মিল্টনের ‘আরিওপাজিটীকা সুপ্রসিদ্ধ কেন | বাংলা সাহিত্যে মিল্টনের প্রভাব আলোচনা করো

মিল্টনের ‘আরিওপাজিটীকা (Arepagitica) সুপ্রসিদ্ধ কেন আলোচনা করো।


'আরিওপাজিটীকা' মিল্টন-রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ। গদ্যে রচিত। মিল্টন মধ্যবয়সে গদ্যই রচনা করেছেন বেশি। বিদেশ ভ্রমণ শেষে ত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি দেশে ফিরলেন তখন ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। রাজা প্রথম চার্লসের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডে প্রজাদের অভ্যুত্থান হয়েছে। প্রজাদের দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লেখনী হাতে প্রজাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। এই রাজনৈতিক বিচার-বিতর্কে প্রায় বছর কুড়ির জন্য মিল্টন জড়িয়ে পড়লেন। এই দীর্ঘকালের মধ্যে মাত্র কয়েকটি সনেট ছাড়া কাব্য রচনা তাঁর বন্ধ রইল।


এই সময়ের গদ্য তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে রচিত গদ্য রচনা সাময়িক বিষয়কে নিয়ে লেখা। এই প্রবন্ধাবলীতে তাঁর বহুপঠিত জ্ঞান ও বুদ্ধির দীপ্তি আছে, কিন্তু সাহিত্যমূল্য খুবই সামান্য। রচনাশৈলীতে সহজ স্বাচ্ছন্দ্য নেই।

এই রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলির মধ্যে ব্যতিক্রম 'আরিওপাজিটিকা' প্রবন্ধ গ্রন্থ। সাধারণের মত প্রকাশের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে গ্রন্থটি রচিত। প্রাচীন এথেন্সে জনসভার স্থান হচ্ছে ‘আরিওপেগাস'। সেই সূত্র ধরেই গ্রন্থটির নাম ‘আরিওপাজিটিকা'। কারণ জনসাধারণের কথাই গ্রন্থটিতে বলা হয়েছে।


লর্ডসভা ও কমন্সসভার সদস্যদের উদ্দেশ্য করে লেখক তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে সরকারী অনুমোদন ছাড়া কোনো গ্রন্থ বা যে কোনো বিষয় ছাপানো চলবে না, এতে সরকারের পছন্দমতো অভিমত ছাড়া অন্য মতের কণ্ঠরোধ করা হবে। কিন্তু অতীত জ্ঞানের ক্ষেত্রে ডানিয়েল, সেণ্ট পল প্রমুখ মানুষেরা মুক্ত বুদ্ধির পৃষ্ঠপোষণাই করে গেছেন। দ্বিতীয়ত, বিভিন্নমুখী পড়াশুনো এবং মতবাদের সঙ্গে পরিচয় মানব মনের বিকাশের জন্য প্রয়োজন। তৃতীয়ত, লাইসেন্স বা অনুমোদনের নাম করে বাজে ও ক্ষতিকর বিষয়ও অনেক সময় চালু হয়ে যায়। এর ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিই হয়। কাজেই এর ফলে জ্ঞানচর্চার সমূহ ক্ষতি হয় বলে মিল্টন জোরালো অভিমত প্রকাশ করলেন। চাইলেন জানা, বোঝা ও বলার শৃঙ্খলামুক্তি। চাইলেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

মিল্টনের যুক্তি, চিন্তাশীলতা ও তেজস্বিতার জন্য এই গ্রন্থটি শুধু সুপ্রসিদ্ধ নয়, তাঁর অন্যান্য গদ্য রচনার মধ্যেও ব্যতিক্রম।




কবি মিল্টনের গদ্যরচনার নামোল্লেখ করো। রচনার কারণ ব্যক্ত করো।

কবি মিল্টন ছাত্রাবস্থায় কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করলেও, ১৬৩৯ থেকে ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সমাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে অনেকগুলি প্যামপ্লেট রচনা করেছিলেন। সেই রচনাগুলিই তাঁর গদ্য রচনা হিসেবে চিহ্নিত। এই পর্যায়ে তিনি সর্বমোট পঁচিশটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে একুশটি ইংরেজিতে এবং বাকি চারটি প্রবন্ধ লাতিন ভাষায় রচিত। তাদের মধ্যে ‘ট্রাকটেট অফ এডুকেশন' (Tractate of Education), 'অ্যারিওপ্যাজিটিকা' (Areopagitica), 'টেনিওর অব কিংস অ্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেট' (Tenure of Kings and Magistrates) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর পুস্তিকা রচনার সূত্রপাত ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে, বিশপ যোসেফ হল-এর বিরুদ্ধে চার্চ সংক্রান্ত কয়েকটি শাণিত গদ্যরচনা প্রকাশের মাধ্যমে। এই রচনায় অবশ্য মিল্টনের কোনো স্বাক্ষর ছিল না। এই সব প্যামফ্রেট যে নিতান্তই সত্যতা নির্ভর ছিল তার অন্যতম প্রমাণ তাঁর 'অ্যাপলজি এগেনস্ট এ প্যামফ্রেট’ নামক পুস্তিকা থেকেই অনুমান করা যায়। এই পুস্তিকা ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে বিশপ হলের একটি পুস্তিকার প্রত্যুত্তরে রচনা করার সময়, মিল্টন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনার উল্লেখ করেন। এমনকি, ১৬৪৩-৪৪ খ্রিস্টাব্দে মেরি পাওয়েল তাঁকে ছেড়ে চলে গেলে মিল্টন বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়মনীতি প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি সমালোচনামূলক পুস্তিকা রচনা করেন। এই সমস্ত পুস্তিকা বা প্যামফ্রেটগুলির সাহিত্যমূল্য তেমন নেই। কেন না, এগুলি তাৎক্ষণিকতায় জাত। এগুলির বিচার করতে হলে সময় ও প্রেক্ষিতের প্রসঙ্গ স্মরণ রেখেই মন্তব্য করা সমীচীন।



মিল্টনের প্রথম পর্বের রচনার পরিচয় দাও।

মিল্টন যখন কেমব্রিজ ক্রাইস্টস্ কলেজের ছাত্র, সেই সময় কবিতা রচনার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত ঘটে। কলেজ জীবনের সেই কাব্যচর্চার অধ্যায়কেই মিল্টনের প্রথম পর্বের সাহিত্য সাধনার কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময় তিনি বেথলহেমের আস্তাবলে জাত যিশুখ্রিস্টের উদ্দেশ্যে প্রাচ্যের তিন জ্ঞানী ব্যক্তির যাত্রা বিবৃত করে 'অন দি মর্নিং অব ক্রাইস্টস্ নেটিভিটি' (On the Morning of Christ's Nativity) নামক বিখ্যাত 'ওড' (Ode) রচনা করেন। আলোচ্য কবিতটি রচনা করেন। এছাড়া এই সময় তিনি, ‘ইনফ্যান্ট নাইস’ (Infant Niece), 'অন শেক্সপীয়র' (On Shakespeare), 'অন অ্যারাইভিং অ্যাট দি এজ অব টুয়েন্টি থ্রি' (On the Arriving the Age of Twentythree) প্রভৃতি রচনা করেন। এই সমস্ত রচনার মধ্যে তাঁর প্রতিভার অভিজ্ঞান বর্তমান। তাঁর "লা, লেখো” (L’ Allegro), এবং ইল পেনসেরোসো' (Il Penseroso) প্রথম যৌবনে রচিত কবিতা দুটিতে ছড়িয়ে আছে আনন্দ ও বেদনার দুটি ভিন্নধর্মী বোধ। 'লালেগ্রো'-র মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে—ভোরের আলো ফুলের শোভা, পাখির কুজন, সুখের গান ; আর ইল পেনসেরোসো'-র মধ্যে পাওয়া যায়—সন্ধ্যার ছায়া, বিষাদ গাম্ভীর্য, চাঁদের উদয়, জীবনের লঘু আনন্দের পরিবর্তে মৌন প্রশান্তি।



মিল্টনের ‘কোমাস' শীর্ষক কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে দু চার কথা লেখো।

মিল্টনের কাব্য চর্চার প্রথম পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল ‘কোমাস' (Comus) নামক কবিতা তথা নাট্যকাব্য। Earl of Bridgewater কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে মিল্টন এক রূপক-ধর্মী রাখালিয়া কবিতাটি রচনা করেন। এটি তরুণ কবির ‘মাস্ক’ জাতীয় রচনা। এলিজাবেথের যুগে মাস্কের জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। এই জাতীয় রচনায় ঘটনা ও চরিত্র থাকে গৌণ, মুখ্য হয় নাচ-গান-সাজ-পোষাক। মিল্টনের 'কোমাস' মাস্ক জাতীয় রচনা হলেও ছিল স্বতন্ত্র প্রকৃতির রচনা। নাচ-গানের জাঁকজমকতার চেয়ে এখানে মুখ্য হয়েছে নৈতিক আদর্শ। ঈশ্বরের স্তব, সুনীতি ও শুদ্ধতার কথাই এখানে বড়ো হয়ে উঠেছে। ধৈর্য, সংযম, নিষ্ঠা এবং অন্তর পবিত্র থাকলে কামনা বাসনাময় এই সংসার সমুদ্রেও ত্রাণকর্তা রূপে ভগবানের হস্ত প্রসারিত—এই শাশ্বত বাণীটি রূপক কাহিনীর মোড়কে শুনিয়েছেন মিল্টন। এই কবিতার সমস্ত চরিত্রই প্রতীকধর্মী ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। নাটকীয়তার অভাব থাকলেও অনুভবের শুদ্ধতায়, লিরিকের মাধুর্যে এ রচনা অনিন্দ্য হয়েছে। কবিতাটি মিল্টন রচনা করেছিলেন ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এ (Blank Verse )।



মিল্টন রচিত সনেটগুলি সম্বন্ধে দুচার কথা ব্যক্ত করো।

কলেজ জীবনের পর থেকে 'প্যারাডাইস লস্ট' (Paradise Lost) রচনার আগে পর্যন্ত মিল্টন ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে প্রায় পঁচিশটি গদ্য পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। এই কুঠ বছর সময়ের মধ্যে গদ্য রচনা ও আন্দোলনের ভূমিকা পালন করার ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু সনেট (Sonnet) রচনা করেন। তাদের মধ্যে 'অন হিস ব্লাইন্ডনেস' (On His Blindness), 'অন দি লেট ম্যাসাকার ইন পিডমণ্ট’ ( On the Late Massacre in Piedmont), 'টু মিস্টার লরেন্স' (To Mr. Lawrence), 'ক্যাপটেন অর কর্নেল, অর নাইট ইন আর্মস' (Captain, or Colonel, or Knight in Arms) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মিল্টনের সনেটের সংখ্যা প্রাচুর্য না থাকলেও বিষয় বৈচিত্র্যে ও স্বরগাম্ভীর্যে এগুলি অনবদ্য তথা অসামান্য। শেক্সপীয়ার ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছাড়া মিল্টনের পাশাপাশি অন্য কোনো কবির নাম ইংরেজি সাহিত্যের সনেট প্রসঙ্গে উচ্চারিত হতে শোনা যায় নি। মিল্টনের সনেটের দেশপ্রেম, রাজনীতি, ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাস হল মূল উপজীব্য। তাঁর কবি জীবনের উচ্চ আদর্শগুলি এই সমস্ত রচনায় বিম্বিত হয়েছে।


মিল্টনের সনেটের চোদ্দ লাইনে ছিল এক ধারাবাহিকতা। 'অকটেভ’ ও ‘সেসটেট’-এর মধ্যে কোনো ছেদ বা বিরতি নেই। পেত্রার্কের অষ্ট-ষষ্ঠক রীতির কাঠামোটুকুই মাত্র মিল্টন গ্রহণ করেছেন। সনেটের মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত আবেগানুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে।



বাংলা সাহিত্যে মিল্টনের প্রভাব আলোচনা করো।

বাংলা সাহিত্যে মিল্টনের অনুগামীরূপে সর্বপ্রথমেই মনে পড়ে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে। মিল্টনের মতোই মধুসূদনও বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যের রস আস্বাদন করেছিলেন। ভারতীয় ও ইউরোপের বিভিন্ন ভাষা—সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রীক ভাষা চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে তুলেছিলেন। 'মেঘনাদবধ কাব্য' রচনায় মিল্টনের অমিত্রাক্ষর ছন্দেই তিনি প্রবুদ্ধ হয়েছিলেন। ছন্দ ছাড়াও মহাকাব্যোচিত উপ রূপক প্রভৃতি অলঙ্কার প্রয়োগে মিল্টনই ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি। যদিও মিল্টনের ঈশ্বর বিশ্বাস এবং নৈতিক বোধ 'মেঘনাদবধ কাব্যে' তেমন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি, আর তা সম্ভবও নয়, কারণ ইংল্যান্ডের পিউরিটান যুগ এবং উনিশ শতকীয় বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাঁস এক নয়। তবু মিল্টনের মহাকাব্যের প্রভাব ‘মেঘনাদবধ কাব্যে' বহুলভাবে লক্ষণীয়। স্বর্গ, মর্ত্য, নরকের দৃশ্যাবলী বর্ণনে এবং রাবণ অঙ্কনে 'প্যারাডাইস লস্ট'-এর শয়তান চরিত্রের প্রভাব উল্লেখ্য। মিল্টনের শয়তানের মতোই রাবণ মহৎ না হলেও নায়কোচিত গুণে মণ্ডিত। রাবণ বলিষ্ঠ ও ব্যক্তিত্বশালী এবং স্বাধীনতার জন্য তাঁর আকাঙ্ক্ষা দুর্বার। ‘মেঘনাদবধ কাব্যে'র প্রথম সর্গের প্রারম্ভে ‘প্যারাডাইস লস্ট'-এর প্রথম সর্গের অনুরূপভাবে কবি কাব্যের বিষয় নির্দেশ ও বাণীবন্দনা করে বাগদেবীর প্রসাদ ভিক্ষা করেছেন।


মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ' রচনার মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে যে মহাকাব্যধারা বা মহাকাব্যের যুগ আরম্ভ হ’ল, সেই ধারাপথেই আমরা পাই হেমচন্দ্রের 'বৃত্রসংহার' ও নবীনচন্দ্রের ‘রেবতক’, ‘কুরুক্ষেত্র' ও ‘প্রভাস'। এই মহাকাব্যসমূহ রচনার মধ্যেও রয়েছে মিল্টনের কাব্য কল্পনার প্রভাব।



মিল্টন রচিত শোককাব্য 'লিসিডাস' (Lycidas) -এর উৎস কী? এটি সম্বন্ধে আলোচনা করো।

মিল্টন রচিত শোককাব্য (Elegy) 'লিসিডাস' রচিত হয় ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে। কবিতাটির উৎস হচ্ছে মিল্টনের এক সহপাঠী বন্ধু এডোয়ার্ড কিং অকালে জাহাজডুবিতে আইরিস সমুদ্রে ডুবে মারা যান, বন্ধুর এই বিয়োগব্যথাই কাব্যটির মূলে। তবু কবির ব্যক্তিগত বেদনার সুর এখানে বড়ো হয়ে দেখা দেয় নি। মিল্টনের দৃষ্টিতে এডোয়ার্ড এক বিরাট সম্ভাবনার অকাল বিয়োগের মূর্ত বিগ্রহ। কিং ধর্মযাজক হবেন, এই স্থির ছিল। এই প্রসঙ্গে পিউরিটান মিল্টন সমসাময়িক পুরোহিত এবং ধর্মযাজকদের তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন।


‘লিসিডাস' রাখালিয়া লোকগীতি (Pastoral Elegy)। এখানে যারা পোক করতে এসেছে তারা সকলেই মেষপালক। কবি নিজেও মেষপালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কবিতার আঙ্গিকের জন্য মিল্টন থিয়োক্রিটাস, ভার্জিল, বিয়ন, মস্কাস প্রভৃতি প্রাচীন কবিদের কাছে ঋণী। এই কাব্যের আঙ্গিক ক্লাসিক্যাল, সুর (tone) খ্রিস্টান এবং মতামত ব্যক্তিগত। আপাতদৃষ্টিতে এই তিনটি ভিন্ন দিককে কবি তাঁর আলোকসামান্য প্রতিভায় ঐকতানে রূপান্তরিত করেছেন। ভাবের গাম্ভীর্য, সুরের মাধুর্য ও শব্দের ঝঙ্কারের জন্য একসময় কবি টেনিসন 'লিসিডাস'কে কাব্যরুচির কষ্টিপাথর আখ্যা দিয়েছিলেন। সমালোচকদের মতেও শোকগীতি হিসাবে শেলির ‘ওডোনেইস’ (Adonais) এবং আর্নল্ড-এর 'থারসিস্' (Thyrsis)-এর চেয়ে মিল্টনের লিসিডাস' কোনো অংশে নিকৃষ্ট নয়। অবশ্য রাখালিয়া আঙ্গিকের জন্য ডাঃ জনসন 'লিসিডাস'কে বলেছিলেন 'সহজ, সাধারণ সুতরাং বিরক্তিজনক। কিন্তু রাখালিয়া ক্লাসিক্যাল আঙ্গিকের পিছনে যে কবি মিল্টনের ব্যক্তিসত্তা লুকিয়ে রয়েছে ডাঃ জনসন সম্ভবতঃ তা লক্ষ্য করেন নি।



'প্যারাডাইস রিগেইল্ড' কত খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়? এই মহাকাব্যটির বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

মহাকবি মিল্টন কর্তৃক চারখণ্ডে রচিত এই মহাকাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দে। মিল্টনের বন্ধু টমাস এলউড ‘প্যারাডাইস লস্ট’ পড়বার সময় বলেছিলেন, স্বর্গ থেকে আদম ও ঈভ নির্বাসিত হলেন। কিন্তু তাঁরা আবার করে স্বর্গে ফিরে যাবেন? এই প্রশ্নের উত্তর ‘প্যারাডাইস রিগেইণ্ড'। শয়তানের দ্বারা প্রলুদ্ধ হয়ে আদি পিতা আদম ও আদি মাতা ঈভ যে স্বর্গরাজ্য হারালেন, ঈশ্বর-পুত্র কর্তৃক শয়তানের সেই প্রলোভন জয়ের মধ্য দিয়েই আবার স্বর্গরাজ্য লাভ করা যাবে।


চার সর্গে রচিত এই কাব্যের প্রথম সর্গে রয়েছে যে যিশুই হচ্ছেন সেই ঈশ্বরপুত্র। এই যিশুকে প্রলুদ্ধ করার জন্য শয়তানি ষড়যন্ত্র আবার আরম্ভ হল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্গে শয়তান কর্তৃক যিশুকে প্রলুদ্ধ করার নানা উপায়ের কথা বলা হয়েছে। যিশুর ক্ষুধার সময় সুখাদ্য দিয়ে, সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে এবং পার্থিব জগতে সত্যকার গৌরব সম্পর্কে নানা বিতর্ক করে শয়তান ফাঁদে ফেলতে চাইল যিশুকে। চতুর্থখণ্ডে দেখা যাচ্ছে কোনো লোভের ফাঁদেই যিশু ধরা দিলেন না। শয়তানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। পরিশেষে শয়তান যিশুকে এক পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গেল এবং মানবের অতিরিক্ত যিশুর কি সে শক্তি যা দিয়ে শয়তানের সর্ব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল, জানবার জন্য যিশুকে ওপর থেকে ঠেলে নীচে ফেলে দিল। শয়তানও পড়ল। শয়তান হল হতাশ। যিশুকে দেবতাগণ তুলে নিয়ে গেল। যিশুখ্রিস্টের জীবনেই এই প্রলোভন জয় ও স্বর্গপ্রাপ্তির দৃষ্টান্ত দেখানো হয়েছে। কাব্যসৌন্দর্য এই দ্বিতীয় গ্রন্থে প্রচুর পরিমাণে থাকলে সমগ্রভাবে এই কাব্যটি প্রথমখানির সমকক্ষ নয়। বাইবেলের লুক বর্ণিত 'সুসমাচার' (Gospel According to Saint Luke) থেকেই এই গল্পাংশটি গৃহীত।