শেলীর কবি-কৃতির পরিচয় দিয়ে তাঁর স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করো | 'শেলী রোমান্টিক যুগের শ্রেষ্ঠ কবি'—শেলীর গীতিকবিতা আলোচনা প্রসঙ্গে এই মন্তব্যের যাথার্থ্য বিচার করো।

রোমান্টিক কবি হিসাবে শেলীর বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো এবং তাঁর রচনাবলীর একটি পরিচয় দাও। শেলীর সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের কোনো কবির সাদৃশ্য আছে কি?

“মানবদরদী শেলীর রোমান্টিক কল্পনায় খণ্ডিত বাস্তবের ঊর্ধ্বে পরিপূর্ণ আদর্শবাদের জয় বিঘোষিত।”—এই মন্তব্যের আলোকে শেলীর কাব্যকৃতির স্বরূপ উদ্ঘাটন করো। এই প্রসঙ্গে বাংলা কাব্যে শেলীর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।


একটু বড়ো করে ধরলে ১৭৮০ থেকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকেই ব্যাপক অর্থে রোমাণ্টিক যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ক্লাসিক্যাল ও অগষ্টান সাহিত্যের প্রতিবাদরূপে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই এর সূচনা হয়। পূর্বসূরি হিসাবে উইলিয়াম ব্লেককে বলা হয় ইংল্যান্ডের রোমান্টিক আকাশে ভোরের পাখি। কিন্তু ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজের যুগ্ম রচনা সংকলন 'লিরিক্যাল ব্যালাডস' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে রোমান্টিক যুগে সাহিত্য তার পূর্ণ গৌরব নিয়ে উদ্ভাসিত হল। বিষয়বস্তু, ভাষা, ছন্দ—কবিতার এই তিনটি ক্ষেত্রেই রোমাণ্টিক কবিরা নতুনত্বের সন্ধান করলেন। এই রোমান্টিক কবি-সমাজের প্রধান পাঁচটি স্তম্ভ হলেন। ওয়ার্ডওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস ও বায়রন।


প্রকৃতিপ্রিয়তা, অতীতচারিতা বা অতীত ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ, বিস্ময়বোধ, সৌন্দর্যবোধ, অলৌকিকের প্রতি আগ্রহ প্রভৃতি ছিল এই রোমান্টিক কবিদের বৈশিষ্ট্য। এই যুগের কবি হলেও ভাব ও ভাবনাগত, কল্পনাগত, ধর্মগত পার্থক্য সকলের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল এবং এইদিক দিয়ে একই রোমাণ্টিক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েও শেলী ছিলেন অন্যান্য থেকে স্বতন্ত্র।


রোমান্টিক কাব্য আন্দোলন সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে গেলেই শেলীর নাম সর্বাগ্রে পাঠক-মনে উদিত হয়। ওয়ার্ডওয়ার্থ এই আন্দোলনের পুরোধা হলেও শেলীর লেখনীতেই রোমান্টিসিজম তার সামগ্রিক রূপ নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়। তাই তিনি একমাত্র না হলেও প্রধানতম প্রতিনিধি কবি। তাঁর জীবন, তাঁর ব্যাকুল আগ্রহ, নতুন এক শ্রেণিহীন পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন, অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন রঙিন কল্পনা এবং এর সঙ্গে প্রাকৃত জগৎ—বৃক্ষরাজি, সমুদ্র, গুহা প্রভৃতির খুঁটিনাটি বিষয় ও মানব সভ্যতার আদি অস্তের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ ও অকৃত্রিম ভালোবাসা, নারীর প্রতি তাঁর প্লেটোনিক প্রেম ইত্যাদি সব মিলিয়ে শেলী আজও এক দুরন্ত বিস্ময়।


শেলী ছিলেন বিদ্রোহের কবি। স্বাভাবিকভাবেই রোমান্টিক কল্পনার বিকাশ তাঁর মধ্যে দেখা গেলেও অন্যান্যদের মতো তিনি প্রধানত প্রকৃতির সৌন্দর্যে বিমুগ্ধই হননি, তার মধ্য দিয়ে তিনি দেখেছেন মানুষের মানবতার উদ্বোধন। একদিকে ফরাসী বিপ্লব এবং অপরদিকে জার্মানীর কান্ট ও হেগেলের দর্শন তৎকালে যে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত করেছিল, সেইখান থেকেই শেলী তাঁর কল্পনার প্রদীপখানি জ্বেলে নিয়েছিলেন। এই পুরাতন ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁর কবিতা ও নাটকের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।


১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডের এক স্বচ্ছল অভিজাত পরিবারে, সাসেক্স এর ফীল্ড প্লেসে পার্শি বিশি শেলী (Percy Bysshe Shelley) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আকৃতি ছিল সুন্দর। কোমল লাবণ্যময় মুখ, উজ্জ্বল নীল চোখ আর বড়ো বড়ো চুল। কিন্তু প্রকৃতি অশান্ত। বাঁধা নিয়মে চলা তাঁর ধাতে ছিল না। বাল্যকাল থেকেই সর্বপ্রকার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছিলেন অকুণ্ঠিত। বাল্যে ইটন স্কুলে এবং পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। গ্রীক, ল্যাটিন ভাষাতেও তিনি রপ্ত হন। অক্সফোর্ডে ছাত্র থাকাকালীনই হিউমের দর্শন পড়ে তিনি 'দ্য নেসেসিটি অব এবীজম' (The Necessity of Atheism) নামে একটা বই লিখে ফেলেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। খামখেয়ালিতে বিরক্ত হয়ে পিতা টিমথি শেলী কিছুদিন পর পুত্রের মাসোহারা বন্ধ করে দেন। কিন্তু শেলী কিছুতেই দমলেন না। উনিশ বছর বয়সে আলাপ হল হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুকের সঙ্গে বিবাহ হল। দুটি সন্তানও হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল ছাড়াছাড়ি। ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতা উইলিয়াম গডউইনের সাম্যবাদ, মৈত্রীবাদ ও নৈরাজ্যবাদ শেলীর ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর গডউইনের কন্যা মেরীকে শেলী বিবাহ করেন। জীবনের শেষ চার বছর শেলী সস্ত্রীক ইটালিতেও কাটান। ইটালিতে কবির সঙ্গী ছিলেন বায়রন (Byron) এবং লী হাণ্ট (Leigh Hunt)। নৌকা চালান ও মাছ ধরার শখ ছিল দুর্নিবার, অথচ সাঁতার জানতেন না। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুলাই ইটালিতে পিসার হ্রদে ঘোর কুয়াশায় কবি নৌকা ভাসালেন। সে নৌকা আর ফিরে এল না। বেশ কিছুদিন পরে তাঁর মৃতদেহ কূলে ভেসে এল। দেহ দাহ করে বন্ধুরা তাঁর চিতাভস্ম রোমে কীটসের সমাধিপার্শ্বে প্রোথিত করেন। শেলী ও কীটস দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃত্যুতেও পাশাপাশি গ্রহণ করলেন ভূমিশয্যা। কীটসের মতোই অকালে হারিয়ে গেল এক স্বপ্নমুগ্ধ প্রাণ।


শেলীর কবিতায় দুটি বিপরীত সুরের প্রকাশ দেখা যায়। একটি উদ্ধৃত বিদ্রোহের এবং অপরটি আতবেদনার। কবির বিখ্যাত কবিতা ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড' (Ode to the West Wind) কবিতায় ঝড়ের কাছে কবির প্রার্থনা—“হে ভয়ঙ্কর, তোমার শক্তি হোক আমার শক্তি, আমারই কণ্ঠে বাজুক ভাবী যুগের ভূর্যধ্বনি।” ওই কবিতাতেই আবার শুনি কাতর বিলাপ—“সংসারের কাঁটায় আমি ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত।” গীতিকবি হিসাবে তাঁর কবিতায় রয়েছে আবেগের তীব্রতা, কিন্তু ভাব ও আবেগের সঙ্গে স্বতঃউৎসারিত, চেষ্টাকৃত নয়। উচ্ছ্বাসের বাহুল্য ও আদর্শবাদের আতিশয্য বড়ো কবিতার শিল্প সুষমাকে ক্ষুণ্ণ করলেও অন্যত্র তাঁর রচনা বর্ণনার চমৎকারিত্বে এবং অনুভূতির গাঢ়তায় অনুপম। বুদ্ধির দীপ্তি তার সব রচনার বৈশিষ্ট্য।


অত্যন্ত অল্পবয়সে শেলী 'জাসট্রোজি’ (Zastrozzi) নামে একটি রোমান্সধর্মী রচনা লেখেন। কিন্তু তাঁর প্রথম উল্লেখ্য কাব্য ১৮১২-১৩ খ্রিস্টাব্দের রচিত 'কুইন ম্যার' (Queen Mab)। ম্যাব একজন পরী রাণী। এক কুমারী মেয়ের আত্মাকে স্বর্গরথে নিয়ে যাবার সময় বিশ্বের অভাব, অনটন দেখে বেদনার্ত সেই বিদেহী আত্মাকে ম্যার বললেন, স্বার্থপরতাই মানুষের দুঃখের কারণ। রাজা, পুরোহিত প্রমুখের অত্যাচারে দরিদ্র মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু নতুন যুগ আসবে। সুখী সমৃদ্ধ স্বাধীন সমাজ গড়ে উঠবে। কবিতাটিতে শেলী অনাগত সাম্যবাদের জয় ঘোষণা করেছেন।


শেলীর পরবর্তী কাব্য আলাস্টার অব দ্য স্পিরিট অব সলিটিউড (Alastor or the Spirit of Solitude. 1817)। বিশ্বচিন্তায় নিমগ্ন নিঃসঙ্গ এক তরুণের বেদনার করুণ কাহিনী। অমিত্রাক্ষর ছন্দে কাব্যটি রচিত। নায়ক তাঁর মানসী প্রিয়ার সন্ধান করেছেন, কিন্তু সে অধরা। বিদেহিনী কখনও দেহরূপের মধ্যে ধরা দেয় না। তাই তরুণের আর্তিও শেষ হয় না। কবিতাটি স্বল্পায়ু, বেদনাময় জীবনেরই যেন রূপক কাহিনী। কবির জাবনের দুঃসহ শূন্যতা এবং আসন্ন মৃত্যুর পদধ্বনি কবিতাটিতে রূপায়িত হয়েছে।


পরবর্তী কাব্য 'রিভোল্ট অব ইসলাম' (Revolt of Islam)। রচনাকাল ১৮১৮। বার খণ্ডে বিভক্ত দীর্ঘ কবিতা। এর পূর্ববর্তী নাম ছিল 'লাওন অ্যান্ড সিথনা' (Laon and Cythna) | লাওন আর সিথনা, ভাইবোন— একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ, দরিদ্র অত্যাচারিত মুসলমান নরনারীর মধ্যে স্বাধীনতার বাণী। প্রথমে জয়ী হলেও ধর্মান্ধ জনগণ পুরোহিতের নির্দেশে তাঁদের পুড়িয়ে মারে। এই আত্মাহুতি যে সফল হবে সেই আশ্বাসেই কবিতাটি শেষ হয়েছে।


এই সময়েই 'রোসালিও অ্যান্ড হেলেন' (Rosalind and Helen) নামে একটি কাব্য রচনা করেন। অনুবাদ করেন প্লেটোর 'সিম্‌পোসিয়ম' (Symposium)। কিন্তু এইগুলি খুব উল্লেখ্য রচনা নয়।


এরপর 'প্রমিথিয়ুস আবাউণ্ড' (Prometheus Unbound) নামে একটি নাটক রচনা করেন। রচনাকাল ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ। এটিই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা এবং সমকালের অন্যান্য কবিদের থেকে এই কাব্যটিই তাঁকে পৃথক করেছে। তাঁর বিদ্রোহী মনোভাবটি এখানে স্পষ্ট উচ্চারিত। তাঁর এই বিদ্রোহ সমস্ত প্রকার অন্যায়, অত্যাচার বন্ধনের বিরুদ্ধে। কাহিনীটি ইস্কাইলাসের 'প্রমিথিয়ুস বাউণ্ড' (Prometheus Bound)-এর নবরূপায়ণ। গ্রীক গল্পে আছে, মানবদরদী প্রমিথিয়ুস মানুষের কল্যাণের জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন এবং মানুষকে বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা শিখিয়েছিলেন। ফলে ক্রুদ্ধ দেবরাজ জীয়ুস ককেশাস পর্বতে তাঁকে বন্দী করে রাখেন এবং এক ঈগল প্রতি রাত্রে তাঁর মাংস ঠুকরে খেত। গ্রীক নাটকে প্রমিথিয়ুস দেবরাজের পদানত হিসেবে উপস্থাপিত। কিন্তু শেলীর নায়ক প্রমিথিয়ুস প্রেম, শুভবুদ্ধি ও স্বাধীনতার প্রতীক। মাতা ধরিত্রী এবং প্রিয়া এশিয়া বিপদে সান্ত্বনা দান করেছেন। এশিয়া প্রেমের প্রতিমা। জীয়ুস হিংসা ও অত্যাচারের প্রতীক। জীয়ুসের পুত্র হারকিউলিস ঈগলকে হত্যা করেন। প্রমিথিয়ুসের মুক্তির অর্থ, বিশ্বমানবের মুক্তি। জগতের আদি শক্তি ডেমোগর্গন জীয়ুসকে সিংহাসনচ্যুত করেন। প্রেমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। প্রেমের চিরন্তনী, সর্বব্যাপী শক্তির ওপর শেলীর প্রবল বিশ্বাস ছিল। 'রিভোল্ট অব ইস্‌স্লাম' থেকে আরম্ভ করে 'প্রমিথিয়ুস আনবাউণ্ড’ পর্যন্ত এই বিশ্বাস কোথাও ফল্গুধারার মতো আবার কোথাও বন্যাপ্লাবিত নদীর মতো বয়ে গেছে। অত্যাচারের মধ্যেই গুপ্ত থাকে অত্যাচার ধ্বংসের বীজ। 'কংসকারায় কংসহস্তী জন্মিছে অবিরত।' তাই জীয়ুসের পুত্র হারকিউলিস জীয়ুসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এখানে কবি সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন যে মানুষ নিজেই হবে মানুষের প্রভু এবং হবে সৎ, ভদ্র এবং বিজ্ঞ। প্রেমের অমোঘ শক্তিতে শেলীর ছিল অটুট বিশ্বাস। অ-প্রেমী জীয়ুসেরাই জগতে অশান্তির মূল কারণ। প্রমিথিয়ুসের জয় প্রেমের জয়। জগতের কল্যাণ প্রেমে। প্রকৃতির অন্তরে বিরাজ করছে এক চিরন্তনী প্রেম-সত্তা (Spirit of Love)। যেদিন মানুষ সেই সত্তার সঙ্গে সুর মেলাবে সেইদিনই পৃথিবীতে আসবে সত্যযুগ বা স্বর্ণযুগ (millenium)। এই সত্যযুগের আশ্বাসবাণীতেই নাটক শেষ হয়েছে। কবির স্বপ্নও ছিল এই সত্যযুগ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।


পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে নির্যাতিত মানবের অন্তরাত্মা যখনই মুক্তির জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে তখনই শেলী তাঁর সমর্থনে কলম ধরেছেন।


এর পরে নাটক 'দ্য চেখি' (The Cenci)। রচনাকাল ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ। পঞ্চাঙ্কে রচিত ট্র্যাজেডি নাটক। রোমান্টিক নাটক অপেক্ষা গ্রীক নাটকের সঙ্গেই এর সাদৃশ্য বেশি। চেঞ্চি হচ্ছেন পুরানো কালের ইটালির এক নৃশংস অত্যাচারী কাউন্ট। এখানে শেলী মানুষের বিকৃত কামনাকে রূপ দিয়েছেন। অবশেষে কৃতকর্মের ফল ভোগ করেছে কাউণ্ট। গীতিকবির দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বাস্তব সংসারের নৃশংসতা নিষ্ঠুরতাই চিত্রিত হয়েছে।


১৮২০ ও ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রচিত যথাক্রমে 'দ্য মাস্ক অব এনাকি' (The Mask of Anarchy) এবং 'দ্য উইচ্ অব অ্যাটলাস' (The Witch of Atlas) কবিতা দু'টিতে সমসাময়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে কবির বিপ্লবাত্মক মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে।


১৮২২ খ্রিস্টাব্দে বন্ধু কীটসের মৃত্যুতে শেলী রচনা করেন অমর শোকগাথা 'অ্যাডোনেইস্' (Adonais) কবিতাটি দীর্ঘ। অতীন্দ্রিয় রহস্যের আকর্ষণ শেলীর অন্যান্য কবিতার মতো এখানেও দেখা যায়। 'অ্যাডোনেইস্' নামকরণে রয়েছে গ্রীক পুরাণের প্রভাব। সুন্দর তরুণ অ্যাডোনিস (Adonis) ছিলেন সৌন্দর্যের দেবী অ্যাফ্রোডাইটি-র প্রিয়। মৃগয়া শিকারে গিয়ে আহত অ্যাডোনিস মারা যান। সে বিয়োগব্যথা অসহ্য হয় অ্যাফ্রোডাইটির কাছে। অতঃপর পাতালের দেবতারা এই বর দেন যে প্রতি বৎসর দু'মাসের জন্য অ্যাডোনিস পৃথিবীতে আসবেন, থাকবেন সৌন্দর্য দেবীর সঙ্গে। কবি যেন বলতে চান সৌন্দর্যদেবী আর সৌন্দর্যপূজারী অবিচ্ছিন্ন। শেলীর কল্পনায় কীটস হচ্ছেন অ্যাডোনিস। অ্যাডোনিসের মতোই কীটস আহত মানসিক দিক দিয়ে সমালোচকের বিরুপ সমালোচনায়। মৃত্যুও ঘটল তাঁর। কিন্তু সৌন্দর্যপূজারী কীটসের মৃত্যু নেই। অলক্ষিতে পৃথিবীর সকল সৌন্দর্যে মিশে রয়েছেন। সুন্দরের মধ্যে তাঁর বারবার আগমন ঘটবে। মহাকাব্যিক এক বিশাল পটভূমিকায় রচিত এই রাখালিয়া শোকগীতটি শেলীর একটি শ্রেষ্ঠ রচনা এবং বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শোকগাথাগুলির সঙ্গে সমভাবে তুলনীয়।


এই সময়ের রচিত কবির আর একটি কবিতা 'এপিসাইকিডিয়ন' (Epipsychidion)। নারীর দেহপ্রতিমা নয় ভাব-প্রতিমাকেই কবি চান। মর্ত্যের নারীর মধ্যে তিনি এই মানসী-প্রিয়াকেই খুঁজে ফিরেছেন। কারাবন্দিনী সুন্দরী ইটালীয় মেয়ে এমিলিয়ার মধ্যে তিনি একবার তাঁর আদর্শ কল্পনার মানসী প্রতিমার প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্যে কবিতাটি লিখিত। ছন্দময় ভাষায় কবি মনোভাবের অনুভবময় প্রকাশ কবিতাটিতে ঘটেছে।


রোমান্টিক যুগ গীতিকবিতার যুগ। এই যুগের অন্যতম সম্রাট কবি শেলী। কীটস তাঁর গাথা কবিতা ও ওডগুলিতে সৌন্দর্যলক্ষ্মীরই আরাধনা করেছিলেন। কিন্তু শেলীর অপূর্ব মধুর কবিতাগুলিতে ঘোষিত হয়েছে প্রেম ও স্বাধীনতার জয়গান। শেলীর কবিতাগুলির চিত্রকল্প এবং সেই উপমা, ভাষার মাধুর্য এবং সাঙ্গীতিক মূর্ছনা পাঠককে আকৃষ্ট করে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কবির ব্যক্তিগত জীবনের অশ্রুসজল কণ্ঠ। সব মিলিয়ে “এই কবিতাগুলি ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। তাঁর ছোটো ছোটো কবিতাগুলিতে শোনা যায় তাঁর উদ্বেলিত হৃদয়ের গান। সে গান কখনও বিক্ষুব্ধ অধীর, কখনও বিষণ্ণ ব্যাকুল। প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলিও আলো ছায়ায় রঙে রঙে মায়াময়। শেলীর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ এই কবিতাগুলিতেই।


কবির 'ওড্ টু দ্য ওয়েস্ট উইণ্ড' (Ode to the West Wind)-এর তুলনা নেই। আকাশসমুদ্রে উঠেছে প্রবল ঝড়। মেঘেরা খসে পড়েছে জীর্ণ পাতার মতো। শুধু ঝড়ের বর্ণনাই নয়, কবি নিজের মধ্যে এই ঝড়ের শক্তি সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। এই শক্তিতেই তিনি নিজের বিপ্লবের বাণী দিক-বিদিক ছড়িয়ে দিতে চান, বপন করতে চান নবজীবনের বীজ। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে গোলাপ সংগ্রহ করতে গিয়ে জীবনের কাঁটায় ক্ষত বিক্ষত অতি বেদনার সুরও এখানে প্রকাশিত। জীবনযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হবার করুণ কণ্ঠ কবিতাটিতে শুনতে পেলেও, কবির প্রবল আশাবাদ কবিতাটিতে প্রকাশিত। সত্যযুগ বা স্বর্ণযুগ (millenium) পৃথিবীতে আসবেই তাই এখানেও উচ্চারিত : শীত যদি আসে বসস্ত কি বেশি দূরে? " 

O West Wind,

If Winter comes, can Spring be far behind?"


‘হাইম টু ইনটেলেকচুয়্যাল বিউটি' (Hymn to Intellectual Beauty) কবির একান্ত অনুভূতির কবিতা। গীতিকবির দুর্লভ প্রতিভার সঙ্গে প্লেটোর প্রভাব এবং অলৌকিকের প্রতি আকর্ষণযুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছে এই অনবদ্য কবিতা। কবি যুবক বয়সেই পার্থিব প্রেমের বিষাদ, অতৃপ্তি সম্বন্ধে চরম কথা বলেছেন। মানবজীবনের সকল অভিজ্ঞতায় তিনি প্রাজ্ঞ, তাই তাঁর কাছে :

For love, and beauty, and delight 

There is no death, no change.


‘দ্য ক্লাউড' (The Cloud) এবং ‘টু এ স্কাইলার্ক’ (To a Skylark) দুটি উল্লেখ্য কবিতা। 'দ্য ক্লাউড' কবিতায় মেঘ ও আকাশের বিচিত্র রূপ প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। 'টু এ স্কাইলার্ক' কবিতায় স্কাইলার্ককে কবি অশরীরী আনন্দ (unbodied joy) বলে কল্পনা করেছেন। কবির ব্যক্তিগত জীবন ও আদর্শবাদের ছায়াপাত ঘটেছে। দূর আকাশে উড্ডীন এই পাখি আনন্দের দূত, তার স্বতঃস্ফূর্ত গান আনন্দের ধারা। মনে হয়, এ স্কাইলার্ক যেন শেলীরই অন্তরাত্মা, ভাবলোকে যার বিহার, যুগান্তরের স্বপ্ন যার গানে গানে। কবি হেমচন্দ্রের 'চাতক পক্ষীর প্রতি স্কাইলার্কের ভাবানুবাদ।


এ ছাড়া 'লাইন্‌স্‌ রিটন অ্যামং দ্য ইউগেনিয়ান হিলস' (Lines Written Among the Euganean Hills), 'স্ট্যাথাস রিন ইন ডিজেক্‌শন্ নিয়ার নেপল্‌স' (Stanzas Written in Dejection near Naples). "দ্য 'ইন্ডিয়ান সেরিনেড' (The Indian Serenade), 'এ ল্যামেন্ট' (A Lament), 'টু নাইট' (To Night) প্রভৃতি শেলীর কয়েকটি সুপরিচিত গীতিকবিতা।


ইউগেনিয়ান পাহাড়ে লেখা পংক্তিনিচয়ে, পাহাড়ের চারধারের শোভা দেখতে দেখতে ভাবছিলেন দুঃখময় জীবনে প্রকৃতিই এনে দেয় আনন্দের স্পর্শ। দুঃখের সাগরে আনন্দের এই সবুজ দ্বীপ মানব মনকে কালিমা থেকে মুক্ত করবে প্রেমের মন্ত্রে, এই হচ্ছে কবির অনুভব। নেপলসের ধারে নিরাশায় মগ্ন মনও প্রকৃতির স্নিগ্ধ স্পর্শে পেয়েছিল "দু’ দণ্ডের শান্তি”। রৌদ্র, নীল আকাশ, সমুদ্রের তরঙ্গমালা এবং নগর কোলাহল থেকে দূরে কবির নিরাশা মৃদু হয়ে আসে বাতাস আর জলরাশির মতো। 'কড়ি ও কোমলে' রবীন্দ্রনাথ এই কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। 'এ ল্যামেন্ট' কবিতায় কবির চিরবিদায়ের সুর বেজে উঠেছে। জীবনের শেষ যেখানে দাঁড়িয়ে কবি পৃথিবীকে যেন জানাচ্ছেন শেষ নমস্কার। পৃথিবীতে সুদিন ফিরে আসার স্বপ্ন কি সার্থক হবে? হবে না, এই হতাশাই যেন কবিকে পেয়ে বসেছে। ‘টু নাইট’ কবিতাটি মৃত্যুর আগের বছরে লেখা। অনাগত মৃত্যুর ছায়াপাত ঘটেছে। তবে মৃত্যু এখানে রাত্রির সহোদর, আর সুপ্তি রাত্রির শিশুর ক্লান্তির সুর কবিতাটিতে সুস্পষ্ট।


অবশ্য কবি-লিখিত মাত্র কয়েকটি গীতিকবিতার উল্লেখ করলেও এর বাইরে রয়েছে আরও অজস্র কবিতা। শেলী যদি বড় কবিতাগুলি না লিখতেন, তাহলেও একমাত্র এই কবিতাগুলির জন্য কাব্যপাঠক তার কাছে চিরঋণী থাকত। এইসব কবিতায় তথাকথিত বক্তব্য নেই যা মাঝে মাঝে কাব্যিক বাগ্মিতার কাছাকাছি যায়। এইসব নিটোল কবিতা দেশকাল-নিরপেক্ষ—অনেকটাই ঘটনা-নিরপেক্ষ। শুধু রয়েছে এই বিশ্বসংসারের কথা, নিজের কথা, সুন্দরের কথা, প্রকৃতির কথা। কবিতায় প্রকাশিত তীব্র অনুভূতি এবং আবেগ সঙ্গীতের মতোই হৃদয়ের প্রতিটি কোষে অনুরণন তোলে। উজ্জ্বল মণিমুক্তাতুল্য এইসব ছোটো ছোটো গীতিকবিতা রচনায় এইখানেই শেলীর বৈশিষ্ট্য।


বাংলা সাহিত্যে শেলীর প্রভাব:

বাংলা সাহিত্যে শেলীর প্রভাব আলোচনা প্রসঙ্গে মোটামুটি বলা যায় আধুনিক বাংলায় রোমান্টিক কবিদের অনেকেই শেলীর ভাব ও ভাবনায় অল্পবিস্তর প্রভাবিত। এই প্রভাব কোথাও বা পরোক্ষ, কোথাও প্রত্যক্ষ।


বাংলা গীতিকাব্যের ‘ভোরের পাখি' বিহারীলালের সারদামঙ্গলের 'সারদা' কল্পনার সঙ্গে শেলীর 'স্পিরিট অব বিউটি'র তুলনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথকেও একসময় শেলীর সঙ্গে তুলনা করা হত। অবশ্য এ মিল কখনও সার্বিক মিল নয়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ বহু কবির কাব্য থেকেই প্রেরণা পেয়েছেন। তিনি মূলত শান্তরসের কবি এবং সেইদিক দিয়ে ওয়ার্ডওয়ার্থের সঙ্গেই তাঁর মিল বেশি, তবু রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্যভাবনা কবি শেলীকে স্মরণ করায়। 'মানসী', 'চিত্রা', 'সোনার তরী' কাব্যের প্রায় সর্বত্রই কবি তাঁর ভালোবাসা নিবেদন করেছেন ভাব-লোক বাসিনী প্রিয়ার কাছে। শেলীর মতোই রবীন্দ্রনাথের কাছেও ভালোবাসা আত্মার স্ফুরণ, দেহ-লালসা নয়। প্লেটোর প্লেটোনিক প্রেম-ধারণার ‘দেহহীন জ্যোতি’ রবীন্দ্রমনেও ছায়া ফেলেছিল। শেলীর 'স্পিরিট অব বিউটি' বা সৌন্দর্যলক্ষ্মীর মতোই রবীন্দ্রনাথের 'মানসসুন্দরী'র সৌন্দর্যলীলায় লীলায়িত বিশ্বভুবন। প্রত্যক্ষ প্রভাবের কথায় মনে পড়বে ‘অ্যালাস্টর' কবিতায় শেলী কল্পনার প্রিয়াকে নিয়ে স্বপ্নতরীতে নিরুদ্দেশচারী হয়েছেন। 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'য় কবিও অচেনা বিদেশিনীর সঙ্গে নৌকায় সমুদ্রের বুকে নিরুদ্দেশ যাত্রী। শেলীর 'হাইম টু ইনটেলেকচুয়াল বিউটি' আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘মানসসুন্দরী' এবং 'উর্বশী' কবিতার কথা। 'ওড টু ওয়েস্ট উইণ্ড' কবিতার সঙ্গে অনেকে রবীন্দ্রনাথের 'বর্ষশেষ' কবিতারও তুলনা করেন। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি শেলীর কবিতার অনুবাদ করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারের 'পুরুরবা' ও 'মানসলক্ষ্মী'তে শেলীর 'অ্যালাস্টর' ও 'হাইম টু ইনটেলেকচুয়াল বিউটি'র প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। যে বিদ্রোহী মনোভাব শেলীর প্রধান বৈশিষ্ট্য তা সর্বাধিক পরিমাণে লক্ষ্য করা যায় বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে। শেলীর ‘ওয়েস্ট উইণ্ড'-এর সঙ্গে নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার সাদৃশ্য লক্ষ্য করার মতো। সকল প্রকার বন্ধন থেকে মানবতার মুক্তি উভয়‌ কবিতারই বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে সত্যযুগ ও স্বর্ণযুগ (millenium)-রূপ বসন্তকে নিয়ে আসবার জন্যই শেলী আবাহন করেছেন ঝড়কে, গেয়েছেন বিদ্রোহের গান। কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতায় বলেছেন—'যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না,/মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত,/আমি সেইদিন হব শাস্ত।'