"দূতর পথ গমন ধনি সাধয়ে’ কোন পর্যায়ের পদে কার কোন সাধনার কথা বলা হয়েছে? পর্যায়টির তত্ত্বগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা সূত্রে উল্লিখিত পদটির তত্ত্বগত ও কাব্যগত সৌন্দর্য বিচার করো।

আলোচ্য পদটি গোবিন্দদাস কবিরাজ কর্তৃক ব্রজবুলি ভাষায় রচিত 'অভিসার পর্যায়ের পদ। অভিসার পর্যায়ের পদরচনায় গোবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত বলেই উক্ত পর্যায়ের পদে গোবিন্দদাসকে ‘রাজাধিরাজ' আখ্যা দেওয়া হয়েছে।


আলোচ্য পদটি তিমিরাভিসার ও তমসাভিসারের অন্তর্ভুক্ত। আসলে এটি অভিসার নয়, অভিসারের প্রস্তুতি পর্বরূপে বর্ণিত হয়েছে। অন্ধকার বর্ষা-রজনীতে পথ চলার পক্ষে রাধাকে যে সকল দুস্তর বাধার সম্মুখীন হতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা করেছেন, সে সকল বাধা অতিক্রম করবার জন্যে তিনি কীভাবে মহড়া দিচ্ছেন, আলোচ্য পদটিতে রাধার সেই দুস্তর সাধনার কথাই বলা হয়েছে। অভিসারের সাধনা বাস্তবের সাধনা। তার যে, কষ্ট তা অনেকাংশে লৌকিক কষ্ট। সেই কষ্টকে যখন কাব্যরূপ দান করতে হয়েছে তখন নাটকীয়তা তাতে যুক্ত হয়ে গেছে। রাধিকা অভিসারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ভগবানের সঙ্গে মিলিত হবার সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য হবার অভ্যাস যোগ, দেহমনে সামর্থ্য সংগ্রহের প্রস্তুতি ইত্যাদির কথা এই পদে আছে।


অভিসার পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস। তিনি শুধু শ্রেষ্ঠ নন-রাজাধিরাজের উন্নত মহিমায় বিরাজ করছেন, অপর সকলে তা থেকে শত যোজন দূরে। অভিসার কথার অর্থহল নায়ক বা নায়িকার প্রিয় মিলনের উদ্দেশ্যে সংকেত স্থানে গমন। বৈষ্ণব পদাবলীতে কৃষ্ণের অভিসার অপেক্ষা শ্রীরাধার অভিসারই অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। অভিসারিকার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শ্রীরূপ গোস্বামী ‘উজ্জ্বনীলমণি’ গ্রন্থে জানিয়েছেন-

“যাভিসারয়তে কান্তং স্বয়ং চাভিসরত্যপি

সা জ্যোত্স্নী তামসী যান যোগ্যবেশাভিসারিকা।।"


অর্থাৎ মিলন ব্যাকুলা নারী যখন নিজে অভিসারে গমন করেন, নতুবা প্রিয়তমকে নির্বাচিত মিলনস্থলে অভিসার করান, এজন্য যে নায়িকাকে জ্যোৎস্নাতামসীযোগ্য বেশ পরিধান করতে হয়, তাঁকেই অভিসারিকা বলে।


অভিসারের সঙ্গে মানবজীবনের একটি গভীর যোগ লক্ষ্য করা যায়। রাধার অভিসার আর জীবন-যন্ত্রণার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোন অনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষার তাড়নায় এগিয়ে চলার একটা সঙ্গতি বর্তমান রয়েছে। ব্যাকুল প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে সুদূরকে নিকটে পাওয়া কিম্বা অসীম রহস্যলোকের মধ্যে বিলীন হবার তীব্র প্রয়াসের, এদিক থেকে বিচার করলে ‘অভিসার’ এর একটা আধ্যাত্মিক গৌরবও স্বীকার করতে হয়। গৌড়ীয়, বৈষ্ণব ধর্মের মূলতত্ত্বের মধ্যে অনুরূপ অভিসারের ব্যাপার রয়েছে। প্রচেষ্টা অর্থাৎ এগিয়ে চলাই জীবন—এর সমাপ্তি মিলনে। এটিকে রূপকরূপে গ্রহণ করলেও নায়িকার অভিসারটি রূপক বলে মনে করা হয়না। এর একটা বাস্তব রূপ রয়েছে। ফলত একটা রোমান্টিক মনোভাবই আধ্যাত্মিক গৌরবে সংযুক্ত হয়ে অভিসারের পদে এনেছে বৈচিত্র্য। তাই তো আধুনিক কবি-কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—

‘তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে 

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে

ঝড়ঝঞ্ঝা বজ্রপাতে ।


একালের মনীষী প্রাবন্ধিক প্রকৃতির সত্যের সমান্তরালে এনেছেন অভিসারকে। পৃথিবীর যেমন দুই গতি আহ্নিক ও বার্ষিক একটি স্ববৃত্ত অন্যটি ভবিষ্যতের অভিমুখে পথ পরিক্রমা।


এদিক থেকে বিচার করলে অভিসারকে আমরা ও লৌকিক এবং অলৌকিক উভয় জগতে উপস্থাপিত করতে পারি। অলৌকিক জগতের অভিসার আত্মার অভিসার, ভূমার প্রতি অভিসার, পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার অভিসার। অতএব অভিসারের আধ্যাত্মিক মূল্য স্বীকার করতে হয় আর লৌকিক অভিসারের একটা সুন্দর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যে—

“গচ্ছন্তীনাং রমনবসতিং যোষিতাং তত্র নক্তাং

রুদ্ধালোক নরপতি পাতে সূচী ভেবৈদস্তমোভিঃ।”


মূলত পরম আরাধ্যকে উপলক্ষ্য করেই মানবের প্রিয়র উদ্দেশ্যে প্রতিনিয়ত এই যাত্রা। আত্মবিস্মৃতি, গভীরতা, গতিশীলতা, রূপবৈচিত্র, চিত্রধর্মিতা, নাটকীয়তা সঙ্গীত হিল্লোলের সংমিশ্রণের গোবিন্দদাসের এই পর্যায়ের পদগুলি অনন্ত মহিমায় ভূষিত হয়েছে। সমস্ত বিশ্বের প্রতিকূলতা, সংসারের সমস্ত বিরোধিতার বিরুদ্ধে রাধার যে অভিসার, তাতো মর্ত্য মানবের চিরন্তন যাত্রা। তাইতো কবি আশঙ্কা করে বলেছেন—

মন্দির বাহির কঠিন কপাট।

চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।

তহি অতি দূরতর বাদর দোল। 

বারি কি বারই নীল নিচোল ।।


অর্থাৎ ঘরের বাইরে কঠিন কপাটের বাঁধা, পঙ্কিল পথ চলতে ভয়। তার উপর দুরন্ত বর্ষা ও পিচ্ছিলতা। এই সামান্য নীল বস্ত্রে বৃষ্টির জলধারা বাধা মানে না।


দুর্গম পথে যাত্রার বর্ণনাদানে পদকর্তা গোবিন্দদাস গুরু বিদ্যাপতির পথ অবলম্বন করে লিখেছেন

“কণ্টক গাড়ি   কমল সমপদতলে

মঞ্জুির চীরহি ঝাঁপি।।"


সমস্ত বৈষ্ণুব পদসাহিত্যে গোবিন্দদাসের পদ তুলনারহিত। অভিসারে যাবার পূর্বে রাধার অনুপুঙ্খ অনুশীলন পদটির মধ্যদিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। অবরুদ্ধ ঘরের মাঝে অপরের আপন পায়ের নূপুর বস্ত্র দিয়ে বেঁধে রাধা পথ চলতে চেষ্টা করেন, যাতে নূপুরের নিক্কণ অপরের কর্ণগোচর না হয়। আঙিনাতে কাঁটা পেতে তার উপর দিয়ে চলতে চেষ্টা করেছে যাতে পথের কাঁটা তার গতি রোধ করতে না পারে। পথে সর্পভয় নিবারণের জন্য আপন অলংকার বিক্রী করে ওঝার কাছ থেকে সর্পের মুখ বন্ধ করার মন্ত্র শিখতে সক্ষম হয়েছেন। বিষয়গুলো কবির লেখনিতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। রাধা নির্বিঘ্ন চিত্তে বলতে পেরেছেন—

“মাধব তুয়া অভিসার লাগি। 

দূতর পথ গমন ধনি সাধয়ে

মন্দিরে যামিনী জাগি।”


রাধার এই যে অভিসার-রাত্রিতা বর্ষা গ্রীষ্ম ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পরিব্যাপ্ত। অভিসারের এই বৈচিত্র্যের মধ্যে সাধিত হয়েছে গোবিন্দদাসের শ্রেষ্ঠত্ব।