বাংলা কাব্যে শেকসপিয়রের অবদান নির্ণয় করো।

শেকসপিয়র প্রথম জীবনে ‘ভেনাস অ্যান্ড এডনিস’ এবং ‘দি রেপ অফ লিউক্লিস’ নামক দুটি কাব্য রচনা করেন। এছাড়া সনেট রচনাতেই শেকসপিয়রের কবিকৃতিত্ব লক্ষণীয়।


ইতালিতেই সনেট কাব্যরূপের জন্ম। তার প্রসার ঘটে ইউরোপের প্রায় সর্বত্র এবং ইউরোপের বাইরেও সর্বত্র। ইতালির শ্রেষ্ঠ সনেট রচয়িতা দান্তে ও পেত্রার্ক। ইংলন্ডের যারা সনেট রচনায় বিখ্যাত হয়েছেন তাদের মধ্যে শেকসপিয়র, মিলটন ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।


ষোড়শ শতকের শেষ দশকে ইংলন্ডে বিশেষভাবে প্রচলিত হয়েছিল যে সনেট তার প্রাণ প্রতিষ্ঠাও শেকসপিয়রের হাতে। ১৫৯০ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তার সনেটগুলি লিখিত হয়েছিল এবং এগুলি কবির নিজস্ব লিখিত ব্যক্তিগত দলিলরূপে তার বন্ধুমন্ডলীর বলয়ের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে জনৈক প্রকাশক এগুলিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। এই প্রকাশনার উৎসর্গপত্রে বলা হয়েছে The only begetter of these ensuing Sonnets'।


শেকসপিয়রের মোট ১৫৪টি সনেটকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম থেকে ১২৬তম সনেট পর্যন্ত প্রথম ভাগ যেগুলি কোনও এক সুঠাম যুবা বন্ধুর উদ্দেশ্যে রচিত। অবশিষ্ট ২৮টি এক রহস্যময়ী কৃষ্ণবর্ণা নারীর প্রতি সমর্পিত। যুবাবন্ধুর প্রতি কবির অনুরাগ, সংশয় ও ঈর্ষা লাঞ্ছিত কবি মনের ব্যাকুলতা, বিরহ ও মৃত্যু চিন্তার ছায়াপাত, অমর প্রেম ও বিধ্বংসী সময়ের দ্বন্দ্ব, কৃষ্ণবর্ণার প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এক কবির প্রসঙ্গ—সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় আত্মজৈবনিক জীবননাট্যের খসড়া কাব্যরূপ যেন এই সনেটগুচ্ছ।


সনেটগুলি আলোচনার কালে কতকগুলি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথমেই মনে হয় এগুলি নিছক প্রথানুগ কিনা, অথবা এক লেখকের অন্তর্জীবনের কুহেলিকাচ্ছন্ন ইতিহাস‌ কিনা? তারপর মনে জাগে কবির উদ্দিষ্ট বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকের পরিচয় এতে রয়েছে কিনা? এই ব্যক্তি হয়তো আর্ল অফ সাউদাম্পটন। কৃষ্ণবর্ণা রমণী কে ছিলেন—মেরি ফিটন না অন্য কেউ? প্রতিদ্বন্দ্বী কে–জনসন না চ্যাপম্যান? এসব জটিল প্রশ্নের গবেষণার উত্তর যাই হোক ; আমাদের বিচার্য এই সনেটগুলি কবিতা হিসাবে কতদূর সার্থকতা লাভ করেছে।


১ থেকে ১৪ নম্বর সনেট পর্যন্ত কবি তাঁর সুদর্শন যুবাবন্ধুকে অনুরোধ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে তার সৌন্দর্যকে বাঁচিয়ে রাখতে। ১০ নম্বর সনেটের শেষ দুই পঙক্তি ওই বিষয়ে কবির উৎকণ্ঠাকে প্রকাশ করেছে

"Make thee another self, for love of me,

That beauty still may live in thine or thee."


১৫ নম্বর সনেটে কবির প্রথম সময়ের বিনাশী শক্তির বিরুদ্ধে যুবাবন্ধুর সৌন্দর্যকে তার কবিতায় চিরকালের করে রাখার সংকল্প ঘোষণা করলেন। জৈবিক প্রক্রিয়ায় উত্তরসূরীর জন্মদানে অমরত্ব সুনিশ্চিত হয় না। সে নিশ্চয়তা কেবলমাত্র কবিতায় সম্ভব, কারণ কবিতা সময়ের সকল চক্রান্তের নাগালের বাইরে। এ কথাই ব্যক্তি হয়েছে ১৮ নম্বর সনেটে।


সময় যখন চূড়ান্তভাবে মানব বিনাশী, তখন কবি সেই প্রেমকে বিনাশের প্রতিদ্বন্দ্বী এক অবিনশ্বর শক্তিরূপে চিহ্নিত করেছেন। ২৯ নম্বর ও ৩০ নম্বরপ সনেটে সর্বশক্তিমান প্রেমের রূপটিকে জোরালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রেম এখানে ধ্রুব আলোকবর্তিকার মতো। শেকসপিয়র পূর্ণ সনেটের ইতিহাসে প্রেমের এমন রূপ ব্যাখ্যা আমরা পাইনি।


১২৭ নম্বর সনেট থেকে শেষ পর্যন্ত করিতাগুলি মূলত কৃষ্ণবর্ণা রমণীকে নিয়ে। এই রমণী সুন্দরী না হলেও তার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। কবি এই নারীর প্রতি আকৃষ্ট ও তার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ১৪৭ নম্বর সনেটে শেকসপিয়র এই নারীর হাতে প্রতারিত হবার অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন এইভাবে—

'I have sworn thee, and thought thee bright, 

Who are as black as hell, as dark as night.


আবেগের তীব্রতা, অনুভূতির নিজস্বতা ও বৈচিত্র্যে, চিত্রকল্প তথা শব্দানুষঙ্গের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য, কাব্যশৈলীর বিভিন্নতা ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাটকের প্রসাদগুণ যা তাঁর সনেটকে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা।


শেকসপিয়রের সনেটের গঠন উল্লেখের দাবী রাখে। পেত্রার্ক প্রবর্তিত প্রথম আট পঙ্ক্তির অষ্টক এবং শেষ হয় পক্তির যষ্টক, এই বিভাজন শেকসপিয়রের সনেটে নেই। তার পরিবর্তে তিনি চার পক্তির তিনটি স্তবক ব্যবহার করেছেন। এবং শেষে দুই পঙক্তির মিল যুক্ত পদ ব্যবহার করেছে। প্রথম তিনটি স্তবকে 'Quatrain' এবং শেষ দুই পঙক্তিকে 'Couplet'। সামগ্রিক গঠন এই ধরনের ক খ ক খ, গ ঘ গ ঘ, ঙ চ ঙ চ, ছ ছ ছছ। অষ্টক ষটকের মধ্যেকার কিছুটা যান্ত্রিক ছেদের পরিবর্তে এই সাবলীলতা শেকসপিয়রের বিষয়বস্তুর পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক হয়েছে। এছাড়া তরল ব্যঞ্জনধ্বনির ব্যবহার, পদ্যের মধ্যে ও শেষ মিলের প্রয়োগ, ধ্বন্যাত্মক শব্দের ব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে শেকসপিয়র ছন্দের সূক্ষ্ম আকর্ষণকে বাড়িয়ে দিয়েছেন।


বার্নার্ড শ’ দুঃখ করে বলেছিলেন যে, শেকসপিয়র যদি নাটক কিছু কম লিখে অন্তত একটা ভূমিকা রচনা করতেন তাহলে শেকসপিয়র মানুষটা কেমন ছিলেন, তার জীবনবোধ, চেতনা ইত্যাদি কীরূপ ছিল তা আমরা জানতে পারতাম। এই ভ্রুকুটিকে অস্বীকার করে বলা যায় সনেটগুলির মধ্যে শেকসপিয়রের ব্যক্তিস্বরূপ যেন আরেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শেকসপিয়রের এক নৈর্ব্যক্তিক মহামানবের হৃদয় যেন উন্মোচিত হয়েছে এই সনেটগুচ্ছে। সেজন্যই ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেকসপিয়রকে স্বচ্ছন্দে বলেছিলেন—

“With this key

Shakespeare unlocked his heart'


সত্যই শেকসপিয়রের সনেট মুক্তোর মতো কোনটি অশ্রুতে সিক্ত, বেদনায় স্থির দীপ্ত আর প্রণয়াবেগে রক্তিম।