বাংলা সাহিত্যে শেক্সপিয়রের প্রভাব আলোচনা করো | শেক্সপিয়রের দ্বারা বাংলা সাহিত্য কতভাবে প্রভাবিত হয়েছে সে সম্পর্কে সবিস্তারে আলোচনা করো।

শেক্সপিয়রের সঙ্গে বাঙালির প্রাথমিক পরিচয় ঘটেছে প্রধানত অভিনয় ও শিক্ষার মাধ্যমে। ১৭৮০ থেকে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতা শহরে সর্বপ্রথম শেক্সপিয়রের নাটক অভিনীত হয়। প্রথমে যে কয়টি নাটক অভিনীত হয় তাদের নাম 'ওথেলো', 'হ্যামলেট', 'মার্চেন্ট অব ভেনিস', 'রোমিও এন্ড জুলিয়েট'। সেই অভিনয়ের ধারা আজও চলছে।


১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হল। ইংরেজি সাহিত্যের পঠন-পাঠনে স্বাভাবিকভাবেই শেক্সপিয়রের স্থান সকলের উপরে। হিন্দু কলেজের কৃতবিদ্য অধ্যাপকদের মধ্যে অধ্যাপক রিচার্ডসনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। শেক্সপিয়র ও নাট্যশালার প্রতি প্রবল অনুরাগ তিনি তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সংক্রামিত করে দিয়েছিলেন, ছাত্রদের মনে একটা সংস্কার গড়ে তুলেছিলেন। মধুসূদনও রিচার্ডসনের দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছিলেন।


বাংলা সাহিত্যে প্রথম ট্র্যাজেডি নাটক হিসেবে স্মরণীয় 'কীর্তিবিলাস' (১৮৫২ খ্রিঃ) নাটকে নাট্যকার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সচেতনভাবেই শেক্সপিয়রীয় নাট্যরীতি অবলম্বন করেছিলেন। সে যুগে বাংলায় অনূদিত শেক্সপিয়রের নাটকের কথা বলতে গেলে তাকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়, রূপান্তরিত বা ভাবানুবাদ এবং যথাযথ বা অবিকল অনুবাদ। এই ভাবানুবাদের মধ্যে পড়ে সেই নাটকগুলি যেগুলিতে পাত্রপাত্রীর নাম, ধাম, পরিবেশ পরিবর্তন করে তাদের সম্পূর্ণ দেশী ভাবায়িত করা হয়েছে। নাটকের ভাবকে অবলম্বন করে কোথাও তাদের উপন্যাসরূপ দেওয়া হয়েছে।


নাটকের প্রথমদিকের অনুবাদের মধ্যে উল্লেখ্য হরচন্দ্র ঘোষের 'ভানুমতী চিত্তবিলাস' (১৮৫৩)। নাটকটি ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ। তাঁর পরবর্তী নাটক 'চারুমুখ চিত্তহরা' (১৮৬৩) অবশ্য 'রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট' এর অনুবাদ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়রের 'কমেডি অব এরর্স'-এর ভাব অবলম্বনে 'ভ্রান্তিবিলাস' নামে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলেন। এই ভাবানুবাদ বা রূপান্তরিত নাটকের অনুবাদকদের মধ্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নলিনী বসস্ত’ (টেম্পেস্ট), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সুশীলা বীরসিংহ' (সিম্বেলিন), হরলাল রায়ের 'রুদ্রপাল' (ম্যাকবেথ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।


পরবর্তীকালে যথাযথ বা অবিকল অনুবাদের ক্ষেত্রে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুলিয়াস সীজার' নাটকটির উল্লেখ করা যায়। গিরিশচন্দ্রের 'ম্যাকবেথ' শ্রেষ্ঠ অনুবাদরূপে আজও স্মরণীয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ওথেলো' অনুবাদটিও স্মরণযোগ্য। শেক্সপিয়রের নাটক অনুবাদের ক্ষেত্রে বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের উদ্যোগে তাঁর প্রসিদ্ধ নাটকসমূহের দুইখণ্ড সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ইদানীংকালেও নতুন করে শেক্সপিয়রের নাটকের মূলানুগ অনুবাদ বিভিন্ন প্রকাশকগণ প্রকাশ করেছেন।


শেক্সপিয়রের নাটকের শুধুমাত্র ভাবানুবাদ বা মূলানুগ অনুবাদের ক্ষেত্রেই নয়, মৌলিক বাংলা নাটকের উপরও শেক্সপিয়রের প্রভাবের কথা উল্লেখ করতে হয়। হরচন্দ্র ঘোষের 'কীর্তিবিলাস' নাটকের কথা আগেই বলা হয়েছে। এরপর অবশ্য শেক্সপিয়রীয় নাট্যরীতিতে রচিত উমেশচন্দ্র মিত্রের 'বিধবা বিবাহ' (১৮৫৭)-এর নাম উল্লেখ করতে হয়।


সঠিকভাবে বলতে গেলে শেক্সপিয়রের নাট্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হল মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা' এবং ‘পদ্মাবতী’ থেকে। কিন্তু এই রীতি শেক্সপিয়রের বহিরঙ্গ রীতি। অন্তরঙ্গে অর্থাৎ সুতীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ও ট্র্যাজিক বেদনায় তাঁর ‘কৃষ্ণকুমারী’তে শেক্সপিয়রীয় নাট্যধর্ম সার্থকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে।


সামাজিক নাটক দীনবন্ধুর 'নীলদর্পণে ও শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডির প্রভাব আমরা লক্ষ্য করি। 'জামাইবারিক নাটকে স্ত্রী কামিনীর বশীভূত হওয়ার কাহিনীর সঙ্গে ‘টেমিং অব দ্য শ্রু' নাটকের ক্যাথারিনার চরিত্রের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়।


গিরিশচন্দ্রের 'সিরাজদ্দৌলা', 'চণ্ড' প্রভৃতি ঐতিহাসিক নাটকে শেক্সপিয়রের নাট্যরীতি ও রসসৃষ্টির প্রভাব পুরোপুরিই পড়েছিল। তাঁর অধিকাংশ সামাজিক নাটকেও যে ট্র্যাজিক পরিণতি দেখানো হয়েছে, সেখানেও রয়েছে শেক্সপিয়রের ট্র্যাজিক নাটকের প্রভাব। 'জনা' পৌরাণিক নাটক এবং পরিণতি ভক্তিরসাশ্রিত, কিন্তু তার মধ্যে তীব্র ঘাত-প্রতিঘাত-দ্রুত ঘটনার গতি এবং জনা চরিত্রের সক্রিয়তা নিরুপায় পরিণতি চরিত্রটিকে শেক্সপিয়রের নাটকের ট্র্যাজিক চরিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।


দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকে শেক্সপিয়রের ঋণ সোজাসুজিই স্বীকার করেছেন। তাঁর নাটকে ঘটনার তীব্র বেগ, চরিত্রের বলিষ্ঠ ট্র্যাজিক রূপ, বহির্দ্বন্দ্বের সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্বের সমাবেশ, কবিত্বময় সংলাপ প্রভৃতির দিক দিয়ে তিনি শেক্সপিয়রকে সজ্ঞানেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর 'নূরজাহান' নাটকের নূরজাহান চরিত্রটি লেডী ম্যাকবেথের পরিণতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। 'সাজাহান' নাটকে সাজাহান চরিত্রের ট্র্যাজিক পরিণতি মনে করায় রাজা লিয়ারের কথা।


রবীন্দ্রনাথের নাট্যজীবনের প্রথম পর্বে 'রাজা ও রানী', 'বিসর্জন' এবং 'মালিনী' নাটকে শেক্সপিয়রের নাট্যরীতির প্রভাব সুস্পষ্ট। তাঁর কমেডি নাটক 'চিরকুমার সভা', 'শেষরক্ষা'র মধ্যেও শেক্সপিয়র-সুলভ রোমান্টিক কমেডির প্রণয়রস ও কৌতুকরসের সহাবস্থান দেখা যায়।


এ পর্যন্ত আলোচনায় 'শেক্সপিয়রের নাট্যরীতি’ কথাটির বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। সেই ‘নাট্যরীতি' বলতে কী বোঝায় তা সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, কারণ বিশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত বাংলা নাটক রচনায় এই নাট্যরীতিই ছিল নাট্যকারদের কাছে সর্বাধিক প্রিয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে প্রথম উল্লেখ্য হচ্ছে, নাটকে মূল কাহিনীর পাশাপাশি উপ-কাহিনীর সংযোজন। কাহিনীতে বৈচিত্র্য আনবার জন্য শেক্সপিয়রের রোমান্টিক কমেডি এমনকি ট্র্যাজেডির মধ্যেও এই উপকাহিনী যোগ করতেন। বাংলাতে 'কৃষ্ণকুমারী’ নাটক থেকেই আমরা এর প্রয়োগ দেখতে পাই। 


দ্বিতীয়ত, নাটকে স্বগতোক্তি ও জনান্তিক ভাষণ। বাংলা নাটকে রবীন্দ্রনাথের কাল পর্যন্ত এই বিশিষ্ট রীতির প্রয়োগ দেখা যায়। 


তৃতীয়ত, শেক্সপিয়রের নাটকে দেখা যায় যে সাধারণত গভীর ও উচ্চ ভাবপ্রকাশ করার জন্য পদ্য সংলাপ ব্যবহৃত হয়েছে, আর লঘুচপল বক্তব্য, কৌতুক পরিবেশন ও জনতা চরিত্রের সংলাপের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে গদ্য। 


চতুর্থত, করুণরসের পাশাপাশি কৌতুকরসের অবতারণা, শেক্সপিয়রের আর একটি নাট্যরীতি। বাংলা নাটকেও এর ব্যবহার ব্যাপক। 


পঞ্চমত, শেক্সপিয়রের পাঙ্ক নাটকে নাটকীয় ঘটনার উপস্থাপনা (introduction), বিবর্তন, জটিলতা ও পরিসমাপ্তি—এইভাবে ঘটনাকে সাজানো হয়েছে। প্রথম অঙ্কে উপস্থাপনা, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ এবং কোনো কোনো স্থলে পঞ্চম অঙ্কের কিছুটা পর্যন্ত নাট্যঘটনার বিবর্তন, জটিলতা ও তীব্রতা এবং পঞ্চম অঙ্কে পরিসমাপ্তি। বাংলা পথ্যাঙ্ক নাটকেও মোটামুটি এই নাট্যরীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। 


ষষ্ঠত, আলোচ্য হচ্ছে রসগত প্রভাব। শুধু নাটক নয়, সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই আমরা এই প্রভাবের ব্যাপকতা লক্ষ্য করব। 


শেক্সপিয়রের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ের ফলেই বাংলা সাহিত্যে ট্র্যাজিক রস-চেতনার রূপ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। এই ট্র্যাজেডি চেতনা শুধুমাত্র দৈবশক্তির নিষ্ঠুর নির্যাতনজাত নয়, ব্যক্তিসত্তার প্রবল সংগ্রামশীল রূপ থেকেই উৎসাহিত। বহির্দ্বন্দ্ব অপেক্ষা তীব্রতর অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই এই ট্র্যাজিক রস পরিস্ফুট। এইখানেই শেক্সপীয়রের নাটকের বড়ো অবদান। এবং বাংলা সাহিত্যে প্রথম উল্লেখ্য 'কীর্তিবিলাস' নাটকের মধ্যেই আমরা এই ট্র্যাজিক-রস চেতনা সম্পর্কে নাট্যকারের সচেতন মনস্কতার পরিচয় পাই।