অনসূয়া-প্রিয়ংবদা চরিত্র

‘মেঘদূত' কাব্যের মতোই 'শকুন্তলা' নাটককে দুটি সুস্পষ্ট ভাগে ভাগ করা যায়। 'শকুন্তলা'র পূর্বভাগ কণ্বমুনির আশ্রম, দ্বিতীয়ভাগ মুনি মারীচের তপোবন, মধ্যবর্তী অংশ রাজা দুষ্মন্তের রাজসভা এবং সেখানে সংঘটিত ঘটনা যেন একটি ছোট্ট বিষ্কম্ভবা (interlude)। নাটকের প্রথমার্ধে কণ্বমুনির আশ্রমে সমবয়সী সখীদের সঙ্গে বর্ধিত। পরস্পরের উত্তাপে, অনুকরণে, ভাবের আদান প্রদানে, হাস্য পরিহাসে, কথোপকথনে সর্বত্র তিনটি সখী একই সঙ্গে স্বাভাবিক বিকাশ লাভ করেছিল। কণ্বমুনির আশ্রমে অন্যান্য আশ্রম বালিকা থাকলেও আমরা শকুন্তলার প্রিয়সখী দু’জনের সঙ্গেই বিশেষভাবে পরিচিত হই। একজন অনসূয়া, অপরজন প্রিয়ংবদা। অনসূয়া অর্থে ঈর্ষাহীন, এবং প্রিয়ংবদা অর্থে প্রিয়বাদিনী। নাম দুটি আশ্রম বালিকার স্বভাবের পরিচয়দ্যোতক।


নাটকের প্রথম দিকেই আশ্রমে আলবলে জলপূরণে নিযুক্ত শকুন্তলাসহ তাপসকন্যা সখীদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। পরিচয় ঘটে রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গেও। এই অনসূয়া প্রিয়ংবদাকে নিয়েই মহর্ষি কণ্বমুনির আশ্রমে শকুন্তলা সম্পূর্ণ। এই সম্পূর্ণ শকুন্তলার সঙ্গেই দুষ্মন্তের প্রথম পরিচয় ঘটেছিল। দুষ্মন্তের পুষ্পধেনু নিক্ষিপ্ত বাণে শকুন্তলা যখন হতচেতন, তখন সেই নিক্ষিপ্ত শরের জ্বালা বা দূরাগত প্রভাব থেকে প্রিয়সখী দুজনও কী নিজেদের সম্পূর্ণ রক্ষা করতে পেরেছে? মহাকবি কালিদাস অবশ্য এ বিষয়ে নীরব। 'কাদম্বরীর’ ‘পত্রলেখা' চরিত্রের মতো অনসূয়া প্রিয়ংবদা উপযুক্ত সহানুভূতির অভাবে কবি কর্তৃক যেন উপেক্ষিতাই রয়ে গেছে। তবু নাটক পাঠে বা দর্শনে এই চরিত্রদুটিকে অস্বীকার করবার উপায় নেই। এ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর কথায়, 'আমি তো মনে করি, রাজসভায় দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে যে চিনিতে পারেন নাই তাহার প্রধান কারণ—সঙ্গে অনসূয়া-প্রিয়ংবদা ছিল না। এক তপোবনের বাহিরে, তাহাও খণ্ডিতা শকুন্তলা—চেনা কঠিন হইতে পারে।'


রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'শকুন্তলার সুখসৌন্দর্য গৌরব পরিখা বৃদ্ধি করিবার জন্যই এই দুটি লাবণ্য প্রতিমা নিজের সমস্ত দিয়া তাহাকে বেষ্টন করিয়াছিল। তিনটি সখী যখন জলের ঘট লইয়া অকাল বিকশিত নবমালতীর তলে আসিয়া দাঁড়াইল তখন দুষ্মন্ত কী একা শকুন্তলাকে ভালোবাসিয়াছিলেন? তখন হাস্যে কৌতুকে নবযৌবনের বিলোল মাধুর্যে কাহারা শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিল? এই দুটি তাপসী সখী। একা শকুন্তলা শকুন্তলার এক তৃতীয়াংশ। শকুন্তলার অধিকাংশই অনসূয়া এবং প্রিয়ংবদা, শকুত্তলাই সর্বাপেক্ষা অল্প। বারো আনা প্রেমালাপ তো তাহারাই সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়া দিল। শকুন্তলা বিদায় লইলেন, তারপর যখন সখীরা শূন্য তপোবনে ফিরিয়া আসিল, তখন কী তাহাদের শৈশব সহচরীর বিরহই তাহাদের একমাত্র দুঃখ? শকুন্তলার অভাব ছাড়া ইতিমধ্যে তপোবনের আর কী কোনো পরিবর্তন হয় নাই? হায়, তাহারা জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাইয়াছে, যাহা জানিত না তাহা জানিয়াছে। এখন হইতে অপরাহে আলবালে জলসেচন করিতে কী তাহারা মাঝে মাঝে বিস্মৃত হইবে না? এখন কি তাহারা মাঝে মাঝে পত্রমর্মরে সচকিত হইয়া অশোকতরুর অন্তরালে প্রচ্ছন্ন কোনো আগন্তুকের আশঙ্কা করিবে না? মৃগশিশু আর কী তাহাদের পরিপূর্ণ আদর পাইবে।'


এ তো অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মানসিক পরিচয়ের কথা। নাটকের প্রথম অংশে আশ্রমকে মুনি ঋষিদের আবাসভূমির শুষ্কতা থেকে স্নেহ-প্রেম-প্রীতি খণ্ডিত পরিবেশ রচনায় 'শকুন্তলা' নাটকে এই চরিত্র দুটির অবদান অনেকখানি। তাদের সরলতা, সহজ রসিকতা, রহস্যপ্রিয়তা তপোবনের এই জীবনকে রসস্নিগ্ধ ও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। মহাভারতের কাহিনী কঙ্কাল রক্ত-মাংসযোগে পরিপূর্ণ ও সজীব হয়ে উঠেছে। নাটকের অগ্রগতির গতিপথে কালিদাসের শকুন্তলা দুষ্মন্তের প্রণয়ের দূতী অনসূয়া-প্রিয়ংবদা সখীদ্বয়—তারাই দুষ্মন্তের কাছে শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত ইঙ্গিতে প্রকাশ করেছে। মহাভারতে এই আত্মপরিচয় দিয়েছেন শকুন্তলা নিজে। ঘটনার এই পরিবর্তন নিঃসন্দেহে অধিকতর শোভন ও সুন্দর। নাটকের অগ্রগতিতে দুষ্মন্ত ভাবে তন্ময় শকুন্তলা অন্যমনস্কতা বশত আশ্রমে ঋষি দুর্বাসার আগমন সংবাদ অবহিত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ঋষি দুর্বাশা যখন শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলেন যে যার চিন্তায় সে এমন তন্ময় হয়ে আছে তিনি সময়কালে শকুন্তলাকে চিনতে পারবেন না। তখন সে অভিশাপের কথা ভাব-তন্ময় শকুন্তলা জানতে না পারলেও তাঁর সখীদ্বয় ক্রুদ্ধ ঋষিকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করলে ঋষি জানালেন, শকুন্তলা যদি কোনো অভিজ্ঞান (স্মারকচিহ্ন) দেখাতে পারে, তবেই রাজা তাঁকে চিনতে পারবেন। এই স্মারক-চিহ্নই নাটকটিকে পরিণতির পথে নিয়ে গিয়েছে। আর এখানে অনসূয়া-প্রিয়ংবদার অবদান তো রয়েছেই। যাইহোক, আশ্রমিক জীবনকে উপভোগ্য করে তোলায়, মহাভারতের কাহিনী কঙ্কালের ওপর গৃহজীবন তথা মানবিক ভাবের রক্ত-মাংস সঞ্চারে, নিজেদের মাধুর্য ও সারল্যপূর্ণ আচার-আচরণের দ্বারা জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলা, নায়িকা শকুন্তলাকে সম্পূর্ণ ফুটে উঠতে সহকারী পার্শ্ব-চরিত্রের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করা এবং নাটকীয় ঘটনার অগ্রগতিতে সাহায্য করা প্রভৃতি গুণে ‘শকুন্তলা' নাটকে এই চরিত্র দুটি শকুন্তলার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক তথা দর্শকমনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করে। কখমুনির তপোবনে ছড়িয়ে দেয় এক সুমিষ্ট সৌরভ।