ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তিসমূহ

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে যুক্তিসমূহ


ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি বিভিন্ন যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। নৈতিক, দার্শনিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি বিভিন্ন দিক থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা তাঁদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। 


(ক) নৈতিক যুক্তি: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শের পক্ষে নৈতিক যুক্তি প্রদর্শন করা হয়। বলা হয় যে ব্যক্তিকে তার একান্ত নিজস্ব কাজকর্ম সম্পাদন করার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে ব্যক্তির বৌদ্ধিক ও নৈতিক বিকাশ বিপন্ন হবে; ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আত্মবিশ্বাস বিনষ্ট হবে; ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের পরিবর্তে যান্ত্রিক সাদৃশ্যের সৃষ্টি হবে। কবি মিলটনের মতানুসারে কাজের ন্যায়-অন্যায় নির্বিশেষে ব্যক্তিকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতেই ব্যক্তির আত্মবিকাশ বাঞ্ছনীয়। এটাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক ও পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়স্বরূপ। এতে পরনির্ভরতার সৃষ্টি হয় এবং ব্যক্তিজীবনের সমূহ ক্ষতি হয়। তাছাড়া ব্যক্তি তার নিজের শুভাশুভ নিজেই সর্বাপেক্ষা ভাল বোঝে। সুতরাং ব্যক্তিকে তার ইচ্ছানুসারে চলবার সুযোগ ও স্বাধীনতা দেওয়া আবশ্যক। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে যে সকল বাধা বর্তমান রাষ্ট্র কেবলমাত্র সেগুলি দূর করবে এবং এইভাবে ব্যক্তি এবং সমাজের প্রতি রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করবে। সরকারী হস্তক্ষেপের ফলে জনকল্যাণের পরিবর্তে জনগণের অকল্যাণ হয়েছে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে এমন নজির মানব ইতিহাসে অসংখ্য। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে নৈতিক যুক্তির অবতারণা করেছেন কাণ্ট, ফিক্‌টে, জে. এস. মিল, হুমবোল্ট (Humbolt) প্রমুখ দার্শনিক।


(খ) দার্শনিক যুক্তি: দার্শনিক দৃষ্টি থেকে বলা হয় যে, রাষ্ট্রের কোন স্বতন্ত্র সত্তা বা অস্তিত্ব নেই। ব্যক্তিবর্গের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়। তাই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও কর্মপরিধি সংকুচিত করে ব্যক্তি-মানুষের স্বাধীন উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে প্রাধান্য প্রদান প্রয়োজন। ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ঘটলে ব্যক্তির অকল্যাণ সাধিত হবে।


(গ) রাজনীতিক যুক্তি: মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সীমিত হওয়া একান্তভাবে কাম্য। রাষ্ট্রের কর্মপরিধি বিস্তৃত হলে জনগণের সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারসমূহ নানাভাবে ক্ষুণ্ণ হবে। এতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী।


(ঘ) আর্থনীতিক যুক্তি: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ ও মুক্ত প্রতিযোগিতার পক্ষপাতী। ফরাসী ফিজিওক্র্যাটগণ (Physiocrats) আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতি বা স্বাচ্ছন্দ্য নীতির (Laissez Faire) কথা বলেছেন। তাঁদের মতে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণশূন্য অবাধ প্রতিযোগিতা থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে ভোগ্যদ্রব্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হবে এবং সুলভ মূল্যে পাওয়া যাবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিল্প-কারখানা পরিচালিত হলে বাজার অর্থনীতিতে অবাধ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশেষীকরণ ও শ্রমবিভাজন সম্প্রসারিত হয়। তার ফলে সমাজে আর্থনীতিক প্ৰাচুৰ্য্য ও সুখ ভোগ সুনিশ্চিত হয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন ও ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালিত হলে উৎপাদন কম হয় এবং ব্যয় বেশী হয় এবং অপচয়ের আশংকা থাকে। সুতরাং ব্যক্তি ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিগত উদ্যোগই অভিপ্রেত।


(ঙ) বৈজ্ঞানিক যুক্তি: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী মতাদর্শের পক্ষে জৈব মতবাদের যুক্তি দেখান হয়। জীব বিজ্ঞানের যোগ্যতম উদ্‌দ্বর্তনের নীতি’ অনুসারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের বক্তব্য হল, জীবন-সংগ্রামে যোগ্য বলে যারা প্রতিপন্ন হবে কেবল তাদেরই বাঁচার অধিকার আছে। এর ফলে মানবসমাজ হবে যোগ্য ব্যক্তিদের সুস্থ, সবল সমাজ। এ ক্ষেত্রে দুর্বলের স্বার্থে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে সমাজ অকর্মণ্য ব্যক্তিদের দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়বে। দুর্বল ব্যক্তিদের জন্য রাষ্ট্রের খয়রাতি সাহায্য সমাজের অনিষ্ট সাধন করে। সুতরাং রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ না করলে মানবসমাজ হবে দক্ষ, যোগ্য, বুদ্ধিমান লোকের উন্নত সমাজ। স্পেনসার এই যুক্তির দৃঢ় সমর্থক।


(চ) অভিজ্ঞতার যুক্তি: অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দাবী করা হয় যে, ব্যক্তিগত কর্মকুশলতা ও ব্যক্তির স্বাধীন উদ্যোগের ভিত্তিতেই মানবসমাজের সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিষ্ঠা ও সততা বর্তমান থাকে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধনের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সামর্থ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের ক্ষেত্রে নৈপুণ্যের অভাব ঘটে, আলস্য ও দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়। তাঁদের মতে ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই।


(ছ) রাষ্ট্রের অকর্মণ্যতার যুক্তি: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের মতে ব্যক্তির সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাষ্ট্রের নেই। কারণ সরকারী প্রশাসন ব্যবস্থা আমলাতন্ত্রের কুফলকে এড়িয়ে যেতে পারে না। আর্থনীতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আধিক্যের ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা আমলাতান্ত্রিক দোষ-ত্রুটির দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। গেটেল (Gettell) বলেছেন: “They doubt competency of the modern state to judge wisely the needs of society or to provide for them."


ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ

সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রসারের ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে ক্রমশ তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এই মতবাদের বিরূপ সমালোচনা করা হয়। বস্তুত বর্তমানের পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের যুক্তিসমূহ অসার প্রতিপন্ন হয়।


(১) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের নৈতিক যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়: বর্তমানকালের সমস্যাসঙ্কুল জটিল সমাজে ব্যক্তি মানুষ স্বতন্ত্রভাবে অত্যন্ত অসহায়। এই অবস্থায় প্রত্যেকের পক্ষে নিজ নিজ স্বার্থ ও শুভাশুভ সম্পর্কে সচেতন থাকা সম্ভব নয়। প্রতিকূল পরিবেশের এই অসহায় অবস্থা থেকে রাষ্ট্রই কেবল মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। জোড-এর মতে, প্রত্যেকে সমান দূরদর্শী, প্রত্যেকের নিজ অভাব উপলব্ধির ক্ষমতা আছে এবং ব্যক্তিকল্যাণ ও জনকল্যাণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই—এই ধারণা ভ্রান্ত। অসহায় মানুষ রাষ্ট্রের নেতৃত্বে মুক্তির সুযোগ পায়। আবার সমাজে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থের সংঘাতের মধ্যে যথার্থ ব্যক্তিকল্যাণ এবং সমাজকল্যাণের পথ একমাত্র রাষ্ট্রই নির্দেশ করতে সক্ষম। ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধনের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। প্রত্যেক ব্যক্তিকে যে যার মর্জিমাফিক পরিচালিত হওয়ার সুযোগ দিলে ব্যক্তির মধ্যে অন্যায়, অসাধু ও অসামাজিক আচরণের প্রবণতা দেখা দেবে।


(২) জীববিজ্ঞানের যুক্তির সমালোচনা: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদিগণ কর্তৃক সমর্থিত 'যোগ্যতমের উদ্বর্তনের নীতি’ মানব সমাজে অচল। কেবল যোগ্য ও সবলই বেঁচে থাকবে এবং দুর্বল ও অক্ষম ধ্বংস হবে, অমানবিক এই নীতি পশু সমাজেই খাটে। এ হল জঙ্গলের আইন। এই নীতি মানব সভ্যতার পরিপন্থী। তা ছাড়া, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সকলের মনুষ্যত্ব, বুদ্ধিবৃত্তি, নীতিবোধ, সৃজনী ক্ষমতা প্রভৃতির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে – এ ধারণাও 'ভ্রান্ত'। প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতাই মানুষের সহজাত সমাজ চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। আবার জীবন-সংগ্রামে যথাযথভাবে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করার জন্য দরকার সমান সুযোগ সুবিধার এবং উপযুক্ত পরিবেশের। কেবল রাষ্ট্রই এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।


জৈবিক বিচারে যে দুর্বল বৌদ্ধিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সে সবল হতে পারে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে দুর্বল মানুষের বিকাশের পরিবর্তে তার বিনাশের কথা বলা হয়। অর্থাৎ এই মতবাদে মানুষের সৃজনশীল উপাদানের সার্বজনীন বিকাশের কথা বলা হয় না।


জোডের মত (C. E. M. Joad): জোড-এর মতানুসারে জৈবিক মতবাদের মাধ্যমে বর্বরতার নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই জৈবিক মতবাদকে হার্বাট স্পেনসার জে. এস. মিলের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তত্ত্বের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। এই পথে মিলের তত্ত্বের বিকাশ বর্বরতার নীতির প্রাধান্যকে প্রতিপন্ন করে। কারণ জৈবিক মতবাদ নৈতিকতা বিরোধী, বর্বর ও মারাত্মক।


(৩) আর্থনীতিক যুক্তির সমালোচনা: অনিয়ন্ত্রিত আর্থনীতিক ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। তার ফলে চূড়ান্তভাবে একচেটিয়া কারবারের সৃষ্টি হয়। ফলে সম্পদের অপচয় ঘটে, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে অব্যবস্থা দেখা দেয়। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ নীতির কুফল সমাজের সাধারণ মানুষকে দুর্দশাগ্রস্ত করে। সিজউইক (Sidgewick)-এর মতানুসারে এ হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও মারাত্মক ত্রুটি। একে তিনি বলেছেন: “The most deep seated weakness and most formidable danger of individualism." আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অবাধ বা স্বাচ্ছন্দ্য নীতি একচেটিয়া কারবারের সৃষ্টি করে। বার্নস (C.D. Burns) বলেছেন: “The free competition which allows free combination turns into its economic opposite, monopoly." একচেটিয়া কারবারের ফলে সমাজের ধনবৈষম্য প্রকট রূপ ধারণ করবে। তার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ দুঃখ-দারিদ্র্য ও শোষণ বঞ্চনার শিকার হবে। ম্যাকাইভার বলেছেন: “The richness of the rich intensifies the poverty of the poor."


জোডের মত: জোডও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আর্থনীতিক যুক্তির তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাজনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির ইচ্ছানুসারে চলার নীতি স্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই নীতি মেনে নেওয়া যায় না। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে এই নীতির প্রয়োগ মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার পথ প্রশস্ত করবে।


(৪) রাষ্ট্রনৈতিক যুক্তির সমালোচনা: রাষ্ট্রই আইনের মাধ্যমে ব্যক্তির অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। রাষ্ট্রই ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতার স্রষ্টা, ধারক ও বাহক। সুতরাং ব্যক্তি-স্বাধীনতার স্বার্থে রাষ্ট্রের কর্মপরিধির সংকোচনের যুক্তি অবাস্তব ও অসার।


(৫) অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা উচ্ছৃঙ্খলতা: অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি-স্বাধীনতার ধারণা উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর। এই ধারণা সমাজ-সভ্যতার বিরোধী একটি ভয়াবহ ধারণা। স্বাধীনতার অর্থ উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। জনগণের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার জন্য ব্যক্তি মানুষের আচার-আচরণের উপর কিছু পরিমাণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। অন্যথায় অবাধ স্বাধীনতা অরাজকতার সৃষ্টি করবে। এতে সকলের পক্ষে অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ অসম্ভব হয়ে পড়বে।


(৬) দার্শনিক যুক্তির সমালোচনা: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের দার্শনিক যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র কোন সত্তা বা অস্তিত্ব নেই; এ হল ব্যক্তিবর্গের সমষ্টি মাত্র—এই ধারণা ভ্রান্ত। আদর্শবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনুসরণে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র সত্তা ও রূপ আছে। তা ছাড়া, 'ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়' এই মত স্বীকার করলে রাষ্ট্র সমষ্টির স্বার্থে, বিশেষতঃ দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তিদের স্বার্থে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সংকুচিত করার প্রশ্ন ওঠে না।


(৭) রাষ্ট্র অশুভ নয়, কল্যাণকর: রাষ্ট্র মাত্রেই অকল্যাণকর ও অশুভ নয়। কোন কোন রাষ্ট্রের কিছু জনবিরোধী কাজের জন্য সকল রাষ্ট্রই ব্যক্তিস্বার্থের বিরোধী—এ কথা বলা যায় না। এখনকার কোন রাষ্ট্র কেবল পুলিসী রাষ্ট্র নয়, সমাজ কল্যাণকর রাষ্ট্র। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। সুতরাং রাষ্ট্র কোন অশুভ প্রতিষ্ঠান নয়। ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণের জন্য রাষ্ট্র অপরিহার্য্য। গেটেল বলেছেন: “History shows that the state is not always an evil, but that much human progress has resulted from state action."


(৮) সমাজের মধ্যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তির যৌথ সত্তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই মতবাদে প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে দেখা হয়। বার্নস তাঁর Political Ideals শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “...individualism suffers from the 'atomism' of the philosophy of the nineteenth century.... Individualism suffers from the unconscious metaphor of atoms.” কিন্তু কোন মানুষকেই কিছু অধিকারযুক্ত বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ সমাজজীবনকে এবং সমাজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিজীবনকে প্রভাবিত করে থাকে। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ব্যক্তির কাজকর্মের সামা প্রতিক্রিয়া ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতকে করা হয় না। মানব সমাজের যৌথ প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে উপেক্ষা করা হয়।


(৯) আর্থনীতিক অধিকার ও স্বাধীনতার অবহেলা: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অধিকার ও স্বাধীনতাকে অবহেলা করা হয় এবং রাজনীতিক স্বাধীনতার উপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের অনস্তিত্ব রাজনীতিক স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা না থাকলে ব্যক্তির পক্ষে রাজনীতিক স্বাধীনতা ভোগ অসম্ভব হয়ে পড়ে।


(১০) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ শ্রেষ্ঠতাবাদ (Elitism)-এর পরিপোষক। এই মতবাদে আর্থ-রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ-সুবিধাকে বাছাই করা কিছু ব্যক্তির মধ্যেই কেন্দ্রীভূত রাখার পক্ষপাতী।


(১১) পুঁজিবাদের রাজনীতিক তত্ত্ব: মার্কসবাদী সমালোচকদের মতানুসারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রাজনীতিক তত্ত্ব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শাসন-শোষণ, দুঃখ-দারিদ্র্য ও নিপীড়নকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী যুক্তিতর্কের দ্বারা সমর্থন করা হয়। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকাশের একটি পর্যায়ে ঔপনিবেশিকতাবাদও সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের দায়িত্বকে অস্বীকার করা যায় না। আপ্‌থেকার (Herbert Apthekar) তাঁর Democracy, Freedom and Revolution শীর্ষক গ্রন্থে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “... individulasim is a luxury of those who own the means of production."


(১২) অভিজ্ঞতার যুক্তি অচল: অভিজ্ঞতার যুক্তি দেখিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যা বলেন তা মেনে নেওয়া যায় না। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্র এখন সুখে-দুঃখে সব সময়ই ব্যক্তির পাশে আছে। ব্যক্তিজীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বহুবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করে চলেছে। 


(১৩) রাষ্ট্রের অকর্মণ্যতার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা রাষ্ট্রের জনকল্যাণ সাধনের ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকেই বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার প্রসারের ফলে রাষ্ট্র এখন ব্যক্তি ও সমষ্টির সামগ্রিক মঙ্গল বিধানে নিযুক্ত। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা আমলাতান্ত্রিক দোষ-ত্রুটি থেকে অনেকাংশে মুক্ত।


(১৪) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিপজ্জনক: অনেকের মতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিপজ্জনক। অবাধ প্রতিযোগিতা, একচেটিয়া করবার, কাঁচামাল আমদানি, পণ্য রপ্তানি প্রভৃতির কুফলক্রমে বাজার দখলের লড়াই-এ পরিণত হয়। এবং এভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের আশংকা দেখা দিতে পারে। এখন বিশ্বযুদ্ধ মানে আণবিক যুদ্ধ, যার অর্থ সামগ্রিক ধ্বংস।


(১৫) অবৈজ্ঞানিক: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ কার্যকলাপের সামাজিক কারণ ও সামাজিক ফলাফল নির্ধারণ করতে পারেনি। তাই মতবাদটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। বার্ণস বলেছেন: "Individualism involves the neglect of the social causes and social results of action."


মূল্যায়ন: সমাজভাবনার বিবর্তন ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের জনপ্রিয়তার ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুত্ব বহুলাংশে লোপ পেয়েছে। তবুও মতবাদটিকে একেবারে মূল্যহীন বলা যায় না। ব্যক্তি মানুষের চারিত্রিক গুণাবলীর স্বাভাবিক বিকাশের উপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুত্ব আরোপকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তা ছাড়া বন্ধাহীন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও মানবতার স্বার্থে সমর্থনযোগ্য নয়। গার্লারের কথায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের তাৎপর্য স্পষ্টতর হয়েছে। গার্ণার বলেছেন: "Individualistic doctrines have emphasised the importance of the individual, the value of self-reliance and freedom, and the baneful effects of excessive state interference with industry and morality."