তত্ত্বনিরপেক্ষ পাঠক হিসাবে শাক্ত পদাবলির সাহিত্যিক মূল্য বিচার করো।

পৃথিবীর সর্বত্র প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সৃষ্টির পশ্চাতে ধর্মীয় প্রেরণা সক্রিয় ছিল। ধর্মীয় প্রভাব হেতু প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যের অনেক নিদর্শনই আধুনিক যুগের মানুষকে আকৃষ্ট করে না। কিন্তু ওই সময়ের অনেক সৃষ্টি মানবিক বোধের পরিচায়ক হওয়ার গুণে কালজয়ী সৃষ্টিতে পরিণত হবার সৌভাগ্য লাভ করেছে। মধ্যযুগের সৃষ্টি বৈষ্ণুব কবিতাগুলি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় সেগুলির আবেদন আজও শিথিল হয়ে যায়নি। রবীন্দ্রনাথের 'পূজা' পর্যায়ের গান ও 'গীতাঞ্জলী'র কবিতাসমূহ ঈশ্বচেতনার হলেও অসাধারণ কাব্যমূল্যের দরুণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহের পর্যায়ে উচ্চারিত। সুতরাং শাক্ত পদাবলি ধর্মীয় পিপাসা ও সাহিত্যরস পিপাসা নিবৃত্তির অফুরন্ত উৎসে পরিণত হতে পারে কিনা আলোচ্য বিষয়।


বস্তৃত লীলাবিষয়ক ও ভক্তিবিষয়ক পদে সাহিত্যরস উদ্ভাসিত হয়েছে। আগমনী বিজয়ার অন্তর্নিহিত লোকায়ত চরিত্রের মর্মকথাটি রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ বিশ্লেষণী দক্ষতায় প্রতিভাত হয়েছে– আমাদের বাঙলাদেশের এক কঠিন অন্তর্বেদনা আছে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক অনভিজ্ঞ মূঢ় কন্যাকে পরের ঘরে যাইতে হয়, সেজন্য বাঙালি কন্যার মুখে সমস্ত বঙ্গদেশের একটি ব্যাকুল দৃষ্টি নিপতিত রহিয়াছে। আমাদের এই ঘরের স্নেহ ঘরের দুঃখ, বাঙালির গৃহের এই চিরস্তর বেদনা হইতে অশ্রুজল আকর্ষণ করিয়া বাঙালির হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসবের পল্লব ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।” আগমনী বিজয়ার প্রায় প্রতিটি পদই মাতা-কন্যার মিলন-বিচ্ছেদের মানবীয় রসে সিক্ত। রামপ্রসাদ লিখেছেন–

গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না।

বলে বলবে লোকে মন্দ, কারো কথা শুনবো না।


মাতৃহৃদয়ের সুপ্ত বাসনাটি এখানে অপরূপ কাব্যের ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। শাক্ত কবিগণ আগমনী সঙ্গীতে কন্যার জন্যে মাতৃহৃদয়ের আশঙ্কা, মিলনের উল্লাস যেভাবে বাণীরূপ লাভ করেছে তাতে পাঠকের সাহিত্যরস পিপাসা চরিতার্থ হয়, কাব্যগুণে এগুলির মূল্য অস্বীকার করা যায় না।


শাক্ত কবিগণ বিজয়া সংগীতের অন্তর্ভেদী হাহাকারটি হৃদয় নিঙড়ানো ভাষায় রচনা করেছেন। উমা বিদায়ের দৃশ্যগুলি বিজয়ার পদগুলিতে এক ধরনের বিষাদময়তার সৃষ্টি করেছে। উমার বিদায়লগ্নে বেদনামথিত মাতৃহৃদয়ের চিত্রটি অসাধারণ কাব্যসুষমায় ব্যক্ত হয়েছে–

“এস মা, এস মা উমা, বলে না আর যাই যাই।

মায়ের কাছে, হৈমবতি, একথা মা আর বোলতে নাই॥

বৎসরাত্তে আসিস আবার ভুলিস না মায়, ওমা আমার।

চন্দ্রাননে যেন আবার মধুর 'মা' বোল শুনতে পাই।”


পৌরাণিক শিব-উমা কাহিনির সঙ্গে হর-গৌরীর লোকায়ত কাহিনি মিশ্রিত হয়েছে আগমনী-বিজয়ার গানে। শাক্ত পদাবলির আগমনী বিজয়া পর্যায়ে ধর্মসংগীত গীত হলেও যথার্থ কাব্যগুণান্বিত। ভক্তিরসাশ্রিত পদগুলির কাব্যমাধুর্যের উৎস সমাজকে নিয়ে। আর এই কারণে প্রত্যক্ষ দৃষ্ট সমাজের অভিজ্ঞতাই কাব্যে সাহিত্যে স্থান পায়। শাক্ত পদাবলির জন্মলগ্নের অর্ন্তবেদনার সঙ্গে প্রাত্যহিক জীবনের সংসার যাতনা ও দৈন্য দুর্দশার হৃদয়ার্তি ‘ভক্তের আকৃতি'র কাব্যসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।

‘দুষ্ট ছেলে কষ্ট দেয় মা, মা বিনে কে কষ্ট সয় মা

তুই বিনে মোর কে আছে মা, কে দেখে মা ছেলেবেলা।


বস্তুত কীভাবে আত্মসংকট, জীবনযাত্রার ও যুগসমস্যাকে অতিক্রম করে আস্তিক্যের শেষ সোপানে, অর্থাৎ মাতৃচরণে আশ্রয় নিয়ে ভক্ত আপন অস্তিত্বকে স্থাপন করেছেন, ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদগুলিতে তা ব্যক্ত হয়েছে। ভক্তিগীতির সাথে সাথে কাব্যমূল্যও অবহেলার যোগ্য নয়, এবং আধ্যাত্ম পিপাসার চরিতার্থতা ভক্তের আকুতি পর্যায়ে লক্ষ্যণীয়। আবার অধিকাংশ পদই আবেগের আস্তরিকতায় সকরুণ, গভীর হৃদয়বেদনায় মর্মস্পর্শী। নৈরাশ্য-পীড়িত-'আর্ত মানুষের বেদনার ছবি আভাসিত হয়ে আলোচ্য পদগুলির সাহিত্যিক আবেদনকে স্পষ্টতর করে তুলেছে। বাৎসল্য প্রতিবাৎসল্যের বিচিত্র স্তর পর্যায় এবং মনস্তত্ত্বনির্ভর মান অভিমানের সূক্ষ্ম ক্রমবিন্যাস, জগজননী ত্রিভুবনেশ্বরীকে স্নেহবিহ্বল করুণায় ঢলঢল রূপের আধারে প্রতিষ্ঠিত করে শাক্ত পদকর্তারা বাংলা ভক্তিগীতির ধারায় যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছেন তার সাহিত্যিক মূল্য ছিল বলেই আজও বাঙালি পাঠক ও শ্রোতার কাছে ওইসব পদের মাধুর্য বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি।


সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লক্ষণ হল সরলতা। 'ভক্তের আকৃতি পর্যায়ের পদগুলি অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা। আর এর কাহিনিধারা সংগৃহীত হয়েছে লোকায়ত জীবনকে কেন্দ্র করে। একজন সমালোচক বলেছেন যে, ভক্তের আকৃতি বদ্ধ জীবের ভয়াবহ চিত্র। তাই পদাবলিতে ভক্তির এক নিবিড় স্নিগ্ধ রূপ আবিষ্কৃত হল–

“কী দিয়ে করিব পূজা, কী বল আছে আমার?

তুমি গো অখিলেশ্বরী সকলি যে মা তোমার”


শাক্ত পদাবলিতে শক্তি সাধনাকে বাঙালির নিজস্ব সাধনা বলে অভিহিত করলে কিছু ভুল হবে না। ধর্মীয় আচার-আচরণ অথবা শাস্ত্রীয় মন্ত্রতন্ত্রাদির বিশিষ্টতা এক রসমূর্তি লাভ করেছে শাক্তসঙ্গীতে। বস্তুত শাক্ত পদের বিভিন্ন পর্যায়ে আধ্যাত্মিকতা ও কাব্যরস এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে তাতে একটি থেকে অপরটি পৃথক করা দুঃসাধ্য। তাই কবি কালভয়নিবারণী মহাকালিকা যখন নিজের অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন সেখানে শিল্পরূপ প্রকাশ লাভ করে–

‘সদানন্দময়ী কালী মহাকালের মনোমোহিনী 

যখন ব্ৰষ্মাণ্ড না ছিল হেথা মুণ্ডমালা কোথা পেলি।

তখন তাকে মর্ত্যের স্নেহাভিমান চমৎকার রসরূপ লাভ করেছে।


শাক্ত পদাবলির তত্ত্বাশ্রয়ী পদগুলির সাহিত্যিক মূল্য বিশেষ নেই। এগুলি মূলত ভক্তিসংগীত। এইসব পদে ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যিক মূল্য অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু যে সকল পদে মানবমনের চিরন্তন আকৃতি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে অস্তরের বিশ্বাসে, বাৎসল্যের অকৃত্রিম রূপ প্রকাশিত হয়েছে। সমালোচকের ভাষায় – “শাক্ত পদাবলি যুগপৎ দিব্যরস পিপাসা ও সাহিত্যরস পিপাসা নিবৃত্তির এক অফুরন্ত উৎস" ধ্বনিত হয়েছে।