“মুকুন্দ দুঃখবাদী নন, খুব জোর তাঁকে দুঃখীবাদী বলা যেতে পারে।”— তোমাদের গঠিত 'কবিকঙ্কণ চণ্ডী'র অংশ অবলম্বনে মন্তব্যটির পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে নিজের অভিমত প্রতিষ্ঠিত করো।

বাস্তব জগতে দুঃখ-দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই অপরিহার্য বিষয় সম্পর্কে কবিগুরু একদা বলেছিলেন— “দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?” এ অমরবাণী মনুষ্য জীবনের সতত সত্য । এই দুঃখ-দারিদ্র্য কষ্ট-বেদনাকে লাঘব করার জন্য, দেবতার কৃপায় নিত্য অমৃতলোক লাভের আশাই সকল মঙ্গল কবির কাব্য রচনার মূল ও অন্যতম উদ্দেশ্য। কবি মুকুন্দরাম তার ব্যতিক্রম নন। জীবনের হাসি-কান্নার মালা গেঁথে কাব্যলক্ষ্মীর গলায় পরিয়ে দিয়েছেন। তবে মুকুন্দরামের উপস্থাপনা ভঙ্গি একটু ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়েছে। কারণ অন্য কবিরা যেখানে কাল্পনিক সুখ সমৃদ্ধি বর্ণনায় সর্ববিধ দূর্দৈব থেকে মুক্তির আনন্দময় ভবিষ্যৎ রচনায় ব্যস্ত তখন মুকুন্দরাম সেখানে বাস্তব জীবনের প্রত্যাহিক জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা বর্ণনায় একাগ্র চিত্ত। তাই তাঁর কাব্যে তিনি দৈব প্রসাদতৃপ্ত আনন্দময় জীবনের চেয়ে বাস্তব জীবনের দুঃখ কাহিনিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই তো দেবীর আশ্বাসবাণী অপেক্ষা পশুগণের দুঃখ বর্ণনায় তিনি বেশি ব্যাকুল, উদ্দীপ্ত। এই জন্যই মনে হয় ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ’, ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’, ‘হরগৌরীর দারিদ্র্যচিত্র’, ‘বনের পশুদের দুঃখ নিবেদন প্রভৃতির উল্লেখ করে দুঃখবাদী মনোভাবের প্রমাণ দিতে চেয়েছেন।


কবির কাব্যে দুঃখবর্ণনার আধিক্য দেখে একথা পাঠকের মনে হতে পারে, কবি দুঃখবাদী। কিন্তু এ ধারণা মুকুন্দরাম প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। যিনি জীবন-রস রসিক কবি তিনি জীবনে দুঃখের কষাঘাত খেলেও দুঃখকে বেশি আমল দেন না। দুঃখ-দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতা তাঁর মানসপটে চিত্রিত হলেও তাঁর মনকে নৈরাশ্যবাদের অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করতে পারে না। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখবোধ তাঁর মনকে অপরের প্রতি সহমর্মী করে দেয়। মুকুন্দরাম জীবনে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর কাব্যে কোথাও তিক্ততা পরিবেশিত হয়নি। প্রথমেই কবি তাঁর আত্ম-জীবনী অংশে, মধ্যযুগীয় বাংলা দেশকে আমাদের সমক্ষে তুলে ধরেছেন। ডিহিদার মামুদের অত্যাচার যে কি অসহনীয় তা তিনি এই অত্যাচারের বর্ণনায় দেখিয়েছেন—

“জানদার প্রতি নাছে    প্রজারা পালায় পাছে

দুয়ার চাপিয়া দেই থানা।

প্ৰজা হৈয়া ব্যাকুলি    বেচে ঘর-কুঠালি

টাকার দ্রব্য দশ আনা।।"


চণ্ডীর নিকট বনের পশুদের দুঃখনিবেদনের মধ্যে কবির ব্যক্তিগত জীবন-দুঃখের অন্বেষণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। ক্ষুদ্র সজরু থেকে বৃহৎ হস্তী পর্যন্ত কেউ কালকেতুর হাতে রেহাই পায়নি। আবার ফুল্লরার বারমাস্যার কাহিনির কথা মনে রেখে কেউ কেউ তাকে দুঃখবাদী কবি বলে অভিহিত করেছেন। চণ্ডী কালকেতুকে এত ধনরত্ন দিয়েছিলেন যে তা দিয়ে কালকেতু নিজর দুঃখ দারিদ্র্যকে দূর করে বিলাসিতায় গা ভাসাতে পারত। তবে সে তা করেনি কেন ? কালকেতুর সংসারে বরাবরই দুঃখ ছিল। ফুল্লরা কোন দিনই তার জন্য হতাশাগ্রস্ত হয়নি। স্বামী শ্বশুর শাশুড়ীর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে তাকে বাইরে যেতে হয়েছে। ফুল্লরার বারমাস্যা কাহিনিতে পতি অনুরাগের যে প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে তা চণ্ডীমঙ্গলের কাব্যরসকে আরও ঘনীভূ ত করেছে।


এতদ্ সত্ত্বেও বলতে হয় 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে দুঃখের ছবি অঙ্কিত হয়েছে—‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ বর্ণনা প্রসঙ্গে—

“তৈলবিনা কৈলস্নান   করিলু উদকপান

শিশু কাঁদে ওদনের তরে।”

এই উক্তির মধ্য দিয়ে দুঃখের ছবি প্রকাশিত হয়েছে।


দেবখণ্ডে হর গৌরীর যে সাংসারিক চিত্র চিত্রিত হয়েছে তা মানবজীবনেরই বাস্তবিক রূপ। শিব লোভনীয় আহারের বাসনা জানালে গৌরী বলে—

“রন্ধন করিতে ভালো বলিলে গোঁসাই।

প্রথমে যে দিব পাত্র তাই ঘরে নাই।।”


এ হাহাকার বর্ণনায় কবিকে দুঃখবাদী বলা সঙ্গত হবে না। সাংসারিক জীবনে নানা দুঃখ থাকতে পারে তাতে ‘দুঃখবাদী'র প্রশ্ন উঠছে কেমন করে?


তবে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দেবমাহাত্ম্যের অন্তরালে বাস্তব জীবনের রসাস্বাদন করা হয়েছে বলে কোথাও কোথাও দুঃখের আভাস মেলে। ফুল্লরার বারমাস্যা আখ্যান অংশটিতে ফুল্লরা ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডিকাকে তার বারমাসের দুঃখের কথা শোনাচ্ছে। বছরের ছয় ঋতুতে সে সুখের মুখ দেখেনি। বৈশাখের দাবাদাহ রোদে পসরা নিয়ে যাওয়া কি কষ্টকর। পরণে ছোট কাপড় মাথায় ঢাকতে গেলে দেহ অনাচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে গৃহস্থরা সম্বল শূন্য হয়ে পড়ে। তার জন্য মাংস কিনতে পারে না তখন তার করুণ অবস্থা। সমগ্র বারমাস্যা জুড়ে ফুল্লরার যে নিদারুণ কাহিনি সে বর্ণনার পিছনে অন্য কারণ আছে

  • ১) ছদ্মবেশিনী দেবীকে তাড়াবার অভিসন্ধি। ফুল্লরার বারমাস্যা কাহিনি বর্ণিত হয়েছে দেবীর কালকেতুর গৃহে আগমনের পরবর্তীকালে।

  • ২) বারমাস্যা কাহিনিতে এত জোর দেওয়ার অর্থ, মুকুন্দরামের কাব্যরসের পথকে নির্মাণ করা।


“উই চারা খাই আমি নামেতে ভাল্লুক। 

নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক॥

পশুদের এই দুর্দশা বর্ণনায় হাস্যরস প্রস্ফুটিত হলেও তাতে মানব আত্মার ক্রন্দনের মুহূর্ত ফুটে উঠেছে। হাস্যারসাত্মক ভঙ্গিমায় করুণরসের প্রকাশ হয়েছে।


অবশেষে বলতে হয়, একটি বিশেষ জীবন দর্শকে রূপদানের জন্য মুকুন্দরাম কাব্য রচনায় হাত দিয়েছিলেন। যুগের প্রথাকে স্বীকার করে তিনি গতানুগতিক কাহিনির ভিত্তিতে নতুন আখ্যান কাব্য গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকের মতো তাঁর বক্তব্যকে আপন জীবন-দর্শনের আলোকে প্রজ্জ্বলিত করেছেন। তাই সমালোচকদের ভাষায় বলতে হয়—“মুকুন্দরামকে দুঃখবাদী বলা যায় না। তিনি প্রসন্ন জীবনের কবি।”