ফণীশ্বর নাথ রেণুর ছোটোগল্প সম্পর্কে যা জানো লেখো।

হিন্দি কথা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রেমচন্দের সঙ্গে সঙ্গে ফণীশ্বর নাথ রেণুর নাম উচ্চারিত হবার দাবি রাখে। হিন্দি উপন্যাসেই যদিও রেণুর কৃতিত্ব সর্বাধিক তবুও ছোটোগল্পকার হিসাবে তাঁর প্রতিষ্ঠা কোনো অংশে কম নয়। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি ছোটোগল্পের চর্চাও সমান তালে করেছেন। তার সৃষ্ট গল্প সংকলন গ্রন্থের সংখ্যা ন-টি। যথা—

  • ১। ঠুমরি (১৯৫৯); 

  • ২। প্রাণৌ মে খুলে হয়ে রঙ (১৯৬১); 

  • ৩। আদিম রাত্রি কি মহক (১৯৬৭) ; 

  • ৪। অগিনঘোর (১৯৭৭); 

  • ৫। এক শ্রাবণী দোপহরি কি ধূপ (১৯৮৪) 

  • ৬। অচ্ছে আদমী (১৯৮৬); 

  • ৭। রেণু কি শ্রেষ্ঠ কহানিয়াঁ ; 

  • ৮। মেরি প্রিয় কহানিয়া ; 

  • ৯। কাসামু।


গল্পকার রেণুর স্বরূপ বৈশিষ্ট্য নিম্নে আলোচিত হল—


১। ফণীশ্বর নাথ রেণুর গল্পের ভূগোলটি বিস্তৃত কেবল বিহার ও বিহারের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল নয়, বিহার পেরিয়ে কখনো বাংলা, কখনো নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত তাঁর গল্প বিষয় ও পটভূমি ছড়িয়ে গেছে।


২। ফণীশ্বর নাথ রেণুর গল্পে বাস্তবতা ও রোমান্টিকতার যুগ্মস্রোত প্রবাহিত একদিকে তিনি যেমন ছিলেন অভিজ্ঞতা নির্ভর লেখক, বাস্তবের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষক অন্যদিকে আবার রোমান্টিক গল্পের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী।


৩। গল্পকার রেণুর একটা তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল—তিনি একাধারে রিয়ালিস্ট আইডিয়ালিস্ট। কালচেতনা প্রধান বাস্তববাদী কাহিনির মধ্যে একটা জীবনাদর্শের সুর সম্পৃক্ত রয়েছে তাঁর গল্পে।


৪। গল্প বিষয়ে লোকসংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রেণু হিন্দি গল্পের ক্ষেত্রে একটা নূতন মাত্রা সংযোজন করেছেন।

রচিত গল্পের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও ফণীশ্বর নাথ রেণুর গল্প বহুমাত্রাযুক্ত। বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে বহুমাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতার সম্পৃক্তিতে, লোকমনস্ক বিষয় সম্বলিত গল্প রচনা করে তিনি হিন্দি সাহিত্যকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। কিছু গল্পের আলোচনা প্রসঙ্গে এই স্বতন্ত্র গল্পকারের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস এবার করা হল।


রেণু রচিত প্রথম ছোটোগল্প বটবাবা একটি বটগাছকে কেন্দ্র করে রচিত। গ্রামবাসী কর্তৃক দেবতাজ্ঞানে পূজিত হওয়া বটগাছকেন্দ্রিক এ গল্প রেণুর অনন্যসাধারণ শিল্প কুশলতার নিদর্শন। গল্পটিতে রেণুর আত্মজীবনের ছাপ স্পষ্ট। স্বতন্ত্র ভাষারীতি, নাটকীয় রীতির সম্পৃক্তি ও আঞ্চলিক বিষয় গৌরবে গল্পটি রস সার্থক।


রেণু রচিত প্রথম পর্যায়ের গল্পগুলিতে দাঙ্গা, দেশভাগ, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতের দ্রুত পরিবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক সমস্যার গল্প বিষয় হিসাবে গৃহীত। রাজনৈতিক জগতের সুবিধাবাদের চিত্রটিও এ পর্যায়ের বেশ কিছু গল্পে উন্মোচিত হয়েছে। পটিকাভূত, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে, খণ্ডহর, জলওয়া আত্মসাক্ষী এই ধারার গুরুত্বপূর্ণ রচনা। একজন সৎ বিবেকবান মানুষের, রাজনৈতিক কর্মীর মোহভঙ্গের কাহিনি পটিকাভূত গল্পটি। আদর্শের টানে স্বাধীনতা যুদ্ধে নামা সেনানী’র বঞ্চনা ও দুর্দশাপ্রাপ্তি ধর্মক্ষেত্রে গল্পের বিষয়। স্বাধীন ভারতের নৈতিক অবনতির ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে খণ্ডহর ও জলওয়া গল্পে। প্রতীকি গল্প আত্মসাক্ষী। একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট কর্মী গণপতের গভীর ট্র্যাজেডিই এ গল্পের বিষয়। লোভী কমরেড বলরামের চক্রান্তের শিকার গণপত এক সময় দেখে তার পার্টির পতাকা বর্ণহীন হয়ে গেছে।


দ্বিতীয় পর্যায়ে রেণুর গল্পে যে মাত্রাটি সংযুক্ত হয়েছে তা হল বাস্তববাদী জীবন সত্যের সঙ্গে উচ্চ আদর্শের মেলবন্ধন। সংগ্রামশীল মানুষের কথাতে মুখর রেণুর এ পর্বের গল্প। পহলবান বা ঢোলক বিঘটন কে ক্ষণ, তবে একলা চলে রে গল্পগুলি এ ধারার গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। বোধে উত্তরণের কথা পহলবান, চুরমুনিয়া বিজয়া প্রমুখ চরিত্রের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে। তবে একলা চলো রে' গল্পে ব্যক্তির এই উত্তরণ চেতনা তার আত্মানুসন্ধানের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত। এ গল্পের প্রধান চরিত্র কিশন মহারাজের শহিদ হবার মাধ্যমে নতুন মূল্যবোধের জন্ম ঘটেছে।


তৃতীয় পর্যায়ে রেণুর গল্পের প্রধান সুর হয়েছে লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি। রসপ্রিয়া, ভিত্তি চিত্ত কি ময়ূরী, রসুল মিস্ত্রি নেপথ্যকা অভিনেতা এ জাতীয় গল্প। রসপ্রিয়াতে মৃদঙ্গ বাজিয়ে পাঁচকড়ি ভিত্তি চিত্ত কি ময়ূরীতে ভিত্তি চিত্রকর, রসুল মিস্ত্রিতে কারিগর রসুলের অভাব অভিযোগ সুখ-দুঃখ সর্বস্ব জীবন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। নেপথ্য কা অভিনেতাতে এক পারসি নৌটজী দলের বৃদ্ধ অভিনেতার বেদনাপূর্ণ জীবনকথা মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখা হয়েছে। লোক জীবনের অনবদ্য শিল্পরূপ এ গল্পগুলি।


মাটির কাছাকাছির নিতান্ত সাধারণ মানুষের সহজ-সরল জীবন কথাতে পূর্ণ চতুর্থ পর্যায়ের গল্পাবলি। সাধারণ মানুষের সহজ স্বচ্ছ ধর্ম বিশ্বাস, ধ্যানধারণা, উৎসবাদি, রীতি রেওয়াজ সর্বস্ব মিউমধুর ও স্নিগ্ধ জীবন রসের গল্প হল—লালপান কি কোম, সির পঞ্চমী কা সগুন, তীর্থেদক, জড়শু মুখড়া, তিন বিন্দিয়া ইত্যাদি।


পঞ্চম পর্যায়ে রেণু গল্পাবলিতে প্রেমের স্বরূপ রহস্য উন্মোচিত। রোমান্টিক প্রেমের গল্প রচনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পঞ্চ লাইট, তিসরি কসম, এক আদিম রাত্রি কি মহক, নয়না জেগিন ইত্যাদি এ ধারার সার্থক গল্প। সরল সাদাসিধে গোরুর গাড়োয়ান হিরামন ও নৌটঙ্কী দলের বাইজি হীরাবাইয়ের মধ্যেকার অনুচ্চারিত প্রেম মাধুর্যের গল্প তিসরি কসম হিন্দি কথা সাহিত্যের একটি ক্লাসিক গল্প হিসাবে বন্দিত।


আসলে হিন্দি সাহিত্যের 'নট কাহিনী' যুগের গল্পকার ফণীশ্বর নাথ রেণু’ এই যুগে সাহিত্য সাধন শুরু করলেও কালোচিত ‘গ্রামকথা’ বনাম মগর কথার’ বাদানুবাদের বাইরে গিয়েই স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছিলেন। বহুমাত্রিক গল্পশিল্পী রেণু তাই সার্থক ছোটোগল্পকার হিসাবে নন্দিত।