ্ৰাপীড় জীবিত হয়ে ওঠেন এবং পুণ্ডরীকও চন্দ্রলোক থেকে নেমে আসেন। অতঃপর কাদম্বরী-চন্দ্রাপীড় এবং মহাশ্বেতা-পুশুরীকের মিলন সাধিত হল।


কাহিনীর নায়ক-নায়িকা চন্দ্রাপীড়-কাদম্বরী হলেও কবি-হৃদয়ের সহানুভূতি উপচে উঠেছে পুণ্ডরীক-মহাশ্বেতার প্রেমকাহিনী রচনায়। মহাশ্বেতার মতো চরিত্রের দীপ্তি নিয়ে উদ্ভাসিত এমন নারীচরিত্রের দর্শন দুর্লভ। তার পূর্ণ নিটোল চরিত্র সকলের শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আকর্ষণ করে। মহাশ্বেতা যেন কবির হৃদয়সমুদ্র মথিত করে আবির্ভূত হয়েছে অমৃত-স্বরূপিণী হয়ে। তাই অনেকে মনে করেন, কাদম্বরী কাব্যের দু'টি মহল আছে, তার বাইরের মহলের নায়িকা কাদম্বরী, আর অন্দরমহলের নায়িকা মহাশ্বেতা।


(ঙ) সংস্কৃত ভাষায় রচিত উল্লেখযোগ্য গদ্যকাব্যের সংখ্যা সামান্য কটি মাত্র এবং তাদের লেখকদের মধ্যে রয়েছেন দণ্ডী, সুবন্ধু এবং বাণভট্ট। এঁরা সকল কালিদাসোত্তর সমৃদ্ধি যুগের প্রায় সমকালীন কবি। এঁদের মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ বাণভট্ট ছিলেন স্থান্বেশ্বরাধিপতি হর্ষবর্ধন শিলাদিত্যের সভাকবি, সমবয়সী এবং বিশিষ্ট বন্ধু। বাণভট্ট হর্ষদেবের কাহিনী অবলম্বনে রচনা করেন 'হর্ষচরিত'—মনে হয়, কোনো কারণে গ্রন্থটি তিনি সমাপ্ত করেননি। তাঁর অপর রচনা নিজস্বকাহিনী অবলম্বনে 'কাদম্বরীই তাঁর এবং সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গদ্যকাব্য-রূপে স্বীকৃত। এই গ্রন্থটি তিনি শেষ করতে পারেন নি, বাণ-পুত্র ভূষণবাণ তথা পুলিন্দ গ্রন্থটির সমাপ্তি দান করেন। কেউ কেউ মনে করেন, গ্রন্থে বর্ণিত মূল কাহিনীর বীজরূপটি সম্ভবত বাণ গুণাঢ্য-রচিত 'বৃহৎকথা' ('বড্ডকহা) থেকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তা হলেও এতে যেমন কাহিনীর ভিতর কাহিনী, তার ভিতর আবার কাহিনীর অবতারণা করে যে জটিল জটাজাল বিস্তার করে তাকে শেষ পর্যন্ত যথাযোগ্যভাবে সংহত করেছেন, তাঁর কৃতিত্ব সবটুকুই তাঁর প্রাপ্য। এর মূল কাহিনী চন্দ্রাপীড় ও কাদম্বরীর এবং পার্শ্বকাহিনী চন্দ্রাপীড়-বান্ধব পুণ্ড্ররীক ও মহাশ্বেতার। গ্রন্থকার অপূর্ব কৌশলে চন্দ্রাপীড় এবং পুশুরীকের তিনজন্মের কাহিনীকে একসূত্রে গেঁথে তুলেছেন, ফলত এর পরিণামৌৎসুক্য (suspense) পাঠককে শেষপর্যন্ত মোহগ্রস্ত করে রাখতে পারে।


ভাষা ব্যবহার ও যুগপ্রবণতা : সম্ভবত তৎকালোচিত রীতি অনুযায়ী গদ্যকাব্যমাত্রই অতিশয় শুরু-গম্ভীর গুরুচ্চার্য সমাসাকীর্ণ শব্দভারে গৌরবান্বিত হত – দণ্ডী, সুবন্ধু এবং বাণভট্ট—এই তিনজনের কাব্যেই এই বিশেষ দোষটির প্রতি পাশ্চাত্ত্য সমালোচকগণ বিশেষভাবে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই দোষটিকেই গুণরূপে প্রতিপন্ন করেছেন এই বলে যে বাণভট্ট তাঁর 'কাদম্বরী' কাব্যে যে অপূর্ব চিত্রসম্পদ রচনা করেছেন, তার এই ভাষাই ছিল তার যথাযোগ্য বাহন। 'কাদম্বরী’র এই ভাষাই 'মাধুর্যে, গাম্ভীর্যে, ধ্বনিতে, প্রতিধ্বনিতে শুধু চিত্রেরই রঙ ফলায় নি, তাতে হৃদয়ের রওে স্পর্শ লেগেছে। পাশ্চাত্ত্য গবেষক ও পণ্ডিত Weber ‘কাদম্বরী'র ভাষা ব্যবহারকে লক্ষ্য করে তাকে ‘Indian wood' আখ্যা দিয়েছিলেন, ভারতীয় মনীষী ড. দে তার উত্তরে বলেছেন, "But it should not be forgotten that richness of vocabulary, wealth of description, frequency of rhe torical ornaments, length of compounds and elaborateness of sentence, a grandiose pitch of sound and sense are common feature of the Prose Kavya." অর্থাৎ সমকালীন যুগরুচির প্রয়োজনেই বাণভট্ট তাঁর গদ্যকাব্য ‘কাদম্বরী'র ভাষাকে এমন আড়ম্বরপূর্ণ করে তুলেছিলেন।


পাঞ্চালী রীতি : বাণভট্টের ভাষায় একদিকে গৌড়ীরীতির শব্দাড়ম্বর থাকলেও বৈদভী রীতির প্রসাদ এবং মাধুর্য গুণবর্জিত ছিল না, তবে আসলে তিনি ছিলেন পাঞ্চালী রীতির কবি। প্রয়োজনবোধে তিনি অতিশয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যেও তাঁর বক্তব্যকে প্রণিধানযোগ্য করে তুলেছেন।


চিত্ররচনা : বস্তুত অতিশয় দীর্ঘ জটিল কাহিনী রচনা করতে বসলেও তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল চিত্ররচনার দিকেই। চিত্রের পর চিত্র এঁকেই তিনি কাহিনীকে গতিদান করেছেন, ফলে হয়তো গতি কখনও মন্থরতা লাভ করেছে, কিন্তু কাহিনীতে যাতে কোনো শৈথিল্য দেখা না দেয়, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সাতিশয় সচেতন। চিত্ররচনায় তিনি কখনও পুনরুক্তি করেন নি, সেই চিত্র রঙে-রসে-বৈচিত্র্যে সমুজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথ তাই 'কাদম্বরী'কে বলেছেন একটি ‘চিত্রশালা’ – সংস্কৃত কাব্য-নাটক এবং গদ্যকাব্যেও কবিরা নরনারীর প্রেম-বর্ণনায় যে নিরঙ্কুশ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, বাণভট্ট সেখানে অনেক সংযতরুচি; তাঁর রচনায় তির্যক কামনা কখনও প্রশ্রয় লাভ করেনি। কাদম্বরীর একনিষ্ঠতা, মহাশ্বেতার প্রেম তপস্যা কিংবা উপেক্ষিতা পত্রলেখার নির্লিপ্ততা—সংস্কৃত সাহিত্যে এদের তুলনা কোথায়? ‘কাদম্বরী' অপূর্ব প্রেমকাব্য হলেও প্রণয়ের ফলে প্রত্যাশায় জন্মান্তরের অপেক্ষা করতে হয়েছে এই শুচি-সুন্দর চিত্র অন্যত্র দুর্লভ। প্রধান নায়ক-নায়িকাদের চরিত্র-চিত্রণে কবি অসাধারণ কুশলতা দেখিয়েছেন, এমনকি গৌণ চরিত্র পত্রলেখা-চরিত্রের আকর্ষণও এমন দুর্বার যে গ্রন্থশেষে তার জন্যও পাঠককে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়— লেখকের সার্থকতার এই তো শ্রেষ্ঠ উপহার।


বাণের রচনার আর একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তাঁর নারীচরিত্র। আশ্চর্যের বিষয় এই যে তাঁর কিছু কিছু নারীচরিত্রকে দেখা যায় স্বাধীনতা উপভোগ করতে; বাণের সঙ্গে বা পরে সংস্কৃত সাহিত্যে নারীপুরুষের সম্পর্কের মধ্যে এই অভিনবত্ব সুলভ নয়। চন্দ্রাপীড়ের সঙ্গে পত্রলেখার বন্ধুত্ব—সেই বন্ধুত্বের মধ্যে কিন্তু দেহগত বাসনার কোনো আসক্তি নেই। নারী পুরুষের বন্ধুত্বর এ এক অভিনব উদাহরণ। মহাশ্বেতা কোনো সঙ্গী বা রক্ষী ছাড়াই স্বাধীনভাবে বিচরণ করেন। সপ্তম শতাব্দীর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এই রকম ঘটনার পরিকল্পনাই দুঃসাধ্য মনে হয়। বাণভট্ট এখানে তাঁর কবি কল্পনায় নারীর সম্ভাব্য বন্ধনমুক্তির দুঃসাহসী ছবি এঁকেছেন। অনাগত খুশির অগ্রগামী ছায়া এই নারীচরিত্র অঙ্কনে প্রতিফলিত হয়েছে।