'রস' কাকে বলে? “কাব্যরসের আঁধার কাব্যও নয়, কবিও নয়—সতুদয় কাব্য-পাঠকের মনে” —আলোচনা করো। ‘বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম্'—বলতে কী বোঝ?

রসের সাধারণ অর্থ হচ্ছে স্বাদ, যা আস্বাদনযোগ্য—তাই হল ‘রস’। বস্তুগত অর্থ ধরলে রসের মানে হয়ে দাঁড়ায়ে নির্যাস ; টক, মিষ্টি, কটূ, তিক্ত প্রভৃতি রস। তবে এখানে আমাদের আলোচ্য হল সাহিত্যের রস।


কাব্য বা সাহিত্যের রস হচ্ছে একরকম আনন্দের আস্বাদ। পাঠক যখন কাব্য পাঠ করে এক অনির্বচনীয় আনন্দের আস্বাদ পান—তখন বুঝতে হবে তিনি ওই কাব্যের রস উপলব্ধি করেছেন।


আসলে রস হচ্ছে উপলব্ধির বস্তু; সহৃদয় পাঠক যখন কাব্যের স্বাদ গ্রহণ করে আনন্দলাভ করেন—তখনই কাব্যে রস আছে বলে পাঠক বুঝতে পারেন। সুতরাং রস হচ্ছে সহৃদয় হৃদয়সংবাদী। আলংকারিকেরা এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে কাব্যরসাস্বাদী সহৃদয় লোকের মনের বাইরে রসের আর কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ আস্বাদের যে আনন্দ—তাই রস। শ্রীযুক্ত অতুলচন্দ্র গুপ্ত সংক্ষেপে বলেছেন যে ওই আস্বাদই হচ্ছে রস।


রসের আস্বাদ, কিংবা রসের প্রতীতি বা অনুভূতি প্রভৃতি বলা ঠিক নয়, কারণ কাব্যের আস্বাদই ত’ রস ; ঠিক তেমনি প্রতীতি বা অনুভূতিই হচ্ছে রস। দরদী ও সহৃদয় কাব্য পাঠকের সুকাব্যপাঠজনিত চিত্তের অনুভূতি বিশেষের নামই রস। তাই বলা হয়ে থাকে যে কাব্যরসের আধার কাব্যও নয়, কবিও নয়—সহৃদয় কাব্যপাঠকের মন।


পাঠকের অনুভূতি লোকই রসের স্থান—তাই বাইরের রস বলে কিছু নেই। তাই রসের কোনো সহজ সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। সহৃদয় পাঠকের চিত্ত হল রসের আস্বাদনকারী, তাই এই রসকে অলৌকিক বলতে হবে। এ যেন 'ব্রহ্মাস্বাদসহোদরঃ' অর্থাৎ পরমাত্মার আস্বাদতুল্য ব্রষ্মকে জানা যেমন অলৌকিক ব্যাপার, সাহিত্যের রসাস্বাদজনিত আনন্দও লোকাতীত, রস নিজের আনন্দময় চেতনার আনন্দরূপ। আলংকারিকেরা রসকে যেমন অলৌকিক বলেছেন, তেমনি বলেছেন যে রসাত্মক বাক্যই হল কাব্য।


এই লোকোত্তর রস যখন এক ধরনের মানসিক অবস্থা, তখন কী করে সেই মানসিক অবস্থা ঘটে—তা জানার আগ্রহ হতে পারে।


আমাদের মনে অসংখ্য ভাব আছে, তাদের মধ্যে কতকগুলি হল স্থায়ী বা চিরন্তন ভাব, আর কতকগুলি হল অস্থায়ী ভাব। স্থায়ী ভাবগুলিই প্রধান এবং সম্রাটের মতো ; এরা অক্ষয়, অব্যয়; মানুষের মনে এরা চিরন্তন সংস্কার হিসেবে থাকে, এদের সংজ্ঞা হল ন'টি ; যথা—রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় ও শম।

রতিহাসশ্চ শোকশ্চ ক্রোধোৎসাহৌ ভয়ং তথা।

জুগুপ্সা বিস্ময়শ্চেখমষ্টো পোত্তাঃ শামোহপিচ ৷৷


চিত্তের মধ্যে অজস্র ভাবের মধ্যে এদের বিশিষ্ট রূপ বহু রকমেই প্রতীয়মান হয়—তাদের মধ্যে এদের স্থায়ীভাব বলা হয়েছে। এই স্থায়ীভাব ছাড়া রস সৃষ্টি হয় না।


রসকে লৌকিক বলা যায় না। রসের মৌলিক উপাদান হল স্থায়ীভাব, আর তা লৌকিক বা বস্তুসত্যের মতো প্রত্যক্ষগম্য। শোক, হর্ষ প্রভৃতি নানা লৌকিক কারণ মানুষের মনে শোক, হর্ষ প্রভৃতি লৌকিক ভাবের জন্ম দেয়, কিন্তু এই লৌকিক ভাবগুলি কাব্যের জগতে অলৌকিক রূপ লাভ করে, কারণ এইসব লৌকিক ভাবের যে বৃত্তি বা বাসনা আছে, তারই সাহায্যে এ অলৌকিক বস্তুতে পরিণত হয়। ('বাসনা' সম্পর্কে পরে আলোচনা করা হয়েছে—তা দ্রষ্টব্য।) কবি আপন মনে মাধুরী মিশিয়ে এই লৌকিক ভাবকে যখন অলৌকিক পর্যায়ে তুলতে পারেন, অনিবচনীয়ত্ব দান করতে পারেন—তখনই রসের সৃষ্টি হয়। শোক যখন ব্যক্তিগত—তখন তা বেদনার বিষয়, কিন্তু কবি যখন নিজের সংবেদনশীলতা দিয়ে একে করুণরসে পরিণত করেন, তখন তাতে শোকের কষ্ট থাকে না, অলৌকিক আনন্দরস হাজির হয়। কাব্যরসের অনুভূতিতে ভাবের সঙ্গে অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা জড়িত থাকে না, কবি নিজের প্রতিভার জাদুতে এই ভাবকে ব্যক্তিচেতনারহিত করেন তখন সেই রচনা পাঠে সহৃদয় মানুষ খুশি হয়। বলা বাহুল্য, এই আনন্দের আস্বাদই হল রস। স্থায়ীভাবে রসে রূপান্তরিত হয়, এবং তা হয় কয়েকটি পদ্ধতির মাধ্যমে। এই পদ্ধতিগুলির নাম বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারী বা ব্যভিচারীভাব।