কবিরূপে সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার প্রতিভা নির্ণয় করো।

আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন সূর্যকান্ত নিরালা। মূলত তিনি কবি হয়েও ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নকশা ধর্মী রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আসলে পশ্চিমবঙ্গের শস্যশ্যামলা কোমল মৃত্তিকাতেই নিরালার কৈশোর ও যৌবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হওয়ার ফলে বাংলা সাহিত্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় অনুরাগ। মহিষাদলের রাজপ্রাসাদে থাকাকালীন তিনি সচক্ষে দেখেছেন আর্থিক বৈষম্য ও অনাচার। এখানেই তিনি কিষাণ ও মজুরদের নিয়ে সংগঠন করেছেন এবং অবিচার ও ঘুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। ফলত তাঁর সাহিত্যের উপর পশ্চিমবঙ্গের এক বিশাল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নিরালার কবিতা রচনার সূত্রপাত মুক্তবন্ধ ছন্দে। নিরালার প্রথম রচনা ‘জুহী কি কলী' হিন্দি সাহিত্যাকাশে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল।


কাব্যগ্রন্থ : নিরালার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—পরিমল, গীতিকা, অনামিকা, রাম কি শক্তি পূজা, অনিমা, বেলা, নয়ে পত্তে, অর্চনা, আরাধনা, সান্ধকাকলী, তুলসী দাস ইত্যাদি অন্যতম।


১৯২৯ সালে প্রকাশিত নিরালার ‘পরিমল' এবং 'গীতিকা' কাব্যগ্রন্থে তার প্রতিভার যথার্থ স্ফুরণ পরিলক্ষিত হয়। তার সৌন্দর্য বোধ, সমাজচেতনা, অধ্যাত্ম বোধের সঙ্গ আবেগ প্রবণতা ও সমাজ চেতনার সার্থক সমন্বয় এই কাব্যদ্বয়ে মেলে। ছায়াবাদী যুগের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, রোমান্টিকতা, সৌন্দর্যবোধ, ও শিল্প চেতনার যথার্থ সমন্বয় নিরালার এই কাব্যদ্বয়ে মেলে। হিন্দি কাব্য ছন্দে মুক্ত ছন্দের সূচনা ‘পরিমল’ কাব্যেই দেখা যায়।‘পরিমল’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন—“মনুষ্যে কী মুক্তি কী তরহ কবিতা কী ভী মুক্তি হোতী হ্যায়, মনুষ্যে কী মুক্তি কর্মকে বন্ধন সে ছুটকারা পানা হ্যায় আউর কবিতা কী মুক্তি ছন্দো কে শাসন সে অলগ হো জান হ্যায়।” ‘পরিমল’ কাব্যগ্রন্থের ‘জুহি কী কালী’, ‘বিধবা’, ‘ভিক্ষুক', ‘পঞ্চবটী’ ইত্যাদি কবিতায় কবির আধ্যাত্মবাদী রহস্য ব্যঞ্জনা এবং দার্শনিক গভীরতার সুষম সমন্বয় ঘটেছে।


‘অনামিকা’ নিরালার একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ, উত্তরকালের রচনাধারা ও কবি মানসিকতার ভূমিকারূপে এই কাব্যটিকে ধরা হয়ে থাকে। প্রিয় কন্যা সরোজের মৃত্যুতে কবির হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে এবং লেখেন ‘সরোজ স্মৃতি' নামক কবিতা, যেটি স্থান পায় আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে। এছাড়া ‘তোড়তী পাথর', 'দাস', 'বনবেলা' ইত্যাদি কবিতা এতে স্থান পেয়েছে।


‘তুলসীদাস’ ও ‘রাম কী শক্তিপূজা' এই দুটিই নিরালার প্রবন্ধাত্মক কাব্য। এই কাব্যদ্বয়ে কবির গভীর সমাজ চেতনা, ঐতিহ্যবোধ, ভারতীয় সংস্কৃতির ধারার সঙ্গে কবির ভক্তি, শ্রদ্ধা, পাণ্ডিত্য ও দার্শনিকতার সমন্বয় ঘটেছে। যেমন—'তুলসীদাস' কাব্যে তুলসীদাসের মানসিকতা উপলব্ধি করে তার ভক্তি ও জীবনাবরণের নবরূপায়ণ ঘটিয়েছেন কবি। ভারতবর্ষের অতীত সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অসাধারণ চিত্রণ এই কাব্যে মেলে। আবার ‘রাম কী শক্তি পূজা' কাব্যে পৌরুষের এক অপরাজেয় মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্য ব্যর্থতা জয়পরাজয়ের ঊর্ধ্বে এক বলিষ্ঠ জীবন দর্শনের কথা এইকাব্যে ধ্বনিত হয়েছে।


পরবর্তীকালের কাব্যসমূহ অকর্মা, আরাধনা ও গীত গুঞ্জে কবি চিত্তের আত্মনিবেদন স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই কাব্যগ্রন্থগুলি তার ভক্তিগীতির সংকলন। এই কাব্যে কেবলমাত্র ভক্তির করুণা ধারাই নয়, আধ্যাত্মিকতা, করুণা এবং শান্তিকামনার লক্ষণও স্পষ্ট।


পরবর্তী পর্যায়ে সামাজিক অন্যায়, শোষণ, অনাচার এবং অনৈতিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কবির লেখনী খড়ড়্গহস্ত হয়ে উঠেছে। ‘কুকুরমুক্তা কাব্যগ্রন্থে পুঁথিবাদীদের বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন কবির ব্যঙ্গাত্মক কষাঘাত ধ্বনিত হয়েছে।


কবির বস্তুবাদী এবং প্রগতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটেছে—'নয়ে পত্তে’ কাব্যগ্রন্থে। ‘তোড়তী পাথর’ কবিতায় কবির এই মনোভাবের সূচনা হলেও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছে ‘নয়ে পত্তে’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যে উর্দু শব্দের বেশ কিছু ব্যবহার দেখা গেছে, হিন্দি ও উর্দুর সংমিশ্রণে এই কাব্যের ভাষা বহুলাংশে গদ্যধর্মী হয়ে উঠেছে।


উর্দু গজল এবং লোকগীতির প্রভাবে কবির ‘বেলা' কাব্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, হিন্দি সাহিত্যে সচেতন ভাবে উর্দুভাষার প্রয়োগ এই কাব্য থেকেই শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে। ফলে হিন্দি সাহিত্য ভাণ্ডার বহুলাংশে সমৃদ্ধ হয়েছে।


নিরালার সংগীত সাধনার প্রতিও বাংলার প্রভাব লক্ষ করা যায়, যেমন—বাংলায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ‘রাম কী শক্তি পূজা' রচনা করেন, সেখানে তিনি লিখেছেন—

অন্যায় জিধর হ্যায় ওধর শক্তি আউর রাবণ 

অধর্মরত ভী, আপনা, ম্যায় হুয়া অপর

যহ বহা শক্তি কা খেল সমর, শংকর শংকর।


আবার ‘গীতিকা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি যে সরস্বতীর চিত্র অঙ্কন করেছেন তাকে তুলনীয় করে বলা যায়—

“বর দে বীণা বাদিনী বরদে 

প্রিয় স্বতন্ত্র রব অমৃত মন্ত্র নব

ভারত মে ভরদে।"


অন্যদিকে, নিরালার কবিতায় প্রকৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট তিনি উপলব্ধি করেছেন প্রকৃতি তাঁকে নৈরাশ্যের হাহাকারের মাঝে পুনর্জাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছে। প্রকৃতি চিন্তা ভাবনাই নিরালাকে হিন্দি সাহিত্যে অগ্রগণ্য আসন দান করেছে।


সর্বোপরি, নিরালার সাহিত্য সৃষ্টির সামগ্রিক আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে, তিনি অপরাজেয় পুরুষকারের অধিকারী ছিলেন। তার চির বিদ্রোহী আত্মা কারও করুণাধারায় অভিষিক্ত হতে চায়নি কখনো, তিনি ছিলেন আপোষহীন সংগ্রামী। দারিদ্র্যের কষাঘাত, ভাগ্য বিপর্যয়, স্বজন বিয়োগ তাকে তাঁর সাহিত্য সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। আপোষহীন সংগ্রামী মানসিকতা তার সাহিত্য-সেবার মূল বৈশিষ্ট্য। জীবনে রস সুধা তিনি আকণ্ঠভরে পান করেছেন তার সাহিত্য সৃজনের মধ্য দিয়ে। তার তোড়তী পাথর’ কবিতার দুটি পঙ্ক্তি -

“দেখা মুঝে উস দৃষ্টিসে,

জো মার খা রোই নহী।”

অর্থাৎ আমাকে সেই দৃষ্টি সহকারে দেখেছো, যে আঘাত পেয়েও কাঁদেনি। তাঁর আপসহীন সংগ্রামী জীবনবোধের মূলমন্ত্র হিসাবে এটি পরিগণিত হতে পারে।


ছায়াবাদী কবি নিরালা : পাণ্ডেয় বেচন শর্মা বলেছেন যে নিরলা ক্রান্তিকারী কবি— আধুনিক হিন্দি কবিদের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা আধুনিক। ছায়াবাদী বেশিরভাগ কবিই খড়ী বোলীতে (দিল্লি-মীরাট অঞ্চলের ভাষায়) কবিতা না লিখে ‘খরী বোলীতে (যে বোলী পরিশুদ্ধ) কবিতা লিখেছেন। বিশেষ করে নিরালা-জীর হাতে হিন্দি কবিতার ভাষায় অনেক ক্ষেত্রেই বাংলা কবিতার তৎসম শব্দ-প্রাধন্যকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। হিন্দি ছায়াবাদী কবিদের মধ্যে শ্রীমতী মহাদেবী বর্মা অনন্যসাধরণ হলেও তার কবিতা বিশ্লেষণ আমাদের আলোচনার বাহিরে। কেননা তিনি কবি হিসেবে মীরাবাঈ, তরু দত্ত, শ্রেণিভুক্তা হলেও তাঁর কবিতা বাংলার প্রত্যক্ষ প্রভাবজাত নয়। এই যুগের সমাজনীতি রাজনীতি-মূলক কবিতা কখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর অতিক্রম করেনি। ছায়াবাদ নিয়ে আলোচনা অনেক হিন্দি সমালোচকই করেছেন এবং অনেকেই সুবিচার করেননি। পণ্ডিত রামচন্দ্র শুক্লের মতো একজন বিশিষ্ট সমালোচকও ছায়াবাদী কবিদের প্রশংসা করেননি। কেউ কেউ 'ছায়াবাদ'কে নিছক রবীন্দ্রনাথের ছায়াবাদ বলে বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাবান্বিত কবিতা হলেই কি তা মূল্যহীন হবে? ছায়াবাদীরা অনেক ক্ষেত্রে অনুকরণ করেছেন বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা মৌলিকত্বে সমুজ্জ্বল। অন্তত অনেকক্ষেত্রেই ছায়াবাদীদের অনুকরণ-প্রচেষ্টা হিন্দি সাহিত্যের অলংকরণ প্রয়াস মাত্র। এ বিষয়ে সমালোচক শ্রীনন্দদুলারে বাজপেয়ী-জী ঠিকই বলেছেন। সুমিত্রানন্দনে রবীন্দ্র-প্রভাব বিষয়ে আলোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘উসে অপহরণ ন কহ কর অলংকরণ কহন চাহিয়ে। কথাটা ঠিকই। ছায়াবাদী কবিরা, বিশেষ করে যাঁদের কথা আমরা এই পরিচ্ছেদে আলোচনা করেছি, তারা সত্যিকার প্রতিভাসম্পন্ন কবি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের অনেক কবিতাই অনুকূল অভ্যর্থনা পাবে সহৃদয়-হৃদয়ের কাছে। তাই হিন্দি যাঁদের মাতৃভাষা তাঁরা নিশ্চয়ই আধুনিক হিন্দি কবিতা নিয়ে গর্ব্ব করবেন। আর বাংলা যাদের দেশ এবং ভাষা, তাঁরাও সে গৌরবের অংশীদার। যে কবির ভাব ও ভাবনার আলোছায়া বহিবঙ্গীয় সাহিত্যের প্রাঙ্গণে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সঙ্গে বাংলারাই নাড়ীর যোগ রয়েছে।