শাক্তপদাবলিতে যে মরমিয়াবাদ লক্ষ্য করা যায় তার স্বরূপ নিশ্লেষণ করো এবং তার উদ্ভব যে সমকালীন বাস্তবতার মধ্য থেকেই হয়েছিল, তামাদের পাঠ্যপদ অবলম্বনে তা যুক্তিসহ দেখাও।

শাক্তপদাবলির ‘আগমনী বিজয়া’ গানে আপামর বাঙালির হৃদয় বদনা মথিত। এই গানে বাঙালির জীবনের মা-মেয়ের সম্পর্কের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। শাক্ত কবিরা জগজ্জননী উমাকে ঐভাবে ঘরের মেয়েরূপে কল্পনা করতে পেরেছে বলেই শাক্ত সংগীত এত জনপ্রিয় হয়েছে।


‘আগমনী বিজয়া’ কাহিনি দুটি পরিবার নিয়ে গঠিত একটি গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার পরিবার। অপরটি দেবাদিদেব মহাদেব ও জগজ্জননী উমার পরিবার। কাহিনিতে প্রায় সমগ্র অংশে বর্ণিত হয়েছে উমা কিছুদিনের জন্য পিতা হিমালয়গৃহে আসার পর মাতা মেনকার যে তীব্র আকুতি, পটভূমির কাহিনিকে গতি দান করেছে। সমগ্র কাহিনিতে মেনকা মুখ্য। তার উমার অদর্শনজনিত বিরহযন্ত্রণা নিয়ে কাহিনির সূচনা। মাত্র তিনদিনের জন্য উমার আগমন, কিন্তু জননী তাতে তৃপ্তি পায় না। তার বাসনা-

‘ঘরে জামাতা করে রাখবো কৃত্তিবাস, 

গিরিপুরে করবো দ্বিতীয় কৈলাস।

মেনকার এই কল্পনা কল্পনামাত্রই বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি।


কন্যার মঙ্গল কামনায় মা বিভোর। রাত্রিদিন সে কন্যার চিন্তায় মগ্ন। তাই রাত্রে স্বপ্ন দেখে তার বাল্যকন্যা উমা শ্মশানে আছে একাকিনী। এ দেখে মায়ের মন আর স্থির থাকে না। তিনি পতি গিরিরাজকে গঞ্জনা দিয়ে কন্যাকে পিতৃগৃহে আনয়নের জন্য বলে—

'বিলম্ব না করো হে, গৌরী আনিবার।'


শুধু তাই নয়, স্বপ্নে উমা অনুযোগ করেছে কেন মা তার সংবাদ নেয় না। তাই গিরিরাজকে মেনকা কৈলাসে গমন করার জন্য বলে। শিব জামাতা জগৎপূজ্য তাই তাকে সন্দেশ, বিল্বপত্র এবং গঙ্গাজলে তুষ্ট করে শিবের অনুমতি পেয়েই যেন ঊমাকে নিয়ে আসে।


আগমনী বিজয়া কাহিনি অংশে বাস্তব চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। উমা পিতৃগৃহে এলেন। প্রতিবেশীর কাছ থেকে উমার আগমনের বার্তা শুনে মেনকা ছুটে গিয়ে কন্যাকে বুকে তুলে নেয়। কন্যার কুশল জিজ্ঞাসা করেন। কখনো অভিমানিনী উমা বলেন—'কৈ মেয়ে বলে আনতে গিয়েছিলে। বিভিন্ন জনের মুখে মেনকা শিবের ভিক্ষাবৃত্তি, শ্মশানবাসের কথা শুনেছেন। মেনকা উমার কাছে সত্যি কথা জানতে চায়, উমা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন—

“ছিলাম ভালো জননী গো হরেরি ঘরে।

কে বলে জামাই তব শ্মশানেতে বাস করে।।”


মেনকা উমাকে ছাড়তে চান না। উমা শিবগৃহে যাবার জন্য যখন উদ্যত তখন মেনকা গিরিরাজকে উদ্দেশ্য করে কাতর প্রার্থনা জানায়।


“আমার গৌরীকে লয়ে যায় হর আসিয়ে

কি কর হে গিরিবর, রঙ্গ দেখ বসিয়ে।”


বাঙালি পরিবারের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই শাক্তপদ রচিত। এই অভিজ্ঞতা থেকেই কবিরা মানবমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপায়ণ ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণে অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। শাক্ত কবিরা পৌরাণিক কাহিনিকে বাঙালির গৃহস্থ জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন। তাই অধ্যাপক জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী শাক্তপদাবলির যথাযথ বিশ্লেষণ করে বলেছেন – “শাক্তপদাবলির লীলাপর্ব পৌরাণিক কাহিনির গার্হস্থ্য রস সিক্ত সঙ্গীতময় বাণীরূপ।”.