'ভক্তের সংশয়' ও অভিমান শেষপর্যন্ত ‘ভক্তের আকৃতি’ পর্যায়ের পদে কীভাবে ভক্তের পরিণতি পেয়েছে তা দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে লেখো।

রামপ্রসাদ বাংলাদেশে শক্তিতান্ত্রিক সাধনাকে মাতৃসাধনায় রূপান্তরিত করেছেন। রামপ্রসাদের মাতৃসাধনা হল ভাবের সাধনা- সে যে ভাবের ভাবী, ভাব ব্যতীত অভাবে কী ধরতে পারে? শক্তিতান্ত্রিক সাধনা ছিল ক্রিয়া-প্রক্রিয়ামূলক। এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়ামূলক তান্ত্রিকসাধনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবসাধনা। তাই দেহগত যোগসাধনা থেকে হৃদয়ের ভক্তিসাধনাই প্রধান। এই ভক্তিসাধনাতে ভক্তসাধকগণ মাতৃচরণে আশ্রয় পাওয়ার জন্য কাতর প্রার্থনা করেছেন। তাঁদের সাধনা বাৎসল্য প্রতিবাৎসল্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত।


সস্তান যেমন মায়ের কাছে আবদার, মান-অভিমান করে নিজের অন্তরের আর্তি জানায় রামপ্রসাদও তেমনই তাঁর শক্তিদেবীর কাছে অভিমান প্রকাশ করেছেন এবং নিজের দুঃখযন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন। প্রথমেই অভিমান জ্ঞাপন করেছেন –

“আমি তাই অভিমান করি

আমায় করেছ গো মা সংসারী।

অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসারে সবারি।"


রামপ্রসাদ মাকে দেখতে পেয়েছেন এবং তিনি নিজে তাঁর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। মাতৃচরণে আশ্রয় পাবার পিপাসা তাঁর কখনোই স্থিমিত হয়ে যায় নি। নিজের হৃদয়ে যে মাতৃত্বের প্রতি ব্যাকুলতা একমাত্র সম্পদ সেটি চুরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর ধারণা –

“আমি তাই খেদে খেদ করি

ওই যে মা থাকিতে আমার, জাগা ঘরে হয় চুরি।"


মায়ের প্রতি তীব্র অভিমান ব্যক্ত হয় কমলাকাত্তের মতো ভক্তিবিশ্বাসী সাধকের চরম আকারে প্রকাশিত –

“কার প্রতি সুমতি, কুমতি হও মা কার প্রতি, আপনারো দোষ ঢাকো কারে দোষ দিয়ে।”


এর চেয়ে রামপ্রসাদের অভিমান আরও তীব্র, জীবন্ত–

“মাগো তারা ও শঙ্করি,

কোন অবিচারে আমার 'পরে, করলে দুঃখের ডিক্রী জারি?”


রামপ্রসাদ জানে তাঁর সমস্ত দুঃখের মূল তাঁর নিজের ইন্দ্রিয়বাসনা ও ষড়রিপু। পার্থিব জগতের সুখ উপভোগ করতে যাওয়ার চেষ্টাই তাঁর দুঃখের মূল কারণ। রামপ্রসাদ যেন তাঁর দুঃখের জন্য নিজেকে দায়ী না করে জগজ্জননীকেই দায়ী করেছেন। —

“এক আসামী ছয়টা প্যাদা, বল মা কিসে সামাই করি। 

আমার ইচ্ছা করে, ওই ছয়টারে বিষ খাওয়াইয়ে প্রাণে মারি।।”


সংসারে মায়ার বন্ধন মুক্ত করা বড়োই দূরহ। মায়ার বন্ধন যে সাময়িক সুখের চিত্র তা মরিচীকার ন্যায়। মুক্তিহীন আবর্তনে ছলনাসুলভ সুখই প্রকাশ্য। সেখানে স্থায়ী সুখের কোনো আস্বাদ নেই। এই জীবন যেন ভূতের বেগার খাটার মতো। প্রাত্যহিক জীবনের এই সত্তাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থ, শ্রমের প্রয়োজন। সে সবকিছু মুক্তি সুখের বাধা, রামপ্রসাদ তাই করুণকণ্ঠে গেয়েছেন—

“মা মলেম ভূতের বেগার খেটে,

আমার কিছু সম্বল নাইকো গেঁটে

নিজে হই সরকারি মুটে, মিছে মরি বেগার খেটে।

আমি দিন মজুরী নিত্য করি, পঞ্চভূতে খায় গো বেঁটে।।”


এইভাবে কবি তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত করলেন তীব্র আর্তি-অভিমান, আকুলতা-বেদনা কখনো তীব্র অভিমানের সুরে রামপ্রসাদ বলেছেন—

“আমি কি দুখেরে ডরাই ?”


আর পরক্ষণেই বলেছেন “আর তো দুঃখ সহে না।” অনেক দুঃখযন্ত্রণা সহ্য করেও মাতৃচরণে আশ্রয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। তাই তো কমলাকান্ত বলতে পেরেছেন হৃদয়ের গভীরতর স্থান থেকে –

“মা, না করি নির্ব্বাণে আশ, না চাহি স্বৰ্গাদি বাস, 

নিরখি চরণ দুটি হৃদয়ে রাখিয়ে।”


এই সংসার জীবনে সত্যিকারের সুখ চাইলে কি প্রকৃত সুখ মেলে ? এই সংশয় সচেতন মানুষের মনে আসেই। শাক্ত সাধকরাও এই সংশয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁরা শক্তি দেবীর উদ্দেশ্য মান-অভিমান প্রকাশ করে বারবার উচ্চারণ করেছেন তাঁদের কোনো অপরাধে এই সংসারে এত দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে। সস্তানকে মা যেমন শাসন করেন, জগজ্জননী কি তেমনই সহমর্মী হয়ে সন্তানের ‘প্রকৃত' সুখের জন্য আকুলত প্রকাশ করবেন? শাক্তসাধকদের বহু সংগীতে এইরূপ সংশয় প্রকাশিত হয়েছে। শাক্তসাধকগণ তাঁদের সাংসারিক জীবনে কার্যকলায়, দায়িত্ব পালনের দ্বারা কী মায়ের চরণাশ্রয় লাভের যোগ্যতা অর্জন করতে পারে নি। তাইতো জগজ্জননীর প্রতি তাদের প্রশ্ন –

“হয়নি কি তোর মনের মতো?”


অতএব শেষপর্যন্ত রামপ্রসাদের কণ্ঠে একটা প্রশ্ন উচ্চারিত হয়েছে, যার মধ্যে ভক্তিব্যাকুলতা প্রকাশিত–

“এমন দিন কি হবে তারা,

যবে তারা তারা বলে, তারা বেয়ে পড়বে ধারা।

হৃদিপদ্ম উঠবে ফুটে ; মনের আঁধার যাবে ছুটে,

তখন ধরাতলে পড়বো লুটে, তারা বলে হব সারা।”


এই বিশ্বাসে, মাতৃচরণে ঠাঁই পাবার জন্যই শাক্তসাধকগণের এত সাধনা।